কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন-দুদলেই সংকটের আভাস by আবুল কাশেম হৃদয়,

ইনি জটিলতার শঙ্কা মাথায় রেখেই কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। এমন শঙ্কা সত্ত্বেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে কমিশনের পাশাপাশি ভোটাররাও যথেষ্ট আশাবাদী। তাঁরা বরং খুঁজে ফিরছেন সৎ ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, যিনি সিটি করপোরেশনকে সাজাবেন পরিকল্পিতভাবে। নেতৃত্ব দেবেন সততার সঙ্গে।


নির্বাচনে বড় দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি থেকে সমর্থন পেতে বেশ কয়েকজন করে রাজনৈতিক নেতা প্রার্থী হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। শেষ পর্যন্ত একক প্রার্থী সমর্থন দিতে গিয়ে এ দুটি দলকে বিপাকে পড়তে হতে পারে।
আগামী ২৪ নভেম্বরের মধ্যে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করা হচ্ছে। এ
অবস্থায় সম্ভাব্য প্রার্থীরা সিটির নেতৃত্ব দখলের দৌড়ে কোমর বেঁধে নির্বাচনী মাঠে নামতে যাচ্ছেন। অবশ্য ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন সম্ভাব্য প্রার্থী মাঠে নেমে পড়েছেন, যাচ্ছেন ভোটারদের দ্বারে দ্বারে। কেউ কেউ ভোটারদের সামনে উপস্থাপন করছেন সিটি করপোরেশনকে নিয়ে তাঁদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। আইন অনুযায়ী আগামী ১ জানুয়ারির মধ্যে এই সিটি করপোরেশনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তফসিল ঘোষণা না হলেও কুমিল্লায় নির্বাচন সামনে রেখে সংবাদ সম্মেলন ও প্রচার-অভিযান চলছে। নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণার আগেই সম্ভাব্য প্রার্থীদের এমন তৎপরতা ইতিমধ্যে কুমিল্লায় নির্বাচনী আমেজ তৈরি করে দিয়েছে। ঝড় উঠেছে চায়ের কাপে।
সম্ভাব্য প্রার্থীরা যা বললেন : কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত পাঁচজন, বিএনপির চারজন এবং জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর একজন করে প্রার্থী রয়েছেন সম্ভাব্য মেয়র পদপ্রার্থীর তালিকায়। আওয়ামী লীগের সমর্থনে নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহীদের মধ্যে আছেন জাতীয় সংসদের সদস্য হাজী আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার, কুমিল্লা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্যক্ষ আফজল খান, বাংলাদেশ কৃষক লীগের সহসভাপতি ও আওয়ামী লীগ নেতা আলহাজ ওমর ফারুক, জেলা আওয়ামী লীগ নেতা নুর-উর-রহমান মাহমুদ তানিম এবং জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আনিসুর রহমান মিঠু। এর পাশাপাশি জাতীয় পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান এয়ার আহমেদ সেলিম মহাজোটের সমর্থনে নির্বাচনের জন্য তৎপরতা চালাচ্ছেন।
বিএনপির সমর্থনে মেয়র পদে প্রার্থী হতে আগ্রহীদের মধ্যে রয়েছেন কুমিল্লা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হাজী আমিন-উর-রশিদ ইয়াছিন, সদ্য বিলুপ্ত কুমিল্লা পৌরসভার সদ্য বিদায়ী মেয়র ও কেন্দ্রীয় বিএনপির নির্বাহী সদস্য মনিরুল হক সাক্কু, বিএনপির কেন্দ্রীয় পল্লী উন্নয়ন সম্পাদক মনিরুল হক চৌধুরী এবং বিএনপির কেন্দ্রীয় সদস্য কণ্ঠশিল্পী আসিফ আকবর। এ ছাড়া জামায়াতের সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকায় রয়েছেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের সাবেক জিএস জামায়াত নেতা মোহম্মদ সানাউল্লাহ।
সংসদ সদস্য হাজী আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার বলেন, 'আমি কুমিল্লার পরীক্ষিত নেতা। দুবার কুমিল্লা পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলাম। আমি মেয়র পদের জন্য নিজেকে যোগ্য মনে করি। দল ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমর্থন দিলে সংসদ সদস্য পদ ত্যাগ করে মেয়র পদে নির্বাচন করব। কারণ সিটি করপোরেশনকে সাজাতে সৎ ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের প্রয়োজন রয়েছে।' তিনি আরো বলেন, 'নারায়ণগঞ্জ আর কুমিল্লা এক নয়। নায়ায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের ঘাঁটি। কিন্তু কুমিল্লার পরিস্থিতি ভিন্ন। এখানে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রার্থী দিতে হবে।'
