শেয়ারবাজারে টানা দরপতন এসইসির সামনে বিক্ষোভ-৫ হাজারের নিচে নামল সূচক

টানা দরপতনে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন বিনিয়োগকারীরা। গত দু'দিনের দরপতনে শেয়ারবাজার সূচক নেমে এসেছে ৪৮৭৭ পয়েন্টে, যা গত ২২ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে গত বছরের ১৭ জানুয়ারি সূচক ৪৮৭৬ পয়েন্ট ছিল। বিক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীরা গতকাল সোমবারও রাজধানীতে ডিএসই ও এসইসি কার্যালয়ের সামনের রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন।


এ সময় দুই বিনিয়োগকারী নিজেদের শার্টে আগুন লাগিয়ে প্রতিবাদ জানান। বিক্ষোভকারীরা অর্থমন্ত্রী, অর্থ উপদেষ্টা, গভর্নর ও ডিএসইর সভাপতিসহ সরকারের পদত্যাগ দাবি করেন। বিক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীরা হুমকি দিয়েছেন, দরপতন রোধে কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে বিরোধী দলের ডাকা সরকার পতনের আন্দোলনে সমর্থন জানাবেন তারা। এছাড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করে সাময়িকভাবে লেনদেন বন্ধ করে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা। এর আগে দুপুর সাড়ে ১২টায় দিলকুশার এসইসি কার্যালয় ঘেরাও করার চেষ্টা করা হলেও পুলিশের বাধার মুখে তা ব্যর্থ হয়। শেষ পর্যন্ত এসইসি কার্যালয়ের নিচে অবস্থান ধর্মঘট পালন করেন তারা। ঈদের ছুটির পর বাজার পরিস্থিতির উন্নতি হবে_ এমন আশাও ভেস্তে গেছে। গত বছরের ৬ ডিসেম্বর থেকে শেয়ারবাজারে অস্বাভাবিক দরপতন শুরু হয়।
এ সময়ে বিভিন্ন পর্যায় থেকে দরপতন রোধে নানা উদ্যোগের ঘোষণা দেওয়া হলেও অধিকাংশ উদ্যোগই কার্যকর হয়নি। ফলে দরপতন ক্রমেই ত্বরান্বিত হয়েছে। গত বছরের নভেম্বরে ডিএসইতে দৈনিক গড়ে যেখানে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছিল, বর্তমানে তা মাত্র আড়াইশ' কোটি টাকায় নেমে এসেছে। এ সময়ে বাজার মূল্যসূচক ৮৯১৮ পয়েন্ট থেকে গতকাল ৪৮৭৭ পয়েন্টে নেমে এসেছে। শুরু থেকে দরপতন রোধে ব্যর্থতার জন্য ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে সরকার।
অব্যাহত দরপতনের কোনো কারণ ব্যাখ্যা করতে পারছেন না শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ, বিশ্লেষক ও সংশ্লিষ্টরা। অনেকে বর্তমানের দরপতনের জন্য ব্যাংকগুলোকে দায়ী করেছেন। ২০ অক্টোবর ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীরা শেয়ারবাজারে ব্যাংকগুলোর ফের বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিলেও তারা পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করেনি। এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে তীব্র হতাশা বিরাজ করছে। বর্তমান দরপতনের এটাকেই প্রধান কারণ বলে মনে করছেন তারা।
বিক্ষোভ : প্রতিদিনই নিজেদের সর্বস্ব হারাতে দেখে প্রচণ্ড বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। গতকালও ব্যাপক দরপতনের মধ্য দিয়ে দিনের লেনদেন শুরু হলে ঢাকার মতিঝিলে ডিএসই কার্যালয়ের সামনের রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করা হয়। ফলে দুপুর পৌনে ১২টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ইত্তেফাক মোড় থেকে শাপলা চত্বর পর্যন্ত কোনো যান চলাচল করতে পারেনি। পরিস্থিতি মোকাবেলায় ডিএসই ও এসইসি কার্যালয়ের সামনে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন ছিল। এক পর্যায়ে বিনিয়োগকারীরা ব্রোকারেজ হাউসগুলোতে লেনদেন বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করেন। আমাদের বগুড়া ব্যুরো জানিয়েছে, সেখানকার বিক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীরা লেনদেন বর্জন করে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছেন।
ঢাকায় বিক্ষোভে বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজানুর রশীদ চৌধুরী সরকারের সমালোচনা করে বলেন, প্রায় এক বছর ধরে শেয়ারবাজারে দরপতন চললেও সরকার তা বন্ধে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি। তিনি প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেন, 'আমাদের পুঁজি রক্ষায় কেউ এগিয়ে না এলে আমরা বিরোধী দলের সরকার পতনের আন্দোলনে সমর্থন দেব।' প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও ব্যাংকগুলো বিনিয়োগে না ফেরায় সমালোচনা করে তারা বলেন, ব্যাংকগুলোকে বিনিয়োগে ফেরাতে বাধ্য করতে হবে।
