সিরিয়ায় সাম্রাজ্যবাদের নতুন চক্রান্ত-সমকালীন প্রসঙ্গ by বদরুদ্দীন উমর

তিউনিসিয়া ও মিসরে আরব বসন্ত বা অৎধন ঝঢ়ৎরহম নামে যে অভ্যুত্থানকে আখ্যায়িত করা হয়েছে লিবিয়া ও সিরিয়ায় যা ঘটেছে ও ঘটছে সেটা সে ধরনের কোনো অভ্যুত্থান যে নয়, তা এই দুই দেশের সাম্প্রতিক ও চলমান ঘটনাবলি থেকেই দেখা যাচ্ছে। তিউনিসিয়া ও মিসরে জনগণ নিজেরাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল এবং সেই অভ্যুত্থানের শক্তির জোরে অল্প কিছুদিনের মধ্যে এ দুই দেশে দীর্ঘদিন স্থায়ী স্বৈরশাসনের অবসান হয়েছিল।
এমনভাবে জনগণ এ দুই দেশেই অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল ও তাতে নিজেরাই নেতৃত্ব দিয়েছিল, যাতে আমেরিকা ও ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদীরা এবং সৌদি আরব, কাতার ইত্যাদি মধ্যপ্রাচ্যে তাদের পদানত রাষ্ট্রগুলোর পক্ষে তাদের বিরুদ্ধে কোনো চক্রান্ত করা সম্ভব হয়নি। তাদের হস্তক্ষেপের কোনো সুযোগই সেখানে থাকেনি।
প্রায় কাছাকাছি সময়ে বাহরাইন ও ইয়েমেনে বিদ্যমান স্বৈরতন্ত্রী শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হলে সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের পরই তাদের দ্বিতীয় নির্ভরশীল দেশ ও খুঁটি সৌদি আরবের মাধ্যমে এ দুই দেশের শাসকদের রক্ষার জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে। বাহরাইনে সৌদি আরব সব আন্তর্জাতিক রীতিনীতি ভঙ্গ করে সরাসরি নিজের সামরিক বাহিনী পাঠিয়ে সেখানে বিদ্রোহ দমন করেছে। ইয়েমেনের শাসককে একইভাবে সাহায্য করে তারা তাকে এখনও পর্যন্ত টিকিয়ে রেখেছে। ইয়েমেনের এই শাসক প্রতিদিন বিদ্রোহীদের গুলি করে হত্যা করলেও গণতন্ত্রের ধারক-বাহক ও গণতন্ত্রের পাহারাদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য কোনো আওয়াজ দিচ্ছে না। উপরন্তু সৌদি আরবকে দিয়ে তারা ইয়েমেনের বর্তমান শাসককে সব রকম সাহায্য-সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে।
এসব দিক দিয়ে লিবিয়া ও সিরিয়ার পরিস্থিতি অন্য রকম। তিউনিসিয়া ও মিসরের অভ্যুত্থানের পর লিবিয়ায় বেনগাজিভিত্তিক একটি গ্রুপের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গাদ্দাফির বিরুদ্ধে একটা অভ্যুত্থানের চেষ্টা করে। কিন্তু সে অভ্যুত্থান কয়েক দিনের মধ্যেই স্তিমিত হয়ে পড়ায় গাদ্দাফি নিজের দেশের জনগণকে বড় আকারে হত্যা করছেন, এই অজুহাত তুলে জাতিসংঘকে দিয়ে লিবিয়ায় হড় ভষু ুড়হব প্রস্তাব পাস করিয়ে লিবিয়ার ওপর ন্যাটোর বিমান হামলার ব্যবস্থা করে। হড় ভষু ুড়হব-এর প্রস্তাব পাস হওয়ার পর গাদ্দাফি সেই প্রস্তাব মেনে চলার ঘোষণা দিয়ে লিবিয়ার কোনো বিমানকে আর আকাশে ওড়াননি। কিন্তু তা সত্ত্বেও ন্যাটোর বিমানবাহিনী সেই থেকে লিবিয়ায় বিরামহীনভাবে বোমাবর্ষণ করে এসেছে। ন্যাটোর বিমানবাহিনীকে লিবিয়ায় তাদের বিমান ওড়াল বন্ধের জন্য কিছুই করতে হয়নি। কারণ সেখানে কোনো সরকারি বিমান আকাশে ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা লিবিয়ার বিমান ঘাঁটিগুলোতে ভারী বোমাবর্ষণ করে সেগুলো সম্পূর্ণ ধ্বংস করেছে। কোনো আকাশযুদ্ধ না করে তারা লিবিয়ায় গাদ্দাফির সেনাবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালিয়েছে এবং বেপরোয়াভাবে বোমাবর্ষণ করে মাস ধরে হাজার হাজার লিবিয়াবাসীকে হত্যা করেছে। গাদ্দাফির গণহত্যার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক পদক্ষেপের কথা বলে যারা জাতিসংঘকে দিয়ে লিবিয়ায় সামরিক আক্রমণের লাইসেন্স জোগাড় করেছিল তারা যে প্রথম থেকেই লিবিয়া দখলের জন্য তাদের চক্রান্ত কার্যকর করছিল এতে কারও সন্দেহ ছিল না। এমনকি তাদের নিজেদের লোকেরাও এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ ছিল।
লিবিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থিত বেনগাজিভিত্তিক গ্রুপটির যেমন সারা লিবিয়ায় কোনো গণসমর্থন ছিল না, তেমনি তাদের কোনো সামরিক বাহিনীও ছিল না, যদিও সেখানে অভ্যুত্থান ব্যর্থতার পর তারা যুদ্ধের পথই বেছে নিয়েছিল। কিছু ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লোকজনকে অর্থ, অস্ত্র ও ট্রেনিং দিয়ে তারা এক তথাকথিত সামরিক বাহিনী বেনগাজিতে খাড়া করেছিল, যাকে তারা নিজেরাই আখ্যায়িত করেছিল ৎধম ঃধম বাহিনী হিসেবে। এ বাহিনীর কোনো ক্ষমতাই ছিল না গাদ্দাফি বাহিনীর বিরুদ্ধে জয়লাভের। তাদের পক্ষে যা অসম্ভব ছিল সেটাই সম্ভব হয়েছিল ন্যাটোভুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও ব্রিটেনের মতো দেশের শক্তিশালী বিমানবাহিনীর দৈনন্দিন বিমান হামলা ও বোমাবর্ষণের দ্বারা, তারা লিবিয়ায় সবসুদ্ধ ৬০ হাজারবার হামলা করেছিল। সেই হামলার বিরুদ্ধে কোনো দেশের সামরিক স্থল বাহিনীই নিজেকে রক্ষা করতে পারে না। লিবিয়াও পারেনি এবং শেষ পর্যন্ত সেখানে গাদ্দাফির পতন ঘটিয়ে ও তাকে হত্যা করে লিবিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ন্যাটো সাম্রাজ্যবাদীদের দখল কায়েম হয়েছে। এই দখলদাররা লিবিয়ায় এক 'গণতান্ত্রিক' সরকার প্রতিষ্ঠা করে তাকে স্বীকৃতি প্রদান করেছে। এই 'গণতান্ত্রিক' সরকার প্রতিষ্ঠার সঙ্গে তিউনিসিয়া ও মিসরের পরিস্থিতির যে কোনো সাদৃশ্যই নেই এটা বলাবাহুল্য।
এখানে বিশেষভাবে বলা দরকার যে, ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো লিবিয়ায় যে বিমান দস্যুতা করেছে এবং যেভাবে লিবিয়া দখল করেছে জাতিসংঘের ১৯৭৫ নম্বর প্রস্তাবের সীমা সম্পূর্ণ লঙ্ঘন করে সে বিষয়ে জাতিসংঘ ও তার মহাসচিব বান কি মুন একটি বাক্যও উচ্চারণ করেননি। উপরন্তু তারা গাদ্দাফির বিরুদ্ধেই বিষোদ্গার করে ন্যাটো সাম্রাজ্যবাদীদের দস্যুসুলভ হামলাকেই সমর্থন করেছেন। জাতিসংঘ এমন যে কত খোলাখুলিভাবে সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা তাদের স্বার্থে ব্যবহৃত হচ্ছে লিবিয়ায় তাদের ভূমিকা এরই এক প্রমাণসিদ্ধ দৃষ্টান্ত।
লিবিয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের ইউরোপীয় মিত্ররা এখন সিরিয়ায় একই খেলা বেশ খোলাখুলিভাবেই শুরু করেছে। লিবিয়ায় যেমন তারা দীর্ঘদিন ধরে গঠিত ও প্রতিপালিত তাদের বেনগাজিভিত্তিক চক্রটির মাধ্যমে কাজ করেছিল সিরিয়ায় সেভাবে তা করতে পারেনি। সেটা শুরু করেছিল মধ্যপ্রাচ্যে তাদের হুকুমবরদার সৌদি আরবকে দিয়ে। সৌদি আরব সিরিয়ায় অর্থ ও অস্ত্রের জোগান দিয়ে বাসার আল আসাদের বিরুদ্ধে এক বিদ্রোহের সূচনা করেছিল। বাসার একজন স্বৈরতান্ত্রিক শাসক হওয়া সত্ত্বেও সৌদি আরব এবং উপসাগরীয় দেশগুলো বা মোবারকের শাসনাধীন মিসরের মতো সাম্রাজ্যবাদের অনুগত এবং দেশের স্বার্থ তাদের কাছে বিলিয়ে দেওয়ার মতো নীতির ওপর দাঁড়িয়ে নেই। তিনি সিরিয়ার জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য শুধু সিরিয়ায় নয়, সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সাম্রাজ্যবাদীদের আগ্রাসী নীতি, তৎপরতা, হামলার প্রতিবাদ ও সমালোচনা করে এসেছেন। সিরিয়ার ভূখণ্ড গোলান হাইটস ১৯৬৭ সাল থেকে ইসরায়েল দখল করে রাখার পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই শক্তির প্রধান জোগানদার হওয়ার কারণে তাদের সঙ্গে সিরিয়ার সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরে খুবই খারাপ। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে বলা দরকার যে, সিরিয়ায় ইসরায়েলি স্বার্থ রক্ষা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি স্বীকৃত নীতি এবং ইসরায়েলের সঙ্গে সিরিয়ার দ্বন্দ্ব ও খারাপ সম্পর্কই সিরিয়ার প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শত্রুতার অন্যতম প্রধান কারণ।