অধ্যক্ষ আফজল খান বলেন, 'গত সংসদ নির্বাচনের সময় জননেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান করার আশ্বাস দিয়েছিলেন। পরে সংসদ সদস্য মনোনয়ন দেওয়ার কথা বলেছেন। কিছুদিন আগে নেত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি বলেছেন যে তিনি তাঁর দেওয়া কথা থেকে সরেননি। আশা করি, কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলের সমর্থন পাব।'
আলহাজ ওমর ফারুক বলেন, 'কুমিল্লা শহরে রাজনীতি করি ৪৬ বছর ধরে। আমি আওয়ামী লীগের একজন কর্মী। আমার বিশ্বাস, জননেত্রী শেখ হাসিনা আমার কাজের মূল্যায়ন করবেন। আমি কুমিল্লার সুষম উন্নয়নের চেষ্টা করব। কুমিল্লাকে আদর্শ ও সুন্দর নগরীতে পরিণত করব।'
নুর-উর রহমান মাহমুদ তানিম বলেন, 'আমি চেষ্টা করব দলের সমর্থন নেওয়ার জন্য। যদি তা না হয় তাহলে আমি অভিভাবকদের সঙ্গে আলোচনা করব এবং তারপর সিদ্ধান্ত নেব।'
ইতিমধ্যে জোর প্রচারণায় নেমে পড়া আনিসুর রহমান মিঠু বলেন, 'নির্বাচনে প্রার্থী হতে আমার ওপর নেতা-কর্মীদের চাপ আছে। দল সঠিক যোগ্য নেতৃত্ব চাইলে আমাকে সমর্থন দেবে।'
অন্যদিকে বিএনপিতেও রয়েছে প্রার্থীর আধিক্য। ইতিমধ্যেই মাঠে নেমে পড়েছেন হাজী আমিন-উর রশিদ ইয়াছিন ও মনিরুল হক সাক্কু।
হাজী আমিন-উর রশিদ ইয়াছিন বলেন, 'সবাই মিলে প্রস্তুতি নিচ্ছি নির্বাচনের জন্য। তফসিল ঘোষণা করা হলে নির্বাচনে অংশ নেব। দলের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের চাপ আছে যেন আমি নির্বাচন করি। তারা আমাকে মেয়র পদে দেখতে চায়। আশা করি, দলের সমর্থন আমাকে দেওয়া হবে।'
মনিরুল হক সাক্কু বলেন, 'কুমিল্লা পৌরসভাকে আমি গার্ডেন সিটিতে রূপান্তর করেছি। নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ করেছি দিনরাত। কুমিল্লার মানুষ তা দেখেছে। যেহেতু আমি মেয়র থাকাকালেই এটি সিটি করপোরেশন হয়েছে, সেহেতু আমার বিশ্বাস, দল আমাকেই সমর্থন দেবে।' তিনি আরো বলেন, 'কুমিল্লা পৌরসভা তো আমি চালিয়েছি। কুমিল্লার মানুষ আমার কাজের প্রশংসা করেছে। সুতরাং এটা আমার প্রাপ্য।'
মনিরুল হক চৌধুরী দেশের বাইরে থাকায় তাঁর বক্তব্য নেওয়া যায়নি। অন্য সম্ভাব্য প্রার্থী আসিফ আকবর বলেন, 'আমি মনোনয়নপত্র কিনব। দল যোগ্য ও গ্রহণযোগ্য প্রার্থী সমর্থন করলে আমার কোনো কথা নেই। আমি মনোনয়ন কিনে অপেক্ষা করব। দলের বাইরে তো যাওয়ার সুযোগ নেই, যেহেতু দল করি।'
জাপা নেতা এয়ার আহমেদ সেলিম বলেন, 'মহাজোটগতভাবে প্রার্থী দিলে আমিই সমর্থন পাব। দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কুমিল্লায় জনসভা করে আমাকে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। আমি কুমিল্লা পৌরসভায় দু-দুবার চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছি।'
পেছন ফিরে দেখা : অবিভক্ত ভারতবর্ষে ১৭৯০ সালে তৎকালীন ত্রিপুরা জেলা প্রশাসন গঠনের মধ্য দিয়ে আজকের কুমিল্লা পৌর প্রশাসনের যাত্রা শুরু। এর শত বছর পর ১৮৯০ সালের মাঝামাঝি সময়ে এটি রূপ নেয় পৌরসভায়। সে সময় এটি ছিল শহরটির প্রথম প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান। এটির নির্বাহী প্রধান নাগরিকদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হতেন। কুমিল্লা শহরবাসীর মৌলিক সমস্যার সমাধান ও নাগরিক সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সীমিত অধিক্ষেত্র নিয়ে ১৮৬৪ সালের ৩০ নভেম্বর যাত্রা শুরু করে কুমিল্লা মিউনিসিপ্যালিটি। এরপর পেরিয়ে গেছে শত বছর। কিন্তু অবকাঠামোগতভাবে শহরটির আশানুরূপ উন্নয়ন হয়নি। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর ১৯৭৩ সালের ২২ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে নামকরণ করা হয় 'কুমিল্লা পৌরসভা'। চলতি বছরের ১০ জুলাই প্রাচীনতম পৌরসভা কুমিল্লা ও নবগঠিত সদর দক্ষিণ পৌরসভাকে নিয়ে ঘোষণা করা হয় কুমিল্লা সিটি করপোরেশন। দুটি পৌরসভার পুরনো ২৭টি ওয়ার্ডকেই বহাল রেখে সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড বিভক্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে কুমিল্লা পৌরসভায় ১৮টি ও সদর দক্ষিণ পৌরসভায় ৯টি ওয়ার্ড। করপোরেশনে মোট ভোটকেন্দ্র ৬৫টি। বুথ থাকবে ৪৫৩টি। মোট ভোটার এক লাখ ১৭৪ জন।
 

No comments

Powered by Blogger.