জলবায়ু পরিবর্তন-ধেয়ে আসছে বিপদ by আশরাফ-উল-আলম

শিল্পোন্নত দেশগুলোর অতিমাত্রায় কার্বন ডাই-অঙ্াইড নির্গমন আর বিলাসী জীবনযাপনের কারণে পৃথিবীর জলবায়ুতে যে পরিবর্তন ঘটছে, তাতে সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে পড়েছে বাংলাদেশ। লন্ডনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান 'ম্যাপলক্রফট' বিশ্বের ১৭০টি দেশের ওপর জরিপ চালিয়ে ১৬টি দেশকে 'চরম ঝুঁকিপূর্ণ' হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। এ তালিকার শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। গত বছর অক্টোবরে ম্যাপলক্রফট এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।


সেখানে বলা হয়েছে, ১৬টি দেশের মধ্যে পাঁচটিই দক্ষিণ এশিয়ার। তালিকায় বাংলাদেশের পরেই আছে ভারত। ক্ষতির দিক থেকে বাংলাদেশকে বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে মনে করা হচ্ছে দুটি কারণে। এক. সর্বোচ্চ মাত্রায় অনাবৃষ্টি। দুই. চরম খাদ্যাভাব। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বিপদ ধেয়ে আসছে বাংলাদেশের দিকে।
এ বিপদ মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশ ইতিমধ্যে আইন প্রণয়ন করে 'জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট' গঠন করেছে। কিন্তু কার্যকর কোনো পদক্ষেপ এখনো নেওয়া হয়নি। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশ সম্পূর্ণ প্রস্তুত নয়।
গত বছর জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় নিজস্ব তহবিল গঠন করে কাজ শুরু করে সরকার। ট্রাস্টে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়। গত বছর ও এ বছর_দুই দফায় ৭০০ কোটি টাকা অর্থ বরাদ্দ করে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে। সম্ভাব্য ক্ষতি থেকে রক্ষার জন্য কাজ করতে বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনকে (এনজিও) আওতায় আনা হলেও এখন পর্যন্ত অর্থ ছাড় না দেওয়ায় তারা কাজ শুরু করতে পারছে না। আবার জানা গেছে, যেসব এনজিওকে কাজ করার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, তাদের এ বিষয়ে কোনো অভিজ্ঞতা নেই। জলবায়ু তহবিল নিয়ে হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
গবেষকরা মনে করেন, পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য অন্যতম দায়ী কার্বন ডাই-অঙ্াইড নির্গমনের হার কমাতে উন্নত দেশগুলোর ওপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো বিশ্বের ওই সব দেশের কাছ থেকে যাতে ক্ষতিপূরণ পায়, তা নিশ্চিত করতে জাতিসংঘকে ভূমিকা নেওয়ার জন্যও চাপ সৃষ্টি করতে হবে।
১৯৯২ সালে জাতিসংঘ একটি কনভেনশন গ্রহণ করে। এতে প্রতিটি শিল্পোন্নত দেশ স্বাক্ষর করে অঙ্গীকার করে যে ২০০০ সালের মধ্যে ১৯৯০ সালকে ভিত্তি করে নিজ নিজ দেশে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন শতকরা পাঁচ ভাগ কমিয়ে আনবে। কিন্তু একটি দেশও ওই অঙ্গীকার রক্ষা করেনি, বরং তা প্রতিবছর বেড়েই চলেছে। আর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দরিদ্র দেশগুলো।
সবচেয়ে ক্ষতির সম্মুখীন বাংলাদেশ : ম্যাপলক্রফটের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে রয়েছে ভয়াল দারিদ্র্যের সঙ্গে নিরন্তর এক যুদ্ধ এবং কৃষির ওপর সর্বতোভাবে নির্ভরশীল অবস্থা। তাই দেশটির অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বেশির ভাগ শাখাই বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার শিকার হবে। বিপদের অন্য গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো, বাংলাদেশ এসব বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর খুব বেশি সামর্থ্য রাখে না।
