ব্যাংক ও হাসপাতালের অসাধু চক্র জড়িত! by সাহাদাত হোসেন পরশ

রাজধানীসহ সারাদেশে জাল মুদ্রা তৈরি করছে কয়েকটি সংঘবদ্ধ চক্র। বাসা ভাড়া নিয়ে ছোট ছোট মেশিনে জাল মুদ্রা তৈরি করে তা সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। জাল মুদ্রা তৈরির কারিগররা ১ লাখ টাকার জাল নোট ৮-১০ হাজার টাকায় একটি গ্রুপের কাছে বিক্রি করে। পরে সেই গ্রুপ অন্য আরেকটি চক্রের কাছে ওই নোট বিক্রি করে দেয়। এভাবে দু'তিন হাতবদল হয়ে ওই টাকা সাধারণ মানুষের হাতে পেঁৗছে।


জাল মুদ্রা বাজারজাতের সঙ্গে ব্যাংক ও হাসপাতালকেন্দ্রিক একটি অসাধু চক্রও জড়িত। মোটা অঙ্কের কমিশনের ভিত্তিতে অসাধু ব্যাংক কর্মকর্তারা জাল মুদ্রা গ্রাহকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে সহায়তা করেন। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ সম্প্রতি রাজধানী ও আশপাশের এলাকায় অভিযান চালিয়ে জাল নোট তৈরি চক্রের সাত সদস্যকে গ্রেফতার করে। এরপর তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে তারা এসব তথ্য জানায়। এদিকে জাল মুদ্রা তