অবিশ্বাস্য জালিয়াতি পূর্বাচল প্রকল্পে by অমিতোষ পাল ও শরীফ আহমেদ শামীম,

গাজীপুরের কালীগঞ্জের পাড়াবর্থা গ্রামের মঞ্জুর হোসেনের তিন দাগে ৪২ বিঘা জমি ছিল। পূর্বাচল উপশহর প্রকল্পের জন্য গাজীপুর ভূমি অফিসের মাধ্যমে জমি অধিগ্রহণ করেছে রাজউক। দুটি দাগের বিপরীতে ভূমি অফিস তাঁকে ক্ষতিপূরণ বাবদ ৪১ লাখ টাকা দিয়েছে। কিন্তু ওই টাকা তাঁর হাতে পৌঁছেনি। কিছু লোক ভুয়া মালিক সেজে ক্ষতিপূরণের ওই টাকা তুলে নিয়েছে। চক্রটি মঞ্জুর হোসেনের আরেকটি দাগের ক্ষতিপূরণের ১৯ লাখ টাকা তোলার


জন্যও 'যাবতীয় কাগজপত্র' তৈরি করে জমা দিয়েছে।সম্প্রতি পূর্বাচল এলাকা ঘুরে বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলে এই জালিয়াতি কাণ্ডকারখানার অবিশ্বাস্য সব কাহিনী জানা গেছে। চক্রটি ইতিমধ্যে জমিদানকারীদের অন্তত ১০০ কোটি টাকা এবং তাঁদের প্রাপ্য ৮০০টি প্লট অ্যাওয়ার্ড হাতিয়ে নিয়েছে। চক্রের সদস্য, একসময়ের দিনমজুর এখন গাড়ি-বাড়ি, ফ্ল্যাট ও কোটি কোটি টাকার মালিক। তাদের এই কুকীর্তিতে সহায়তা করেছেন ভূমি অফিসের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী।
মঞ্জুর হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'কিছুদিন আগে লোকমুখে জালিয়াতি চলার খবর শুনে আমি ভূমি অফিসে যাই। অফিসের লোকজন বলেন, আপনার টাকা তো অনেক আগেই তুলে নিয়েছেন। বাকি ১৯ লাখ টাকা তোলার জন্য কাগজপত্রও জমা পড়েছে। এ কথা শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। আমার হাহাকার দেখে ভূমি অফিস কয়েক দিন পর যোগাযোগ করতে বলে। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, পাশের বাগদী গ্রামের মোহাম্মদ আলী, পানজোড় গ্রামের এমরান মোল্লা ও মোবারক হোসেনসহ কয়েকজন জমির দালাল ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে আমার জমির ক্ষতিপূরণের টাকা তুলে নিয়েছে।'
মঞ্জুর হোসেনের মতো শতাধিক ব্যক্তির জমির জাল দলিলপত্র বানিয়ে জমা দিয়ে ক্ষতিপূরণের টাকা তুলে নিয়েছে চক্রটি। প্রকৃত মালিকরা জানতেও পারেননি তাঁদের ক্ষতিপূরণ ও অ্যাওয়ার্ড (ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য দেওয়া প্লটের কাগজ) অন্যরা হাতিয়ে নিয়েছে। চক্রটি ভুয়া দলিলের মাধ্যমে একই জমির একাধিক মালিক বানিয়েও কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ও প্লট বাগিয়ে নিয়েছে।