বিশ্লেষকদের মন্তব্য : বাজার বিশেষজ্ঞ, বিশ্লেষক ও সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, টানা দরপতনের কোনো ব্যাখ্যাই তাদের কাছে নেই। প্রায় এক বছর ধরে চলতে থাকা অস্থিরতা কমাতে সরকার ও দায়িত্বশীলরা যথেষ্ট আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেনি বলে অভিযোগ করেছেন তারা। এসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, 'বাজারে প্রতিদিনই দরপতন হচ্ছে কেন, তার কোনো উত্তর আমার জানা নেই।' তবে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দায় দেশের শেয়ারবাজারে কোনো প্রভাব নেই জানিয়ে তিনি বলেন, 'দেশীয় অর্থনীতি এখন নাজুক অবস্থায়। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিসহ ব্যাংকের সুদের হার অনেক বেশি। এছাড়া ব্যাংকগুলো থেকে সরকারের ঋণের প্রভাব শেয়ারবাজারে থাকতে পারে।'
এসইসির প্রেস ব্রিফিং : ফোর্স সেল বন্ধ করাসহ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বাজারের স্থিতিশীলতার স্বার্থে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়েছে শেয়ারবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসি। গতকাল বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা শেষে সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোঃ সাইফুর রহমান এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানান, অনেক বিনিয়োগকারী ফোর্স সেলের অভিযোগ নিয়ে আসছেন। আমরা সংশ্লিষ্ট ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংককে ফোর্স সেল বন্ধ করার অনুরোধ জানিয়েছি। অনুরোধ উপেক্ষা করা হলে পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি। সাইফুর রহমান বলেন, তারল্য সংকট বাজারের প্রধান সমস্যা_ বলছেন কেউ কেউ। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করলে এ সংকট মোকাবেলা সম্ভব। তিনি আরও জানান, ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগে ফেরার বিষয়ে আলোচনার জন্য ১৬ নভেম্বর অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এদিকে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) নবনির্বাচিত পরিষদ গতকাল বিকেল সাড়ে ৩টায় এক বৈঠকে মিলিত হয়। তারা বাজারের বর্তমান অবস্থা মোকাবেলায় তাদের করণীয় নির্ধারণ নিয়ে আলোচনা করেন।
দরপতন রোধে উদ্যোগ : দরপতন রোধে গতকাল প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের বিনিয়োগকারীরা বেশ সক্রিয় ছিল বলে জানিয়েছে শেয়ারবাজারের নির্ভরযোগ্য সূত্র। বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন এবিবি থেকে ব্যাংকগুলোকে শেয়ার ক্রয়ে অনুরোধ জানানো হয়। সংগঠনটির সভাপতি ও দি সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে মাহমুদ সাত্তার সমকালকে বলেন, 'আমরা চেষ্টা করছি নানাবিধ সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বিনিয়োগ বাড়ানোর।' গতকাল বেশ কিছু ব্যাংক উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে বলে দাবি করেন তিনি। এদিকে শেয়ারবাজার সূত্র নিশ্চিত করেছে, গতকালের লেনদেনে ব্যাংকগুলোর নিজস্ব পোর্টফোলিও বিনিয়োগ ছিল ১৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা, যা গতকালের মোট লেনদেনের মাত্র সাড়ে ৪ শতাংশ। এছাড়া মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো থেকেও বড় ধরনের বিনিয়োগ করা হয়েছে। ফলে দিনের শুরুতে সূচক ২৩৮ পয়েন্ট কমলেও শেষ পর্যন্ত ১৬৪ পয়েন্ট পতন দিয়ে দিনের লেনদেন শেষ হয়।
বাজার পরিস্থিতি : টানা নয় দিনের ছুটির পর রোববার শেয়ারবাজারের লেনদেন শুরু হলে প্রথম দিনে ডিএসইতে প্রায় কোম্পানিই শেয়ার দর হারায়। এতে সূচক কমেছিল প্রায় ১৬৭ পয়েন্ট। গতকাল সোমবারও ব্যাপক দরপতন দিয়ে দিনের লেনদেন শুরু হয়।

No comments

Powered by Blogger.