গাজার মানুষের সমস্যার সমাধান কোন পথে-মধ্যপ্রাচ্য by ফারহাদ হুসাইন

মুদ্রতীরে একটি জাল পাতা, এতে একটি পাখি আটকে রয়েছে। দুটি অবুঝ শিশু পাখিটির দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে। এই শিকার করা পাখি বিক্রি করেই শিশু দুটির বাবা তাদের মুখে আহার তুলে দেবেন। ওরা কি জানে ওদের জীবনও এই পাখিটির মতো বন্দিত্ববরণ করে আছে? ফিলিস্তিনের এক বঞ্চিত জনপদ গাজার একটি খণ্ডচিত্র এটি। অর্থনৈতিক দুর্দশার বিপর্যস্ত এই মানুষগুলোর দোষ, তারা ফিলিস্তিনি এবং হামাস নিয়ন্ত্রিত এলাকার মানুষ।


ইসরায়েলি দখলদারিত্ব তাদের পশ্চিম তীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার দিন শুরু, তবে গাজার মানুষ বোধহয় সেই পরিণতি একটু বেশিই ভোগ করছে।
স্বাভাবিকভাবেই গাজা নিয়ে বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ উদ্বিগ্ন। তারা গাজাকে সাহায্য করতে উদ্যোগ নিতে তৎপর হয়। কিন্তু ইসরায়েলি বাধা বারবার সেই উদ্যোগে ভাটা দিয়ে বিশ্ববিবেককে তাড়িত করছে। যেমন গাজার ওপর থেকে অবরোধ অবসানের প্রত্যয়ে 'ফ্রি গাজা মুভমেন্ট' নামে ইউরোপীয় একটি আন্দোলন 'ফ্রিডম ফ্লোটিলা' নামের ত্রাণবাহী নৌবহরে করে গাজার মানুষের উদ্দেশ্যে সাহায্য নিয়ে রওনা হয়। এ বহরে ছয়টি জাহাজে ৩৮টি দেশের ৬৮৬ জন মানবাধিকার কর্মী ছিলেন। তারা অবরুদ্ধ গাজাবাসীর জন্য প্রায় ১০ হাজার টন মানবিক সাহায্য নিয়ে যাচ্ছিলেন। আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমায় এ বহরে ২০১০ সালের ৩১ মে ইসরায়েলি কমান্ডো হামলায় অন্তত ২০ জন মানবাধিকার কর্মী নিহত হন এবং ৩৬ জন আহত হন। নিহতদের বেশিরভাগই তুরস্কের নাগরিক। আন্তর্জাতিক পানি সীমার ৪০ মাইল ভেতরে ইসরায়েল এ হামলা চালায়। এতে বিশ্বব্যাপী তীব্র নিন্দা এবং ক্ষোভ প্রকাশ শুরু হয়ে যায়। এরপর বিশ্ববাসীর চাপে নতি স্বীকার করে নিরাপত্তা বিষয়ক ইসরায়েলি মন্ত্রিসভা গত বছরের ১৭ জুন গাজায় স্থল অবরোধ কিছুটা শিথিল করার সিদ্ধান্ত নেয়, তবু অবরোধ পুরোপুরি প্রত্যাহার করা হয়নি।
ইসরায়েলি অবরোধ ফিলিস্তিনিদের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলছে তা সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, ইসরায়েলি দখলদারিত্বের ফলে মাত্র ১ বছরে ফিলিস্তিনের আর্থিক ক্ষতি ৬০৯ কোটি মার্কিন ডলার, যা মোট দেশজ উৎপাদনের ৮৫ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় গাজা। এটি প্রকাশ করেছে যৌথভাবে ফিলিস্তিনের অর্থ মন্ত্রণালয় এবং অ্যাপ্লায়েড রিসার্চ ইনস্টিটিউট জেরুজালেম থিঙ্কট্যাঙ্ক। তাতে আরও বলা হয়, ইসরায়েলি দখলদারিত্বের কারণে এগোতে পারছে না ফিলিস্তিনের অর্থনীতি। ফলে বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভর করেই বেঁচে থাকতে হচ্ছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজায় ইসরায়েলের অবরোধ, পানি ব্যবহারে সীমাবদ্ধতা ও প্রাকৃতিক সম্পদ পাওয়ার ক্ষেত্রে বাধাসহ আরও কিছু কারণে ফিলিস্তিনের অর্থনীতি রুদ্ধ হয়ে আছে। বলা হয়, অমানবিক এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে ফিলিস্তিনের অর্থনীতিকে দমিয়ে রাখা না হলে তাদের অর্থনীতি বর্তমানের পরিধির দ্বিগুণ হতো। প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজায় ইসরায়েলের দীর্ঘ অবরোধের মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনের অর্থনীতি সর্বাধিক ক্ষতির স্বীকার হয়। গাজায় প্রথম অবরোধ আরোপ করা হয় ২০০৬ সালে। অবরোধের আগে গাজায় প্রবৃদ্ধি ছিল পশ্চিম তীরের (ফিলিস্তিনের আরেকটি অংশ, যা ফাতাহ শাসিত) সমান; কিন্তু অবরোধের পর থেকে গাজার অর্থনীতি দ্রুত নিম্নমুখী হতে থাকে। এরপর ২০০৮-০৯ সালে ইসরায়েলি অপারেশন 'কাস্ট লিড' যুদ্ধের ফলে তা আরও খারাপ হতে থাকে। ধারণা করা হয়, গাজার ওপর এমন আঘাত না হলে দুই অংশের অর্থনীতিই সমানগতিতে এগোত। এতে ২০১০ সালে দেশটির রাজস্ব কমে যায় ১.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ফিলিস্তিনের ৩ মাসের জিডিপির সমান। ফিলিস্তিনিদের দ্বিতীয় ক্ষতির কারণ হলো তাদের প্রয়োজনীয় পানি ব্যবহার করতে না দেওয়া। 'অসলো চুক্তি' অনুযায়ী ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে যে তিনটি প্রধান জলাধার রয়েছে তা থেকে ফিলিস্তিন পাবে এক-চতুর্থাংশ। বাকিটুকু যাবে ইসরায়েলে, কিন্তু বাস্তবে বেশিরভাগ পানিই ইসরায়েল নিয়ে যায়। ফিলিস্তিন হিস্যার অনেক কম পায়। ফলে ফিলিস্তিনে মিঠা পানি হয়ে ওঠে দুষ্প্রাপ্য। এতে কৃষিসহ অন্যান্য উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অনেক ফিলিস্তিনিকে বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত অর্থ দিয়ে ইসরায়েল থেকে পানি আমদানি করতে হচ্ছে। বিশুদ্ধ পানির অভাবে রোগ ছড়াচ্ছে, পানির অভাবে ২০১০ সালে ফিলিস্তিদের ক্ষতি হয় ১.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
