সৃজনে ও মননে ঋদ্ধ by মাসুদ করিম

জ ১৫ নভেম্বর কবি-লোকসাহিত্য গবেষক প্রফেসর মযহারুল ইসলামের অষ্টম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯২৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর বর্তমান সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুরের চর নবীপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি এই বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ছাত্রজীবন থেকেই সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৫৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।


তার দুই বছর পরেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের প্রধান হিসেবে যোগদান করেন বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী ও জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ইচ্ছা অনুসারে ১৯৫৬ সালের গোড়ার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষকতা ছেড়ে মযহারুল ইসলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। ষাটের দশকে আমেরিকার ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেট ডিগ্রি সম্পন্ন করার পর ড. ইসলাম ১৯৬৩ সালে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। ১৯৬৪ সালে আবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়ে ১৯৬৫ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালে প্রফেসর ইসলাম আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বিভাগে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আমন্ত্রিত হন। বিশ্বের বহু দেশে লোকসাহিত্য বিষয়ে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে পড়িয়েছেন তিনি। লিখেছেন ১০টি কাব্যগ্রন্থ, গল্প-উপন্যাস, প্রবন্ধ, গবেষণাসহ বহু গ্রন্থ। সৃজনশীলতা আর মননশীলতায় ঋদ্ধ ছিল তার চেতনা। ১৯৭১ সালে প্রফেসর ইসলাম মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে ৯ মাস যুদ্ধ করেছেন অস্ত্র এবং কলম হাতে নিয়ে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাকে বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছা অনুসারে বাংলা একাডেমীর প্রথম মহাপরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু তাকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে নিয়োগ দেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে সপরিবারে হত্যার পর মযহারুল ইসলামের ওপর নেমে আসে চরম দুর্যোগ। তিনি 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব' নামে এক হাজার পৃষ্ঠার যে গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন, সেটি তার জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। রাজনৈতিক রোষানলের শিকার হয়ে ১৯৭৫ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর কারারুদ্ধ হন। ৩৩ মাস তিনি কারাগারে বন্দি জীবনযাপন করেন। বিশ্ব সাহিত্যসভায় অত্যন্ত জনপ্রিয় ড. মযহারুল ইসলাম পরিবার-পরিজন ছেড়ে বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি অধ্যাপকের দায়িত্ব পালন করেন। বাল্য এবং কৈশোরে যে সমাজের মধ্যে তিনি বিচরণ করেছেন, পরবর্তীকালে যান্ত্রিক জীবনের মধ্যে থেকেও তিনি গ্রামীণ সমাজ এবং জীবনকে ভুলতে পারেননি। তার কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ এবং গবেষণায়ও গ্রামীণ জীবন এবং প্রকৃতির জীবন্তরূপ দিয়েছেন। তার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ মাটির ফসল (১৯৫৫), দুঃসময়ের ছড়া (১৯৮৯), কাব্যবিচিত্রা (১৯৯৮) সে পরিচয়ই বহন করে। গবেষণা গ্রন্থের মধ্যে কবি পাগলা কানাই (১৯৫৯), ফোকলোর পরিচিতি ও পঠন-পাঠন (১৯৬৮) আজও বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল সম্পদ।
১৯৮৭ সালের যাত্রালগ্ন থেকেই মযহারুল ইসলাম জাতীয় কবিতা পরিষদের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি আমি জাতীয় কবিতা পরিষদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হই। কবিতা পরিষদকে আজকের অবস্থানে নিয়ে আসার পেছনে এবং একাধিকবার ভাঙনের হাত থেকে রক্ষায় ভূমিকা রেখেছেন তিনি তার যোগ্য নেতৃত্বে। দূর থেকে তা উপলব্ধি করেছি। নিজেকে বড়ই সৌভাগ্যবান ভাবি এ জন্য যে, এই বরেণ্য সাহিত্যিক-শিক্ষাবিদ ১৯৭৮ সাল থেকেই আমার আত্মীয়ে
পরিণত হন।
তার প্রতিটি মৃত্যুবার্ষিকী অনেকটা নীরবে-নিভৃতে চলে যায়। আজ তার অষ্টম মৃত্যুবার্ষিকী। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোও হয়তো যথারীতি থাকবে নীরব। পত্রপত্রিকায় তাকে নিয়ে তেমন লেখালেখি হয় না। আমার বিশ্বাস, সাংস্কৃতিক বলয়ে যারা কাজ করে যাচ্ছেন, তারা প্রয়াত মযহারুল ইসলামের অবদানের কথা নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরবেন। নতুন প্রজন্ম জানতে পারবে ব্যক্তি মযহারুল ইসলাম এবং তার সমৃদ্ধ সাহিত্য ভাণ্ডারের পরিচয়। তার অষ্টম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা নিবেদন করি।

No comments

Powered by Blogger.