গ্রামীণ জনপদে নবান্নের আয়োজন by সুমনকুমার দাশ

গ্রহায়ণ মাস মানেই মধ্যবিত্ত গ্রামীণ কৃষিজীবনে উৎসবের আমেজ। বর্ষায় রোপণ করা ‘আমন’ ধান কাটা হয় এ মাসেই। আর ধান কাটা শেষে গ্রামীণ জনজীবনের আনন্দ বয়ে আনে ‘নবান্ন উৎসব’। তবে অঞ্চলভেদে পৌষ মাসের শেষ নাগাদ পর্যন্ত এ-বাড়ি ও-বাড়ি চলে নবান্নের আনুষ্ঠানিকতা।

১৮৭৪ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত রমেশচন্দ্র দত্তের বাংলার কৃষক বইতে উল্লেখ করা হয়েছে, আমন ধান রোপণ করা হয় ভরবর্ষায় এবং নিচু জমিতে। ধান কাটা হয় বাংলা বর্ষের শেষের দিকে অগ্রহায়ণ ও পৌষ মাসে। নবান্ন উৎসবকে ‘আমন পার্বণ’ উল্লেখ করে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমন কাটা শেষে আনন্দ-উল্লাসের সাথে অনেক পরিবার জড়ো হয় এবং বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান ও উৎসব পালন করে। তবে এই উৎসবের প্রধান উপাদান হলো ডিসেম্বরের শীতের মতো উষ্ণ ও হূদ্যতাপূর্ণ ভোজন এবং বিভিন্ন উপায়ে তৈরি উষ্ণ ও সুস্বাদু পিঠা বিতরণ।’
এই ধান কাটা ঘিরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উৎসবমুখরতায় ‘শস্য কর্তন’ উৎসব পালিত হয়। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বিপুল উৎসাহ নিয়ে নবান্ন উৎসব পালন করে থাকেন কৃষিজীবী মানুষ। আমন ধান কাটা শেষেও আনন্দ-উৎসাহে মেতে ওঠেন তাঁরা। ঘরে ঘরে উপাদেয় খানাপিনার আয়োজন করা হয়। এটি মূলত কৃষিভিত্তিক লোকোৎসব।
সিলেট সদর উপজেলার খাদিমপাড়া এলাকার কৃষক নিকলেশ দেবনাথ জানান, আমন ধানে চিকন ধরনের চাল হয়। আগের রাতে পানিতে ভিজিয়ে রাখা আতপ চাল পরদিন ভোরে স্নানশেষে কিষানিরা ঢেঁকিছাঁটা করে গুঁড়ি তৈরি করেন। ঝুনো নারকেল কুরিয়ে সেই গুঁড়ি দিয়ে নানা ধরনের পিঠা তৈরি করা হয়। সেই সঙ্গে নতুন চালের মুড়ি-মুড়কি এবং পায়েস তো রয়েছেই। বিভিন্ন দেবতার পূজা শেষে এসব উপকরণ আত্মীয়স্বজনদের খাওয়ার জন্য পরিবেশন করা হয়।
শুধু খাওয়া-দাওয়াই নয়, এই উৎসবের বিনোদনের অনুষঙ্গ হিসেবে থাকে লাঠিখেলা, ষাঁড়ের লড়াই আর গান-বাজনার আয়োজন। সিলেটের প্রবীণ বাউল আবদুর রহমান বলেন, ‘রোপা ধান (আমন) কাটা শেষে কোনো কোনো গ্রামে আমাদের বাউল গান গাওয়ার জন্য ডাক পড়ে। কৃষকবাড়ির আঙিনায় সারা রাত গান করি। আর শীতের রাত জেগে তা উপভোগ করেন কিষান-কিষানি থেকে শুরু করে ছেলে-বুড়ো সবাই।’
সরেজমিনে সিলেটের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, খেতজুড়ে এখন পাকা ধানের সোনালি ঝলক। ধান কাটা-মাড়াই ও শুকানোর স্থান ‘খলা’ তৈরিতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন কৃষকেরা। সিলেট সদর উপজেলার সোনাতলা গ্রামের কৃষক হাসান উদ্দিন বলেন, ‘এবার আমন ধানের ফলনও ভালো হয়েছে। ফলন ভালো হওয়ায় কৃষকদের আনন্দ বহুগুণে বেড়ে গেছে।’
সিলেটের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক এ কে এম রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে জানান, এবার জেলায় আমন ধানের ফলন হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার বেশি। আবাদ হয়েছে তিন লাখ ৮৯ হাজার ৬৩০ হেক্টর। সিলেটে এর আগে এত বেশি জমিতে আমন আবাদ হয়নি।

No comments

Powered by Blogger.