পাড়াবর্থা গ্রামের বাসিন্দারা জানান, তাঁদের গ্রামের 'নিখোঁজ' শাহাজউদ্দিনের নামে অনেক জমি ছিল। ওই জমির জাল দলিল বানিয়ে উত্তরার হানিফ ও পাড়াবর্থা গ্রামের রহিম সরকার ক্ষতিপূরণের টাকা তুলে নিয়েছেন। অনেকের ধারণা, ওই চক্রই শাহাজউদ্দিনকে গায়েব করেছে। শাহাজউদ্দিনের স্ত্রী নাজমা বেগম নিখোঁজ স্বামীর সন্ধান পেতে হানিফ ও রহিম সরকারের দ্বারস্থ হলে তাঁকে গালাগাল ও হুমকি-ধামকি দেওয়া হয়। এর কয়েকদিনের মধ্যেই কে বা কারা নাজমা বেগমকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে ধর্ষণ করে। এ ঘটনায় কালীগঞ্জ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি হয়। এরপর থেকে নাজমা বেগমেরও সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। শোনা গেছে, তিনি কাশিমপুরে বাবার বাড়িতে থাকছেন।
স্থানীয়রা জানান, এই রহিম সরকার এক সময় দিনমজুর ছিলেন। পূর্বাচলের ক্ষতিপূরণ জালিয়াতি করে এখন পূর্বাচলের ৪৩টি প্লটের মালিক হয়েছেন, কিনেছেন দুটি প্রাইভেটকার। ৪৩টি প্লটের মধ্যে ১০টি গাজীপুর এলএ অফিসের সার্ভেয়ার ও কানুনগোদের উপহার দিয়েছেন।
গাজীপুরের বাসিন্দারা জানান, গাজীপুরে পাঁচ হাজার টাকা হলেই যেকোনো জমির ভুয়া দলিল, মালিকানার কাগজপত্র, খাজনা খারিজ, ভুয়া আইডি কার্ডসহ সবকিছু পাওয়া যায়। এগুলো দিয়েই ক্ষতিপূরণের টাকা ও প্লটের অ্যাওয়ার্ড কপি তুলে নেওয়া হয়। সম্প্রতি চক্রটি গাজীপুর বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক ও কাপাসিয়ায় গ্যাসফিল্ডের জন্য অধিগ্রহণ করা জমির ক্ষতিপূরণের চার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ওইসব জমির প্রকৃত মালিকরা এখন মাথা কুটে মরছে।
কালীগঞ্জের বড়কাউ গ্রামের বাসিন্দা মাহবুবুর রশিদ বলেন, ১২৩৬ দাগের গাছপালা ক্ষতিপূরণ বাবদ তাঁর জমির ৮০ লাখ টাকা তুলে নিয়েছে কে বা কারা। ভূমি অফিসে গেলে বলে, 'আপনার টাকা তো তুলে নিয়েছেন।' পাড়াবর্থা মৌজার ১২৩১ দাগের বাড়ির মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তার বাড়িঘর ও বিভিন্ন স্থাপনার ক্ষতিপূরণ বাবদ দুই কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন টঙ্গী পৌরসভার মেয়র ও গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজমত উল্লাহ খানের সম্বন্ধী (স্ত্রীর বড় ভাই) আমজাদ খান। বড়কাউ মৌজার ৬৯০ দাগের জমির মালিকের জমির গাছাপালা বাড়িঘরের ক্ষতিপূরণ বাবদ ৫০ লাখ টাকা তুলে নিয়েছেন জমির দালাল হিসেবে পরিচিত উত্তরার হাজী মোস্তফা। এই জালিয়াতি করে মোস্তফা এখন কোটি কোটি টাকার মালিক।
পাড়াবর্থা মৌজার ২৪৮, ২৪৯ দাগের জমির মালিক হাফিজউদ্দিন জানান, বড়কাউ গ্রামের আলমগীর ভুয়া মালিক সেজে তাঁর ক্ষতিপূরণের ২৩ লাখ টাকা তুলে নিয়েছেন। এখন তাঁদের কাছে বললে অস্বীকার করেন।
গাজীপুর ভূমি অফিসের (এলএ) এক কর্মচারী বলেন, জমির মালিক না হয়েও ৩১৭, ১৮৫ ও ২২১ নং দাগের ক্ষতিপূরণের পাঁচ লাখ টাকা ও তিনটি প্লট অ্যাওয়ার্ড তুলে নিয়েছে পাড়াবর্থা গ্রামের আবদুল বাতেনের ছেলে মামুন। একইভাবে পাড়াবর্থা মৌজার ৩৩৪, ৩৩৫, ৫৪৭ দাগের আরেকজনের ক্ষতিপূরণের দেড় কোটি টাকা তুলে নিয়েছে নগরভেলা গ্রামের মেজবাউদ্দিন বাদশা।
