ভিন্নমত-জনগণকে বেশি ওষুধ খাওয়ানো হচ্ছে by আবু আহমেদ

মার কাছে মনে হয়, দেশে হাসপাতাল, ডাক্তারি প্র্যাকটিস, ক্লিনিক্যালসেবা ইত্যাদি মোটেই রেগুলেট হচ্ছে না। স্বাস্থ্য ও ওষুধ খাতে হযবরল অবস্থা। জনগণ কোন হাসপাতাল, কোন ডাক্তারের কাছে এবং কোন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা করার জন্য যাবে, সেসব ক্ষেত্রে সব সময় দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকে। একজন ভালো ডাক্তার পাওয়ার জন্য তাদের যে ব্যাকুলতা, তা ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বললেই বোঝা যায়।

তবে আমার পরিচিত এক জুনিয়র ডাক্তার বললেন, ভালো ডাক্তার মানে বিখ্যাত ডাক্তার নয়। তাঁর মতে, আজকাল অন্য কায়দায় বিখ্যাত হওয়ার জন্য অনেক ডাক্তার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। তবে আমার কাছে ভালো ডাক্তার তিনি, যিনি রোগীর কথা শোনার জন্য সময় দেন এবং রোগ সঠিকভাবে নির্ণয় করে কম বা নূ্যনতম ওষুধ দেন। আজকে অনেক হাসপাতাল হয়েছে ব্যক্তি খাতে। তবে আমাদের অর্থনীতিশাস্ত্র বলে, ব্যক্তি খাতে কোনো সেবাসংস্থা গড়ে উঠলে সেটা সরকার কর্তৃক নিয়োজিত কোনো স্বাধীন কমিশন বা সংস্থা দ্বারা রেগুলেট বা দেখভাল করা হয়, যাতে সেসব হাসপাতাল-ক্লিনিক আগে থেকে বেঁধে দেওয়া একটা মান বজায় রাখে। কিন্তু বাংলাদেশে কোন সংস্থা ওষুধ কম্পানি-হাসপাতাল এবং ডাক্তারি প্র্যাকটিসকে রেগুলেট করছে?
রেগুলেশনের ব্যাপারটা ডাক্তারি জগতে অচেনা থাকতে পারে; কিন্তু সরকারের ব্যুরোক্রেসি ও প্রশাসন তো এত দিনে এসব জানার কথা। বিশ্বের কোথাও এত সহজে প্রেসক্রিপশন লেখার লাইসেন্স পায় কি? আজকে অনেক ডাক্তার অধ্যাপক টাইটেল লিখছেন। কিন্তু জনগণের কাছে একটা সন্দেহ দানা বেঁধেছে ওই সব টাইটেল স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রদান করা হচ্ছে কি না। আজ তো ব্যক্তি খাতে অনেক মেডিক্যাল কলেজ স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু সেগুলোতে কী পড়ানো হচ্ছে, কারা পড়াচ্ছেন_এ ব্যাপারে কোন সংস্থা দেখাশোনা করছে? মেডিক্যাল ডিগ্রি এত সহজ করা হলে দেশের স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি হবে কী অবনতি হবে তা ভেবে দেখা দরকার। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে কেউ কেউ অর্থের বিনিময়ে সার্টিফিকেট বিক্রি করছে বা বিক্রি করার তুল্য কিছু একটা করছে। মেডিক্যাল ডিগ্রির ক্ষেত্রে তেমনটি যদি ঘটে, তাহলে সমাজের কী উপায় হবে ভেবে দেখুন।
কোনো কোনো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় বা সংস্থা এখন দেশি-বিদেশি চযউ ডিগ্রিও বিক্রি করছে। মেডিক্যাল ডিগ্রিগুলোর ক্ষেত্রে যে এত এমডি, এমফিল, পিএইচডি দেওয়া হচ্ছে, ওগুলোর মানের অবস্থা কী? মানুষ জানেই না, এসব ডিগ্রির উৎস কী। সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা হলো, ওষুধ কম্পানির ওষুধের ধরন ও মান নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে। গত ১০ বছরে কয়েক ডজন নতুন ফার্মাসিউটিক্যাল কম্পানি ফ্যাক্টরি স্থাপন করে অতি জোরালোভাবে ওষুধ বিক্রি করা শুরু করেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মফস্বলের ডাক্তার ও রোগীরা হলো ওই সব ওষুধ কম্পানির টার্গেট। তবে ঢাকা শহরেও ওষুধ বিক্রেতাদের অবস্থান দেখে আশ্চর্য হতে হয়। এক দিন একটি সরকারি হাসপাতালের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। দেখলাম, কয়েক ডজন মোটরসাইকেল হাসপাতালের গা ঘেঁষে পার্কিং করা আছে। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, ওগুলো ফার্মা কম্পানির সেলস প্রতিনিধিদের সাইকেল। শোনা মতে, ৩০ হাজার সেলস প্রতিনিধি ওষুধ নিয়ে ডাক্তারদের পেছনে দৌড়াচ্ছেন এবং অনেক ডাক্তার প্রথমবারের মতো ওই সব কম্পানির নতুন ওষুধ রোগীর ওপর ব্যবহার করার ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। এত সহজে ওষুধ বিপণন বিশ্বের অন্য কোথাও ঘটে বলে আমাদের জানা নেই।
