কেমন আছ মা-নিজের ধরা মাছ খাইয়ে কাসেমকে বিদায় দেয় বাবা-আবেদা খাতুন

খনো আমার মনে আছে_অনেকবার বারণ করার পরও আমার দ্বিতীয় ছেলে কাসেমকে যুদ্ধে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে পারলাম না। কাসেম সিদ্ধান্তে অটল, যুদ্ধে যাবেই। পরীক্ষা দিয়ে এসে একদিন সে তার যুদ্ধে যাওয়ার কথা জানায়। তার সঙ্গে ছিল নজরুল নামে এক বন্ধু। দুজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত। অনেক পীড়াপীড়ি করায় কাসেমকে যুদ্ধে যেতে বলি।


\একদিন দুপুরে তার যাওয়ার সময় হলো। ছেলে আর ফিরবে কি না সেই শঙ্কা আমাদের মাঝে। যুদ্ধে যেতে বারণ করলে তার বাবাকে কাসেম বলেছিল, আমাকে ত্যাজ্যপুত্র করে দাও। তবু আমি যুদ্ধে যাবই। যেহেতু কিছুতেই ফেরানো যাচ্ছে না, তাই ছেলেকে খাওয়াবে বলে সেদিন কাসেমের বাবা নিজে নদীতে জাল ফেলে মাছ ধরে আনে। খাওয়া-দাওয়া করে দোয়া নিয়ে যুদ্ধে চলে যায় কাসেম। বলে যায়, দেশ স্বাধীন করেই ঘরে ফিরবে। সেদিন হয়তো ভাবিনি, এটাই হবে বাড়িতে তার শেষ খাওয়া।
যুদ্ধ চলছে। এরই মধ্যে একদিন শুনি, একটি যুদ্ধযান নিয়ে আসার পথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় কাসেমসহ অনেকে পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়েছে। এরপর আর তার খোঁজ মেলেনি। একদিন যুদ্ধ শেষ হলো। স্বাধীন পতাকা পেল বাংলাদেশ। কিন্তু ফিরে আসেনি আমার বুকের ধন।
কাসেমের খোঁজে বাংলাদেশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ঘুরে বেড়াই। স্বজনরা ভারতের আগরতলার বিভিন্ন স্থানেও খোঁজ করে। এরই মধ্যে গত বছরের ডিসেম্বরে টেলিভিশন চ্যানেল বাংলাভিশনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবার কুল্লা পাথর নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রচারিত হয়। রিপোর্টে বলা হয়, 'এখানে শায়িতদের মধ্যে আবুল কাসেম শিকদার নামে একজনের পরিচয় মেলেনি।'
ছুটে যাই কুল্লা পাথরে। খুঁজে পাই ছেলের সমাধি। সেদিন আমার বুকটা ভরে যায়। আনন্দে চোখে পানি আসে_এত সম্মান দিয়ে আমার ছেলেকে রাখা হয়েছে! ভুলে যাই ৪০ বছরের দীর্ঘ অপেক্ষার কষ্টগুলো। দুই হাত তুলে প্রাণভরে দোয়া করি দেশের জন্য, ছেলের জন্য।
কাসেম ছিল খুবই মেধাবী। প্রথম শ্রেণী থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন পর্যন্ত কখনো সে দ্বিতীয় হয়নি। যুদ্ধে যাওয়ার আগে কাসেম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগ থেকে অনার্স শেষ বর্ষের পরীক্ষা দেয়। পরীক্ষার শেষ দিনেই সে বাড়ি চলে আসে।
কাসেম বাড়ি এসেই আমাকে বলতে লাগল, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছেলেই যুদ্ধে যাচ্ছে। পাকিস্তানিরা বিভিন্ন স্থানে হামলা চালাতে শুরু করেছে। দেশকে স্বাধীন করা প্রয়োজন। একদিন সহপাঠী ও বন্ধু নজরুলকে সঙ্গে নিয়ে এসে যুদ্ধে যাওয়ার কথা বলে। নজরুলও আমাদের যুদ্ধে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বোঝায়। সেও ছিল খুব মেধাবী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দেয় সে।
তারা দুজনই একসঙ্গে ট্রেনিং নেয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা এলাকায় ছিল তাদের অবস্থান। যুদ্ধ চলাকালে পরিবারের সবাই মিলে তিতাস থেকে আমার বাবার বাড়ি চাঁদপুরে চলে যাই। কাসেম সেখানে দু-একবার গিয়েছিল। তার সারা শরীরে কাদা মাখা দেখে মুছে দিতে চাইতাম। তখন কাসেম বলত, এখন শরীর থেকে মাটি মুছব না। দেশকে শত্রুমুক্ত করে তবেই শরীর থেকে মাটি ঝেড়ে ফেলব।
যুদ্ধের সময় আমি নামাজ পড়ে দেশের জন্য দোয়া করতাম। আমার ছেলের জন্য দোয়া করতাম। ৪০ বছর পর আমার ছেলের কবরের সন্ধান পেয়েছি, এখন আমার আর কোনো দুঃখ নেই। তবে সরকারের কাছে আমার আবেদন, যাদের জন্য আমাদের লাখো ছেলেমেয়ে শহীদ হয়েছে, সেই রাজাকারদের বিচারে যেন কোনো বিলম্ব করা না হয়। আর আমি চাই একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার মায়ের সম্মান।
আমার পরিবারের সবাই এখন সচ্ছল। এক ছেলে মো. শহিদুল্লা বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি। অন্যরাও নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে ভালো আছে। তাই ভাতা পেলাম-কি-পেলাম না, সেটা আমার কাছে বড় কিছু নয়। কিন্তু একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার মায়ের স্বীকৃতি চাই আমি।

আবেদা খাতুন : কুমিল্লা জেলার তিতাস উপজেলার উত্তর আকালিয়া গ্রামের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাসেম শিকদারের মা।
অনুলিখন : বিশ্বজিৎ পাল বাবু (ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি) ও ওমর ফারুক মিয়াজী (দাউদকান্দি প্রতিনিধি)।

No comments

Powered by Blogger.