বড়কাউ গ্রামের সাহেব আলী মেম্বারের ছেলে মাহবুবুর রশিদ জানান, গাজীপুরের জমির দালাল মান্নান বড়কাউ বাজারের পাশে তাঁর দেড় বিঘা জমিতে ঘরবাড়ি তোলেন। চুক্তি ছিল ঘরবাড়ি তুললে ক্ষতিপূরণের টাকা বেশি পাওয়া যাবে। তার অর্ধেক টাকা তাঁকে দেবেন। কিন্তু মাহবুবকে কোনো টাকাই দেয়নি। পরে খোঁজ নিয়ে জানেন মান্নানসহ তিনজন তাঁর ক্ষতিপূরণের টাকা তুলে নিয়েছেন। একইভাবে বড়কাউ গ্রামের ফয়েজুদ্দিনের ছেলে আবদুল্লাহর জমিতেও বিশাল স্থাপনা বানিয়ে মোস্তফা হাজী অনেক টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
পাড়াবর্থা গ্রামের মো. ফারুক জানান, আমানুল্লাহ সরকারের ছেলে রহিম এসব কর্মকাণ্ডের দালাল। সে পিংলান গ্রামের মোহাম্মদ মহির কাগজপত্রে অন্য লোকের ছবি লাগিয়ে গাছপালা-ঘরবাড়ির ক্ষতিপূরণ বাবদ পাঁচ লাখ টাকা তুলে নিয়েছে। এমনকি নিজের বোন ও ভাগ্নের জমিরও মালিক সেজে ক্ষতিপূরণ এবং অ্যাওয়ার্ড তুলে নিয়েছে। একই গ্রামের রফিক হাজী ও তাঁর ছেলে মানিককে জমির ভুয়া মালিক সাজিয়ে আরএস ৬৫০ ও ৬৫১ দাগের জমির ক্ষতিপূরণের চার লাখ টাকা তুলে নিয়েছে।
এলএ অফিসের একাধিক কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পাড়াবর্থা ও বড়কাউ মৌজার জমির ক্ষতিপূরণ বাবদ বরাদ্দ ছিল ১৭৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে অন্তত ১০০ কোটি টাকাই ভুয়া মালিক সেজে অন্যরা তুলে নিয়েছে।
পাড়াবর্থা গ্রামের একাধিক বাসিন্দা জানায়, এই গ্রামের মৃত জনাব আলীর ছেলে ফখরুদ্দিনের কোনো জমি না থাকলেও তিনি তিনটি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। শ্বশুরের জমি তিনজনের নামে তিনটি জাল দলিল বানিয়ে পৃথক মালিকানা তৈরি করে এই অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন তিনি। জমির দালাল মুক্তার হোসেনের মাধ্যমে এলএ অফিসের লোকজনের সঙ্গে যোগসাজশ করে এটা করেছেন।
একইভাবে মুক্তারের বাবা বেচু মিয়া তাঁর দুই বিঘার জমির আরো দুটি জাল দলিল করে একটা ভগি্নপতি ও বড়বোন শরীফা বেগমের নামে অ্যাওয়ার্ড তুলেছেন। এভাবে জমির মালিক না হয়েও কালীকুঠি ও বড়কাউ গ্রামের বেদন, বাদল, ময়জুন, রহিমা, নুরু মিয়াসহ অসংখ্য ব্যক্তি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন বলে জানায় স্থানীয় লোকজন।
