সহজ-সরল-দরিদ্র মহেষের খোলা চিঠি কে আর পোস্ট করবে? by কনকচাঁপা

. ভূপেন হাজারিকা। একটি প্রতিবাদী মানুষ, যিনি তাঁর সংগীত, কবিতা ও পরিপূর্ণ জীবন দিয়ে এই অসমতায় ভরা পৃথিবীতে জীবনভর প্রতিবাদ করেছেন। কিন্তু তাঁর প্রতিবাদের হাতিয়ার ছিল ভালোবাসা। সারাজীবন কথা বলেছেন কোনায় কোনায় পড়ে থাকা অসহায় মানুষের অসহায়ত্ব নিয়ে। তাঁর প্রতিবাদী ঋজুতার কারণে তাঁকে জেলেও যেতে হয়েছে। কিন্তু তাতে তিনি দমে যাননি এক মুহূর্তের জন্যও।


১৯২৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ অধ্যুষিত ভারতের আসামে সাদিয়া নামক গ্রামে জন্মেছিলেন এই বিস্ময় মানব। জীবনের সুললিত পদচারণে যাঁকে অতিমানব বলা যায়_কিন্তু তিনি ছিলেন অতিসাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশাকে পৃথিবীতে গানে গানে ছড়িয়ে দেওয়ার বাহক। একনিবিষ্ট ধ্যানমগ্ন প্রতিবাদের 'সাধক'। মাত্র ১২ বছর বয়সে ১৯৩৯ সালে আসামের দ্বিতীয় ছবি ইন্দ্রমালতিতে গায়ক হিসেবে জায়গা করে নেন। পড়ালেখায় তুখোড় এই মানুষটি ১৯৪৬ সালে পলিটিক্যাল সায়েন্সে এমএ করেন এবং পিএইচডি করেন কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৫২ সালে। দৃঢ়চেতা এই মানুষটির কণ্ঠ আর মেঘের বজ্রনিনাদকে আলাদা করার কোনো উপায় ছিল না। অদ্ভুত শক্তিশালী কণ্ঠ ছিল তাঁর। মেঘ থমথম করে_কিছু নেই, গানটি শুনলে মেঘের শক্তি ও সমুদ্রের বিশালতার সঙ্গে এই কোলাহলপূর্ণ পৃথিবীতে মানুষের একাকিত্ব অনুভব হয় নিমিষেই। তাঁকে বলা হয় কবিতার সুরকার। কঠিন কঠিন কবিতা তাঁর সুরারোপিত গানে সহজেই সুললিত রূপ ধারণ করে মানুষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ত। তিনি আসামে ও সমগ্র ভারতে যেমন জনপ্রিয় ছিলেন, তেমনি ছিলেন আমাদের বাংলাদেশেও। দীর্ঘ এই কণ্টকাকীর্ণ জীবনযাত্রায় তিনি বিভিন্ন আঞ্চলিক সংগীতকে সারা পৃথিবীর গান হিসেবে রূপদান করে সমসাময়িক করে তুলেছেন। মানুষের দুঃখ-কষ্টগুলোকে শিল্পের মধ্যে ভালোবাসা দিয়ে মাখিয়ে ইথারের মতো কোনায় কোনায় ছড়িয়ে দিয়েছেন নিমিষেই। তাঁর সব গানকে তিনি অহমিয়া-হিন্দি-বাংলা ও ইংরেজিতে গেয়ে সব মানুষের বোঝার জন্য, সহজ করার জন্য কঠিন পরিশ্রম করে গেছেন। ২০০১ সালে ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার পদ্মভূষণ, ২০০৯ সালে আসাম রত্ন, প্রথম ভারতীয় সংগীত পরিচালক হিসেবে 'এশিয়া প্যাসিফিক আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব' পুরস্কার