গাজা তথা ফিলিস্তিনের সার্বিক পরিস্থিতি এখন এমনি ভয়াবহ। এত কিছু করেও কি ইসরায়েলের খুব বেশি লাভ হয়েছে? তারা কি খুব বেশি নিরাপত্তা দিতে পেরেছে তাদের নাগরিকদের হামাসের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে? হামাসের অস্তিত্বকে অস্বীকার করার উপায় ইসরায়েলের নেই_ এটাই সত্য। অন্যদিকে ইসরায়েলের অস্তিত্বও এখন আরেকটি বাস্তবতা। সুতরাং পারস্পরিক সমঝোতা ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। 'দুই রাষ্ট্র ফর্মুলা' মেনে নেওয়ার সময় এখন হয়ে গেছে। এ জন্য ইসরায়েলকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। অতি সম্প্রতি ইসরায়েল হামাসের সঙ্গে গোপন বন্দিবিনিময় চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এর ফলে হামাসের হাতে বন্দি ইসরায়েলি সার্জেন্ট গিলাদ সালিত মুক্তি পাবে। যাকে হামাস ২০০৬ সালের ২৫ জুন ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘর্ষের সময় আটক করেছিল। বিনিময়ে ইসরায়েল ২৭ জন নারীসহ মোট ১০২৭ ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দেবে। এই চুক্তি ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিন উভয় জায়গাতেই সমাদর পেয়েছে। উভয় অঞ্চলের জনগণই একে সাধুবাদ জানিয়েছে। অর্থাৎ সাধারণ জনগণ যে শান্তি চায়, তা এ চুক্তির প্রতিক্রিয়াতেই বোঝা যায়। ইসরায়েলি এবং ফিলিস্তিনি নেতাদের বিষয়টি বোঝা এবং শান্তির পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। পারস্পরিক বিশ্বাসের জায়গা এখনও হারিয়ে যায়নি। গত সেপ্টেম্বরে ফিলিস্তিনের জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি চেয়ে আবেদন যে ইসরায়েলি প্রত্যাখ্যানের কবলে পড়ে তা ইসরায়েলকে আরেকবার বিবেচনা করা উচিত। বিভিন্ন কারণে এখন সম্ভব না হলেও কিছু দিনের মধ্যে ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নেওয়া, ইসরায়েলি অস্তিত্ব ও নিরাপত্তার খাতিরেই প্রয়োজন। তার আগে ইহুদি বসতি সম্প্রসারণ তাদের অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। কারণ ফিলিস্তিনিদের পক্ষে অন্য সবকিছু সহ্য করা গেলেও এই বসতি সম্প্রসারণ যে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়, তা ইসরায়েলি নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে। একইভাবে ইসরায়েলকে পাশ কাটিয়ে ফিলিস্তিনও এককভাবে বিশেষ কোনো সুবিধা অর্জন করতে পারবে বলে মনে করার কারণ নেই। পশ্চিমা বিশ্ব তা কোনো দিনই হতে দেবে না, জঙ্গি তৎপরতা থেকে হামাস তথা ফিলিস্তিনিদের সরে আসতে হবে। তাদের বুঝতে হবে এভাবে শান্তি ফিরিয়ে আনা কোনোদিন সম্ভব নয়। প্রয়োজনে 'আপাতত' স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবি থেকে সরে আসতে হবে তাদের। তবে বাস্তবতা বলে যে, ফিলিস্তিনিদের কাজ করার সামান্য ক্ষেত্রই এখানে বিরাজ করছে।
তৃতীয় পক্ষ যে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারবে না তা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব এ ব্যাপারে ব্যর্থতার স্বাক্ষর রেখেছে। নতুনভাবে উদ্যোগ নেওয়া 'কোয়াট্রেট' (চারপক্ষ_ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘ) যে এ ব্যাপারে তেমন সফলতা লাভ করবে না তা অতীত অভিজ্ঞতা থেকে ধারণা করা যায়। যদিও তারা ২০১২ সালের মধ্যেই একটি সমাধান খুঁজে বের করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। বাস্তবতার নিরিখেই ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিন নেতৃবৃন্দকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং খুঁজে বের করতে হবে গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথ। মধ্যপ্রাচ্যের অশান্ত পরিবেশ প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সারাবিশ্বকেই উদ্বিগ্ন করে রেখেছে। এখানে শান্তি আনয়ন পৃথিবীর সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারে।

ফারহাদ হুসাইন : শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
 

No comments

Powered by Blogger.