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে গবেষণাকারী অর্থনীতিবিদ ফাহমিদা খাতুন সম্প্রতি বিবিসির এক সংলাপে বলেছেন, বাংলাদেশের জনগণের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন না আনতে পারলে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত আন্তসরকারি প্যানেলের (আইপিসিসি) প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে, সুপেয় পানি পাওয়া যাবে না এবং জমি অনুর্বর হবে। এ ছাড়া দেশে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাবে, কৃষিক্ষেত্রে বিপর্যয় নেমে আসবে, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, খরা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. আনসারুল করিম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে সমুদ্রতীর রক্ষায় নির্মিত বাঁধগুলো ধ্বংস হচ্ছে। উপকূলীয় ভূমি ক্ষয়ের পরিমাণ ভয়ংকরভাবে বাড়ছে। সমুদ্র বেশি উত্তাল হচ্ছে। জেলেদের জীবন হুমকিগ্রস্ত হচ্ছে। সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ থেকে সরকারের যে আয়, তাও হুমকির সম্মুখীন। দেশে বন্যার পরিমাণ বাড়ছে। উত্তরাঞ্চলে খরা বাড়ছে। ভূমির উর্বরতা কমছে। অতিবৃষ্টি ও অনাবৃষ্টির হারও বেড়ে যাচ্ছে।
ড. আনসারুল বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্তি পেতে সরকারকে আরো বেশি সচেতন হতে হবে। যেসব সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যে নেওয়া হয়েছে, তা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। তা না হলে বিপদ এড়ানো যাবে না।
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মিজান আর খান বলেন, 'জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সারা বিশ্বেই প্রতিনিয়ত বাড়ছে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা পাওয়ার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ। বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। আশা করি, এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে।'
ইতিমধ্যে বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে আবহাওয়া পরিবর্তিত হচ্ছে। ঋতুগুলো স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হারাচ্ছে। নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানছে। খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় থেকে ২০০৯ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত 'দুর্যোগকোষ'-এ বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত বলা হয়েছে।
উপকূলবর্তী এলাকা : দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে বিভিন্ন গবেষণায় জানা গেছে। দেশের মোট আয়তনের ৩২ ভাগই উপকূলীয় এলাকা (১৯টি জেলা), যেখানে প্রায় চার কোটি লোক বসবাস করে। জলবায়ুবিজ্ঞানীরা ধারণা করেন যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে কুতুবদিয়ার ২৫০ বর্গকিলোমিটার, ভোলার ২২৭ বর্গকিলোমিটার ও সন্দ্বীপের ১৮০ বর্গকিলোমিটার এলাকার শতকরা ৬৫ ভাগ ইতিমধ্যে সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়েছে। ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠ সর্বোচ্চ এক মিটার উঁচু হতে পারে বলে আশঙ্কা আছে। এর ফলে বাংলাদেশের মোট আয়তনের প্রায় ১৮.৩ শতাংশ নিমজ্জিত হতে পারে। কেউ কেউ অবশ্য এক-পঞ্চমাংশ পানিতে ডুবে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন। ইতিমধ্যে দক্ষিণ তালপট্টি সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
