তিস্তার বিনিময়মূল্য ট্রানজিট নয়! by মনোয়ার রুবেল

তিস্তা চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের দৌড়ঝাঁপ যথেষ্ট বিব্রতকর।  প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার সর্বশেষ দুটি বিদেশ সফরের পর মালদ্বীপে সার্ক শীর্ষ সম্মেলনেও বাংলাদেশের লবিং চোখে পড়ার মতো দৃষ্টিকটু। তার চাইতেও লজ্জাকর মমতা ব্যানার্জির কাছে তিস্তা চুক্তির জন্য লবিং করা। মমতার মন গলাতে যৌথভাবে ভারত সরকার ও বাংলাদেশের সরকার কসরত করছে।

নিঃসন্দেহে, মনমোহনের বাংলাদেশের সফরে তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় আওয়ামীলীগ তথা সরকার চরম বিব্রত। সরকার এটিকে প্রেস্টিজ ইস্যু হিসেবে নিয়েছে। ভাবছে, এটাই ভাবমূর্তি উদ্ধারের একমাত্র উপায়। তাই নানামুখি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যেকোনও মূল্যে যত শিগগির সম্ভব তিস্তা চুক্তি করে জনগণকে দেখিয়ে দেওয়ার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করছি আমরা। সত্যি বলতে কি, তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিল মানুষ। এর প্রধান কারণ ট্রানজিট। ট্রানজিট  নিয়ে যথেষ্ট সচেতন না হওয়ায় চরম দোলাচলে ছিল মানুষজন। বিরোধীদল মাঝে মাঝে ট্রানজিটবিরোধী বক্তব্য রেখেছিল। তারা ইচ্ছে করলে জনগণকে একটি আন্দোলনের দিকে নিয়ে যেত পারতো। যদিও বিএনপি মনমোহনকে আশ্বস্ত করেছে  ট্রানজিটে তাদের আপত্তি নেই। বিএনপি এর আগে ট্রানজিটবিরোধী প্রচারণায় দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে বলে অভিযোগ করে। চরম সন্দেহবাদী বাঙালি সেটা বিশ্বাসও করে। ফলে সরকারের এই সিদ্ধান্তে সাধারণ মানুষ প্রচণ্ড বিরক্ত হয়। বিএনপি কোনও কালেই জনমুখি আন্দোলন করতে পারেনি বলে এই সুযোগটিও কাজে লাগাতে পারেনি। হতে পারে তারা জনমত বুঝতেও পারেনি। তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় বাংলাদেশ সরকার ট্রানজিট চুক্তি স্থগিত করলে জন সাধারণ হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। কেউ কিঞ্চিৎ প্রশান্তিকর সুখও লাভ করে দুই ওষ্ঠ প্রশস্ত করেছেন। তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় মানুষ যতটা না দুঃখ পেয়েছে, তড়িঘড়ি  ট্রানজিট দেওয়ার অতি উৎসাহ থেকে সরকার সরে আসায় ততটাই সুখকর অনুভূতি তারা লাভ করেছে।

তবে তিস্তা চুক্তির বিনিময়মূল্য ট্রানজিট হতে পারে না। হওয়া উচিতও নয়। আন্তর্জাতিক নদীশাসনের নিয়মে  ভারত আমাদের তিস্তার পানি দিতে বাধ্য। কিন্ত আমরা তাদের ট্রানজিট দিতে বাধ্য নই। ট্রানজিট দেওয়ার বা না দেওয়ার ব্যাপারটি শুধু বাংলাদেশের আন্তরিকতা আর  উদারতার উপর নির্ভর করে। ট্রানজিট হবে ভারতের জন্য বাংলাদেশের মানুষের উপহার। বাংলাদেশ ট্রানজিট না দিলে ভারত স্নায়ুদ্বন্দ্ব তৈরি করা ছাড়া কিছুই করতে পারে না। ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের  কাছে ভারতের ট্রানজিটের জন্য ধরনা দেওয়ার কথা ছিল। ভারতের সাথে দরকষাকষির জন্য ট্রানজিট মোক্ষম হাতিয়ার ছিল। কিন্ত আমাদের ভুল কূটনীতির কারণে উল্টো বাংলাদেশ ট্রানজিট দেবে মর্মে প্রতিজ্ঞা করার পরও তিস্তার চুক্তি নিয়ে লবিং করতে হচ্ছে। আমাদের সিটি মেয়রের সাথে তুলনীয় ভারতের রাজ্য সরকারের কাছে আমাদের সরকারকে যেতে হচ্ছে। হাতে পায়ে ধরতে হচ্ছে। এটা দুঃখজনক।

আগেই বলেছি ভারত আমাদের পানি দিতে বাধ্য। আলোচনা হবে কতটুকু দেবে তা নিয়ে। তিস্তার পানি বন্টন নিয়ে ভারতের দাবি সবসময়ই শিশুসুলভ, হাস্যকর । ২০১০ সালে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার তিস্তা নিয়ে একটি খসড়া তৈরি করে। খসড়ায় রাজ্য সরকারের সেচ দপ্তরের মন্ত্রী সুভাষ লস্কর লিখেছেন- `যেহেতু বাংলাদেশ ঘনিষ্ঠ বন্ধুদেশ, তাই শুকনো মৌসুমে তিস্তার পানির ২৫ শতাংশ বাংলাদেশকে দিলেও রাজ্যের কোনও ক্ষতি নেই। যদিও বাংলাদেশ ৫০:৫০ অনুপাতে পানি দাবি করে আসছিল। সর্বশেষ খসড়ায় ভারত তা কমিয়ে বাংলাদেশের ভাগে রেখেছে ১৭%। গত কিছুদিন আগে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তার ট্রানজিট বিষয়ে মন্তব্য আরো বেশি কৌতুককর। তিনি বলেছেন, -`ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশ নৌকা ভাড়া বাবদ প্রতিবছর বহু টাকা আয় করতে পারবে”। তারা আমাদের শুল্ক না দিয়ে ৫-১০ টাকা নৌকাভাড়া দিতে আগ্রহী ! বুঝুন অবস্থা ! ভারতের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাদের অবস্থান সঠিক। এখানে ভারতের কাছ থেকে আমাদের শিক্ষণীয়, স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বন্ধুত্ব ভুলে দরকষাকষির ভিত্তিতে নিজেদের অবস্থান দাঁড় করাতে হয়। ট্রানজিট বিষয়ে বন্ধুত্ব ভুলে শক্ত অবস্থানে দাঁড়াতে হবে। ইজ্জত বাঁচানোর তাড়নায় তাড়াহুড়া করে যাচ্ছেতাই একটি তিস্তা চুক্তি আমরা চাচ্ছি না। `তিস্তার পানির বিনিময়ে ট্রানজিট` তত্ত্বও ঠিক নয়।


মনোয়ার রুবেল
একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ও ব্লগার।
monowarrubel@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.