জিতে নেন ১৯৯৩ সালে। অল আসাম স্টুডেন্ট ইউনিয়ন তাঁর প্রমাণ সাইজ মূর্তি গড়ে গুয়াহাটিতে। এগুলো তো তাঁর প্রাপ্তির কথা। কিন্তু আমরা? আমরা তাঁর গানে গানেই জেনেছি মানুষ যদি পশু হয়, তবে মানুষ তো মানুষই, পশুও লজ্জা পায়_অতএব মানুষ হয়ে মানুষের উপকারে আসাই মানুষের প্রধান ধর্ম। এ সর্বজনস্বীকৃত কথা তাঁর মতো করে আমাদের আর কে বলেছে? মানুষের জন্য কাঁদতে কাঁদতে দৃষ্টি যখন লবণাক্ত হয়ে গিয়েছে, অসহায়ভাবে তখন তিনি কেঁদে উঠেছেন 'ও মালিক_সারা জীবন কাঁদালে আমায়, এবার মেঘ করে দাও' গেয়ে। স্রষ্টাকে কোনো নির্দিষ্ট নামে ডেকে সাম্প্রদায়িকতায় না গিয়ে মালিক বলে সম্বোধন করেছেন। এখানেই তাঁর সর্বজনীনতা-সমকালীন হয়ে যাওয়া। কিংবদন্তি শিল্পী লতা মুঙ্গেশকর যখন গান 'রঙিলা বাঁশিতে কে বাজায়' তখন মনে হয় স্বর্গীয় আমেজ বুঝি একেই বলে। 'জোছনার রাতি-পিছু টানে স্মৃতি'_এ গান সেই চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত কোনো ঘন গ্রামের কথা মনে করিয়ে দেয়। তাঁর দেখা গ্রাম নয়_শ্রোতার কল্পচিত্রে তাঁর নিজস্ব গ্রাম ভেসে ওঠে। তাঁর সৃষ্টিতে তিনি প্রেম, প্রকৃতি, অধিকার, সমতা, অন্যায় সবকিছুকে এক সুতোয় গেঁথে দিয়েছেন অসম্ভব ভালোবাসায় ও দৃঢ়তায়। সুললিত দোলা, ছন্দ ও দৃঢ়তা একই রেখায় সরলীকরণ, এত সোজা নয়! সেই কঠিন কাজটি করেছেন অতিশয় দক্ষতার সঙ্গে, যা সহজে এক জীবনে পাওয়া যায় না। শরৎবাবুর মহেষ গল্পটি এমনি মানুষকে, মানুষের বাম অলিন্দকে দ্রবীভূত করে দেয়_সেই শরৎচন্দ্রকে তিনি খোলা চিঠি দিয়েছেন, বলেছেন সেই গফুর-আমিনা এখনো তেমনি দরিদ্র, মহেষের অবলা চোখে একমুঠো খড়ের অপ্রাপ্তিতে এখনো অশ্রু ঝরে। আহা, এমন প্রাণ, এমন ভালোবাসাময় প্রাণ কোথায় পাব? সারা পৃথিবীতেই শোষক রাজাদের অন্যায় শাসনের বিরুদ্ধে দরিদ্র মানুষের হয়ে কথা বলা এই গায়ক_আর কি পাব? তিনি যে চলে গেলেন অজানা কোন দেশে! সেখানে অন্যায়-অবিচার আছে কি না জানি না, থাকলে হয়তো সেখানেও প্রতিবাদ শুরু করবেন-বলবেন_নিস্তব্ধ নীরব স্রোতধারা, এত অন্যায় দেখেও তুমি এত অবিচল বইছ কেন? প্রতিবাদী কণ্ঠ কখনো তার জায়গা থেকে সরে দাঁড়ায় না। তিনি শারীরিকভাবে নেই, কিন্তু তাঁর গান, কবিতা, ছবি, প্রতিবাদ, ভালোবাসা, কণ্ঠমাধুর্য_সবকিছুই আমাদের পাশে পাশে ঘুরছে। আমরা সবাই কি তাঁর বলে যাওয়া কথাগুলো শুনতে পাচ্ছি?
লেখক : সংগীতশিল্পী

No comments

Powered by Blogger.