সুপেয় পানি : সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে নোনা পানি ঢুকছে। শুষ্ক মৌসুমেও বিভিন্ন নদীপথ দিয়ে দেশের অভ্যন্তরে ১০০ কিলোমিটারেরও বেশি এলাকা পর্যন্ত নোনা পানি ঢুকে পড়ছে। ফলে সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে ওই সব জেলায়। উপকূলীয় জেলাগুলো ছাড়াও বাগেরহাটের উত্তরাঞ্চল, গোপালগঞ্জ, নড়াইলসহ অন্য জেলাগুলোতেও নোনা পানি ঢুকে পড়েছে। সুপেয় পানি সংকটের পাশাপাশি দেশের দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় আট লাখ ৩০ হাজার হেক্টর কৃষিজমি বিভিন্ন মাত্রার লবণাক্ততায় আক্রান্ত হয়ে উৎপাদনশীলতা হারাচ্ছে।
বরেন্দ্র মরুভূমি : জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বরেন্দ্র এলাকাগুলোতে বৃষ্টিপাত কম হয়। ফলে নিচে নেমে যাচ্ছে পানির স্তর। এসব এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানিও উত্তোলন করা হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত। এভাবে এখানে মরুভূমির পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে। রাজশাহীর আশপাশে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনও এখন কঠিন হয়ে পড়েছে।
খাদ্য ঘাটতি : ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে ধানের উৎপাদন প্রায় ৮ শতাংশ এবং গমের উৎপাদন প্রায় ৩২ শতাংশ কমবে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। ফলে খাদ্য নিরাপত্তায় দেখা দেবে অনিশ্চয়তা। পাশাপাশি নতুন ধরনের জলবায়ু পরিস্থিতিতে নানা রকম স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেবে।
জীববৈচিত্র্যে প্রভাব : জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে লবণাক্ত পানিতে মাছ ও অন্যান্য জীবের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে। বন উজাড় হওয়ার কারণে ৩০টি প্রজাতির বন্য প্রাণীর অস্তিত্ব হুমকির মুখে রয়েছে বলে জাতিসংঘ তথ্য প্রকাশ করেছে। বিপন্ন প্রাণীর মধ্যে রয়েছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিতাবাঘ, হাতি, অজগর সাপ, কুমির, ঘড়িয়াল ইত্যাদি। বিগত শতাব্দীতে বাংলাদেশে ১৯টি প্রজাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো গণ্ডার, বুনো মহিষ, কালো হাঁস, নীলগাই, রাজশকুন ইত্যাদি।
মৎস্য সম্পদে প্রভাব : জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দেশের মৎস্য সম্পদ ধ্বংস হয়ে যাবে বলে জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন। বর্তমানে মিঠাপানিতে ২৬০ প্রজাতির স্থানীয় মাছ, ৪৭৫ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৩১ প্রজাতির বিদেশি মাছ ও ২৪ প্রজাতির চিংড়ি মাছ পাওয়া যায়। চিংড়ির মধ্যে ১৬ প্রজাতির রয়েছে সামুদ্রিক। এ ছাড়া ৪৫০ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক রয়েছে। এর মধ্যে ৩০০ প্রজাতিই উপকূলবর্তী এলাকার। তথ্য মতে, ১৫, ২০ কিংবা ৩০ বছর আগে বাংলাদেশে যে ধরনের মাছ পাওয়া যেত, বর্তমানে তার বেশির ভাগই বিলুপ্ত অথবা হুমকির মুখোমুখি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করতে না পারলে আগামী কয়েক বছরে অন্যগুলোও বিলুপ্ত হবে।
কৃষিতে বিরূপ প্রভাব : বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক হিসাবে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষি খাতের অবদান প্রায় ৫৫ শতাংশ এবং গ্রামীণ জনপদের প্রায় ৫৪ শতাংশ মানুষ কৃষি পেশায় নিয়োজিত। কিন্তু সাম্প্রতিক দশকগুলোতে দেশের কৃষি বৈরী জলবায়ুর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি জলবায়ু ও আবহাওয়ার স্বাভাবিক অবস্থাকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম একটি নিদর্শন বৃষ্টিপাতের ধরন পাল্টে যাওয়া। এখন আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে তেমন বৃষ্টি হয় না। আশ্বিন মাসে চার-পাঁচ দিন এমন পরিমাণে বৃষ্টি হয়, তাতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। ২০০৮ সালের চেয়ে ২০০৯ সালে ৩২ শতাংশ বৃষ্টিপাত কম হয়েছে। অথচ ২০০৯ সালের ২৭-২৮ জুলাই ২৪ ঘণ্টায় ঢাকায় ৩৩৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। এ বছর আবার বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি হয়েছে। ১৯৭২, ১৯৭৯, ১৯৮৯, ২০০৯ সালে দেশ খরার কবলে পতিত হয়। খরাসহ বিভিন্ন কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দিনে দিনে নিম্নমুখী হয়ে সেচকাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে। ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশে বন্যা হয়। স্বাভাবিক বন্যায় দেশের মোট আয়তনের প্রায় ২০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়। কিন্তু জলবায়ু বৈরী হয়ে ওঠায় সাম্প্রতিক দশকগুলোতে শুধু বন্যার সংখ্যাই বৃদ্ধি পায়নি, এর তীব্রতাও বেড়ে গেছে। ১৯৭০ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত অন্তত ১২ বছর দেশ অস্বাভাবিক বন্যার কবলে পড়েছে। এর মধ্যে ১৯৮৮, ১৯৮৯ ও ২০০৪ সালের বন্যা ছিল প্রলয়ঙ্করী।
স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত বিঘি্নত হওয়ায় দেশটিকে ঘন ঘন বন্যা ও খরার সম্মুখীন হতে হয়। ১৯৭১ সালে বন্যা, ১৯৭২ সালে খরা আবার ১৯৭৪ সালে বন্যায় আক্রান্ত হয় দেশ। ১৯৭৭ ও ১৯৭৯ সালে খরার পর ১৯৮০ ও ১৯৮৪ সালে বন্যা হয়। মাঝখানে আবারও ১৯৮২ সালে খরা দেখা দেয়। এভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেন বাংলাদেশের কৃষির জন্য অবধারিত নিয়তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একসময় এ দেশে কয়েক হাজার প্রজাতির ধান চাষ হতো। বর্তমানে এ সংখ্যা প্রায় ১০০-তে দাঁড়িয়েছে। বন্যার কারণে আউশ ও আমন ধানের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ায় কৃষক সেচনির্ভর বোরো ধানের দিকে ঝুঁকেছে। অন্যদিকে ডাল চাষের জমি কমে গেছে। পাট, গম ও আখের চাষও কমেছে। দক্ষিণাঞ্চলের আমতলীতে পাট, তামাক, গম ও তিল একেবারেই হারিয়ে গেছে। মনোহরপুরে তিসি, তরমুজ, তিল ও খেসারির স্থান দখল করেছে বোরো ধান। জলাবদ্ধতার কারণে আউশ ও আমন ধান ওই অঞ্চল থেকে একেবারেই হারিয়ে গেছে। উত্তরাঞ্চলের উলিপুর থেকে হারিয়ে গেছে কাউন, গম ও পাট।
গত কয়েক বছরে উপর্যুপরি বৈরী জলবায়ুর কবলে পড়ে বাংলাদেশের কৃষি যেভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে, তাতে এ আশঙ্কা দৃঢ়মূল হচ্ছে যে, ভবিষ্যতে দেশের কৃষি বৈরী জলবায়ুর সবচেয়ে বড় শিকারে পরিণত হতে যাচ্ছে। ২০০৯ সালের ৭ অক্টোবর ঢাকায় কৃষি মন্ত্রণালয় ও বিশ্বখাদ্য সংস্থা আয়োজিত যৌথ সম্মেলনে বিশেষজ্ঞরা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দেশের কৃষি ও মৎস্য খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এ কারণে ২০৫০ সাল নাগাদ দেশে ফসলের উৎপাদন ১৫ থেকে ১৭ শতাংশ হ্রাস পাবে।
নারীরা ঝুঁকিতে : জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে কম সম্পদ আছে যার, সেই ভুক্তভোগী হবে সবচেয়ে বেশি; বিশেষ করে নারীর ওপরই এর প্রভাব বেশি পড়বে। দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড পপুলেশনের মতে, বিশ্বের ১.৫ বিলিয়ন দরিদ্র নারী জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য ভুক্তভোগীদের তালিকার সামনের সারিতে রয়েছে। প্রাকৃতিকভাবে বিপর্যস্ত এলাকায় নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা বেড়ে যায়। ধর্ষণ, যৌন হয়রানিসহ নানা ধরনের মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হয় নারীকে। বিপর্যয়-পরবর্তী অবস্থায় ঘরে ও শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতেও নারীরা সহিংসতার শিকার হয়।

No comments

Powered by Blogger.