বেসরকারি হাসপাতালগুলো রোগীদের থেকে গলাকাটা মূল্য নিচ্ছে, সেখানে যেমন রেগুলেট করার কেউ নেই। আধা সরকারি ও সরকারি হাসপাতালগুলোতেও সেই প্র্যাকটিস ভিন্নভাবে চলছে। একবার আমার এক প্রতিবেশীকে একটি আধা সরকারি হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করালাম। রোগী ১৪ তলায়, প্যাথলজিক্যাল টেস্ট দুই-তিন তলায়। তাঁর আত্মীয়দের সে কী উৎকণ্ঠা। সংশ্লিষ্ট ডাক্তার হুকুম করছেন_সে মতো সব প্যাথলজিক্যাল টেস্টই করানো হলো। কিন্তু ওই রোগীর আত্মীয়রা পরে যা বললেন তা হলো_ওইসব রিপোর্টের দিকে কনসালট্যান্ট ডাক্তার ফিরেও তাকাননি। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পাঁচ দিন লেগেছে। অর্ধ লাখ টাকার একটি বিল রোগীকে শোধ করতে হয়েছে। কিন্তু তাদের দুঃখ হলো_রিলিজ করার সময় ডাক্তার সাহেব লিখে দিলেন দুটি ইনসুলিনের কথা, যেগুলো শুধু বিদেশি কম্পানিগুলোই উৎপাদন করে এবং ওগুলোর একটি বিপণন করে বাংলাদেশে অবস্থিত একটি নামকরা আন্তর্জাতিক ওষুধ কম্পানির সাবসিডিয়ারি, অন্যটি করে বাংলাদেশি এক প্রাইভেট বিপণন কম্পানি। প্রতিবছরই ওই ইনসুলিনগুলোর মূল্য বৃদ্ধি করা হচ্ছে এবং রোগীকে ওগুলো ব্যবহারে বাধ্য করা হচ্ছে। এই যে এত মূল্যমানের ইনসুলিন রোগীকে প্রেসক্রাইব করা হলো, সে ক্ষেত্রে তার আর্থিক সামর্থ্য কি একবারও দেখা হলো?
বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক প্রাণ গোপাল আফসোস করে বলেছেন, দেশেই সমজাতীয় ওষুধ থাকতে একশ্রেণীর ডাক্তারের প্রবণতা হলো বিদেশি কম্পানির ওষুধ প্রেসক্রাইব করা। অ্যান্টিবায়োটিকের অতিপ্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ সম্বন্ধে আমরা অনেক কথা শুনি। কিন্তু আমার দেখা মতে, অন্যান্য ওষুধেরও অতিপ্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ হচ্ছে। ওইসব দেখার জন্য কোনো কমিশন বা অথরিটি নেই। এত খোলামেলা ওষুধের বিপণন ও দোকান এবং এত সহজে প্রেসক্রিপশন-লভ্যতা বিশ্বের অন্য কোথাও নেই। যুক্তরাষ্ট্র থেকে একটি ভিটামিন এই দেশেও আসে। গায়ে লেখা আছে_এই ভিটামিনের ব্যাপারে যা বলা হয়েছে, সে ব্যাপারে তাদের রেগুলেটর ঋউঅ-এর কোনো দায়িত্ব নেই। আমাদের এখানেও কয়েক শ কোটি টাকার ভিটামিন বাণিজ্য হচ্ছে; কিন্তু ওগুলোর গুণ-অগুণের ব্যাপারে কারো কোনো সনদ নেই। শুধুই বলা আছে, অনেক অনেক উপকার! দেশ গরিব তো বটে, দেশের মানুষ আরো গরিব। কিন্তু সেই গরিব দেশে এত ওষুধ সেবন কেন একবার ভেবে দেখুন।
ওষুধের দোকানে গিয়ে বসুন। দেখবেন, লোকে হরদম গ্যাসের ওষুধ, জ্বরের ওষুধ, সর্দি-কাশির ওষুধ চেয়ে চেয়ে দোকানি থেকে নিচ্ছে। দোকানের যে ছেলেটি ওষুধের দোকানে চাকরি করছে মাত্র ছয় মাস, তাকেই জিজ্ঞেস করা হয় ওই ওই রোগের জন্য কী ওষুধ খেতে হবে। সেও অবলীলায় বলে দিচ্ছে এবং শেলফ থেকে নামিয়ে ওই ওই ওষুধ কথিত রোগীর হাতে তুলে দিচ্ছে। আমাদের এক সিনিয়র অধ্যাপক অনেক রোগে যে ওষুধ লাগে না তা নিয়ে অনেক লিখেছেন। কিন্তু আফসোস হলো, জনস্বার্থে কোথায় ওষুধ লাগবে, কোথায় লাগবে না, সে ব্যাপারে কোনো প্রচার নেই। বাংলাদেশে ওষুধের ব্যবসা হলো একটি অতি লাভজনক ব্যবসা। কেন এত লাভের এই ব্যবসা সবাইকে ভেবে দেখতে বলব।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.