কালীগঞ্জের একাধিক ব্যক্তি জানায়, বিগত নির্বাচনের আগে স্থানীয় সংসদ সদস্য মেহের আফরোজ চুমকির ওয়াদার কারণে এলাকাবাসী এখনো বিশ্বাস করে এখানে পূর্বাচল প্রকল্প হবে না। এ জন্য অনেকেই ক্ষতিপূরণের টাকার খবর নেয় না। সেই সুযোগে সংঘবদ্ধ চক্রটি তাদের জমির ক্ষতিপূরণের টাকা তুলে নিচ্ছে। ওই চক্রের সঙ্গে যুক্ত আছে রূপগঞ্জের হযরত আলী। জাল দলিল বানানোয় তিনি খুবই সিদ্ধহস্ত। দলিলপ্রতি ৫০ হাজার টাকা দিলেই সব কাগজপত্র পাওয়া যায়। তাঁর সঙ্গে আছেন হানিফ ও মোস্তফা। সব সিল-ছাপ্পড় তাঁদের পকেটেই থাকে। দুজনই উত্তরার বাসিন্দা ও জমির দালাল হিসেবে পরিচিত। এর মধ্যে উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরের মোস্তফার আলিশান বাড়িতে ভাড়া থাকেন গাজীপুর এলএ অফিসের সার্ভেয়ার বেলাল। এই চক্রের অন্য সদস্যরা হলেন টঙ্গী পৌর মেয়রের সম্বন্ধী আমজাদ খান, পাড়াবর্থা গ্রামের রহিম সরকার, বাগদী গ্রামের মোহাম্মদ আলী, উলুখোলার মেজবাউদ্দিন বাদশা, এলএ অফিসের সার্ভেয়ার বেলাল, এমদাদ, জলিল, কানুনগো নজরুল, সম্প্রতি বদলি হওয়া কানুনগো হাবিব, সাবেক এলএ কর্মকর্তা মলি্লকা খাতুন, সাবেক এডিসি (রাজস্ব) সুব্রত পাল চৌধুরী, সহকারী এলএ কর্মকর্তা মুস্তফিজ, এলএ কর্মকর্তা মামুন মিয়াসহ আরো অনেকে।
স্থানীয় লোকজন জানায়, উত্তরার হানিফ এই কাজ করার জন্য পূর্বাচলের পাশে গলানবাজারে একটি অফিসও নিয়েছেন। সেখানে বিভিন্ন মানুষের ক্ষতিপূরণ তুলে দেওয়ার নামে টাকা আত্মসাৎ, খাসজমির কাগজপত্র বানিয়ে ক্ষতিপূরণ ও অ্যাওয়ার্ড আত্মসাৎ, অ্যাওয়ার্ড বিক্রি ইত্যাদি কাজ করেন। ভাসাভাসি গ্রামের আবুল হোসেনের স্ত্রী শিউলি বেগমের অ্যাওয়ার্ড, ক্ষতিপূরণের টাকাও তিনিই তুলে নিয়েছেন।
এ ব্যাপারে মো. হানিফের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি অন্যের অ্যাওয়ার্ড ও ক্ষতিপূরণ আত্মসাতের বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন। তবে তিনি বলেন, 'এ ধরনের কাজ এখানে অহরহ হচ্ছে। আমি একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। তাদের জন্য এখানে প্লট কিনছি। ইতিমধ্যে ১০০টি প্লট কিনেছি। এর ৪০টি পড়েছে পূর্বাচলের রূপগঞ্জ এলাকায়। অন্যগুলো কালীগঞ্জ অংশে।' তিনি জানান, এখানে এসব কাজের সঙ্গে যুক্ত এলএ অফিসের সার্ভেয়ার ও কানুনগোরা।
অন্য অভিযুক্ত আমজাদ খান বলেন, 'আপনি যে জমির কথা বলছেন, সেটা আমার এক মামাশ্বশুরের। সেই বিল তুলেছি এক-দুই বছর আগে। চার-পাঁচটা অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছি। সেখানে আমার ঘরবাড়ি ছিল। যারা পূর্বাচল প্রকল্পের বাস্তবায়ন চাইছে না তারা এসব কথা ছড়াচ্ছে।'
গাজীপুরের ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা মামুন মিয়া বলেন, 'আমি আসার পর এখানে দু-একটি ঘটনা ঘটেছে। সেগুলোর ক্ষেত্রে দুই পক্ষকে ডেকে এনে সমস্যার সমাধান করেছি। এ কাজে ভূমি অফিসেরও দু-একজন জড়িত থাকতে পারে। কেউ অভিযোগ নিয়ে এলে সমাধান দেওয়া যায়।'

No comments

Powered by Blogger.