সৌদি আরবকে দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় গণ্ডগোল শুরু করেছিল এবং এখন তারা সৌদি নেতৃত্বাধীন আরব লীগকে সিরিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে। একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসকশ্রেণীর কর্তাব্যক্তিরা সিরিয়ায় লিবিয়ার মতো হড় ভষু ুড়হব প্রবর্তনের চেষ্টা করছে, অন্যদিকে তারা আরব লীগের মধ্যে সৌদি আরব ও কাতারকে দিয়ে সিরিয়ার বিরুদ্ধে অবরোধসহ অন্য ধরনের, এমনকি সামরিক হস্তক্ষেপের চক্রান্তও করছে। কয়েকদিন আগে তারা সিরিয়ার সঙ্গে আলোচনা করে সেখানে প্রশাসনের সংস্কার, সামরিক বাহিনী দ্বারা শক্তি প্রয়োগ ইত্যাদি বিষয়ে কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু একদিকে এই আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট বাসারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ জিইয়ে রাখার চক্রান্ত চালিয়ে তারা যে পরিস্থিতি জারি রেখেছে তাতে দুই পক্ষের দ্বারা গৃহীত সিদ্ধান্ত সিরিয়া কর্তৃক কার্যকর করা অসম্ভব হয়েছে। এই অবস্থায় আরব লীগ এক হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে সিরিয়াকে আরব লীগ থেকে বহিষ্কার করেছে! এভাবে সিরিয়াকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত মূলত সৌদি আরব ও কাতারের চাপে গৃহীত হলেও এর পেছনে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাত আছে এতে সন্দেহের কারণ নেই। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ার বিষয়ে মধ্যপ্রাচ্যে আরবদের মধ্যে কোনো সমঝোতা চায় না। তারা চায় সিরিয়াকে বিচ্ছিন্ন করে জাতিসংঘে তার ওপর লিবিয়ার মতো হড় ভষু ুড়হব কার্যকর করে দেশটি দখল করতে!
সৌদি আরবের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সিরিয়ায় প্রবল প্রতিক্রিয়া ও গণবিক্ষোভ হচ্ছে। সিরিয়ার ব্যাপক জনগণ রাজধানী দামেস্ক এবং অন্যান্য শহরে আরব লীগ কর্তৃক সিরিয়াকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের দাবিতে প্রেসিডেন্ট বাসারের পক্ষে সমাবেশ করেছে। আরব লীগের মধ্যেও এ নিয়ে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিরিয়া বিরোধিতার সঙ্গে যে সিরিয়ার সঙ্গে ইসরায়েলের শত্রুতার সম্পর্ক আছে এ কথা আগেই বলা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি সিরিয়ায় বাসারের পরিবর্তে অন্য কোনো বশংবদ লোককে ক্ষমতাসীন করতে পারে তাহলে সিরিয়াকে গোলান হাইটস ফেরত দেওয়ার কোনো প্রশ্ন আর ইসরায়েলের থাকবে না। তারা সহজেই সিরিয়ার এই ভূখণ্ড ইসরায়েল রাষ্ট্রের অন্তর্গত করে হজম করতে পারবে। এর ফলে লেবাননের বিরুদ্ধে নতুন চক্রান্তেরও সুবিধা তাদের হবে। সিরিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের 'গণতন্ত্র' প্রতিষ্ঠার চেষ্টার এটাই যে গূঢ় তাৎপর্য বা শানে নজুল এতে কোনো সন্দেহ নেই।
সিরিয়ায় এখন পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয় এটাই দেখার বিষয়। তবে তাদের দ্বারা লিবিয়ায় অনুসৃত কৌশল যে সেখানে তারা কার্যকর করতে সক্ষম হবে অথবা সহজে সক্ষম হবে এমন সম্ভাবনা কম। তবে এ ক্ষেত্রে সৌদি আরবের মাধ্যমে তারা তাদের আজ্ঞাবহ আরব লীগকে দিয়ে যে কিছু চাতুর্যপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণের চেষ্টা করবে এতে কোনো সংশয় নেই।
১৪.১১.২০১১

No comments

Powered by Blogger.