ইয়াবা’র অর্থনৈতিক ছোবলঃ কিয়াটের কাছে মার খাচ্ছে টাকা by ফজলুল কাদের চৌধুরী

প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের মুদ্রা কিয়াটের কাছে মার খাচ্ছে বাংলাদেশের টাকা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে স্রোতের মতো মাদক ট্যাবলেট ইয়াবা পাচার হওয়ার পরোক্ষ প্রভাবেই টাকার মূল্যমান ক্রমশঃ নিম্নগামী হচ্ছে। কারণ, ইয়াবার বিনিময়ে কোটি টাকার বাংলাদেশি মুদ্রা হুন্ডির মাধ্যমে চলে যাচ্ছে মিয়ানমারে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বাংলানিউজকে জানায়, অবৈধ পন্থায় আমাদানি করা নিষিদ্ধ মাদক ইয়াবার মূল্য অনেক সময় টাকা ছাড়াও ডলারসহ অন্যান্য বিদেশি মুদরায়ও পরিশোধ করতে হয়। অর্থাৎ মুদ্রার সঙ্গে সঙ্গে বিপুল পরিমাণে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রাও চলে যাচ্ছে মিয়ানমারে।

ইয়াবার বিনিময়ে বাংলাদেশি মুদ্রা মিয়ানমারে পাচার হওয়ার কুপ্রভাব বিশ্লেষণ করতে গিয়ে টেকনাফের এক ব্যবসায়ী জানান, গত ফ্রেরুয়ারির হিসেবে বাংলাদেশি ১ টাকার বিনিময়ে মিয়ানমারের ১৮ টাকা (কিয়াট) পাওয়া যেতো। বর্তমানে পাওয়া যাচ্ছে ৯.৬০ কিয়াট। অর্থাৎ মাত্র ৮ মাসের ব্যবধানে কিয়াটের কাছে বাংলাদেশি টাকার মান প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে।

মাদক ছাড়া মিয়ানমারের সাথে অন্যসব ব্যবসা বন্ধ হয়ে যেতে পারে

বাংলাদেশ-মিয়ানমার বর্ডার ট্রেডের সভাপতি ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি দিদার হোসাইন বাংলানিউজকে বলেন, ‘মিয়ানমারের  কিয়াটের সঙ্গে টাকার বিনিময় অনুপাত টাকায় ১৮  থেকে সাড়ে ৯ কিয়াটে নেমে এসেছে। এর ফলে মিয়ানমার থেকে ব্যবসায়ীরা এখন বৈধ ব্যবসা করতে চাচ্ছে না। প্রায় সবাই ইয়াবা পাচারে লিপ্ত। চোরাপথে ইয়াবা আনতে গিয়ে সাধারণ ব্যাবসার টাকা পাচার করতে গিয়ে মিয়ানমারে চলে যাচ্ছে। এ কারণে টাকার মূল্য কমে গেছে।’

তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন মালামলের ওপর বাংলাদেশি অনেক ব্যবসায়ীর কোটি কোটি টাকা মিয়ানমারে অগ্রিম দেওয়া রয়েছে। সেগুলো আগের রেটে। বর্তমানে টাকার মূল্যমান কমে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা পথে বসার উপক্রম হয়েছে।’

কারণ, মিয়ানমারের ব্যবসায়ীরা আগের রেটে মালামাল দিতে চাচ্ছে না।

তিনি বলেন, ‘এ অবস্থা চলতে থাকলে মাদক ছাড়া মিয়ানমারের সাথে অন্যসব ব্যবসা বন্ধ হয়ে যেতে পারে।’

সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট সমিতির সাধারন সম্পাদক এহতেশামূল হক বাংলানিউজকে বলেন, “মিয়ানমার সীমান্তের প্রায় একশ’ দশ কিলোমিটার জুড়ে ইয়াবা পাচার চলছে। স্রোতের মত ইয়বা আসছে টাকা চলে যাচ্ছে। চাল, মসল্লা মাছসহ মিয়ানমার থেকে একটি বাণিজ্যিক জাহাজে প্রায় ১ কোটি টাকার মালামাল টেকনাফ আসে। চালের বস্তায়, মাছের পেটে ইয়াবা আসছে বলে খবর পাওয়া যায়। তাছাড়া নৌকায়, ষ্পিডবোটে, অন্যান্য জাহাজে করেও ইয়াবা আসছে বলে জানতে পেরেছি।”

এহতেশামুল হক বেলেন, ‘একটি ইয়াবার দাম মাঠ পর্যায়ে ২৫০ টাকা। এটা প্যারাসিটামল ট্যাবলেটের মতোই। যেকোনও প্রকারে একটি প্যাকেট আনতে পারলেই এককোটি টাকা আয় করা যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যা ধরে তা খুবই সামান্য। বেশিরভাগ ইয়াবা মার্কেটে চলে যায়।’

তিনি বলেন, ‘এটা বন্ধ করতে না পারলে এর ছোবলে যুবসমাজ তো ধ্বংস হবেই, তবে তার আগে আমাদের অর্থনীতিতে মারাত্মক বিপর্যয় নেমে আসবে।’

গত ১২ নভেম্বর কক্সবাজার জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অ্যাড. সাহারা খাতুনের উপস্থিতে পেশকৃত গত সেপ্টেম্বরের সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর গত সেপ্টেম্বর মাসে ২৮টি অভিযানের মাধ্যমে ৫৯ লাখ টাকার মাদকদ্রব্য উদ্ধার  করেছে। গত আগস্ট মাসে ২৫টি অভিযানের মাধ্যমে ২লাখ ৬৯হাজার টাকা মূল্যমানের মাদকদ্রব্য উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া জেলা টাস্কফোর্স গত সেপ্টেম্বরে ৯টি অভিযানে ২৫হাজার ও আগস্ট মাসে ১০টি অভিযানে ৪২ হাজার টাকার মাদকদ্রব্য উদ্ধার করে। এসব মাদকদ্রব্যের  সিংহভাগ ছিলো ইয়াবা।

দু’দিকেই ইয়াবা কাটছে

ইয়াবার ব্যাপারে ৪২ বিজিবি’র মেজর সামশুজ্জামান মো. আরিফ-উল- ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ‘ইয়াবা দু’দিকেই কাটছে। এটা যুব সমাজকে শেষ করে দিচ্ছে আবার অর্থনীতিকেও।’

তিনি বলেন, ‘বিজিবি ইয়াবার বিরুদ্ধে সদা তৎপর। ইয়াবা নিয়ে আমরা জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছি। ১৭ বিজিবি অধিনায়ক লে. কর্নেল খালেকুজ্জামান বলেন, ‘ইয়াবা বন্ধ করার জন্য বিজিবি সর্বাত্মক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। পুলিশসহ যৌথ বাহিনী এ ব্যাপারে চিরুনি অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আশা করছি শিঘ্রই পরিস্থিতির উন্নতি হবে।’

মিয়ানমারের সাথে সীমান্ত বাণিজ্য ব্যবসায়ী নুরুল কামাল বাংলানিউজকে বলেন, ‘মিয়ানমারে ইয়াবা নিষিদ্ধ। সেখানে যদিও বিভিন্ন মাদকদ্রব্য  খোলাবাজারে বিক্রি হয়। কিন্ত ইয়াবা নয়। ইয়াবা শুধু বাংলাদেশে পাচার করা হয়। এ ব্যাপারে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী পাচারকারিদের সাহায্য করে। এ পর্যন্ত কোনও ইয়াবা পাচারকারিকে তারা গ্রেপ্তার করেছে বলে শোনা যায়নি।’

No comments

Powered by Blogger.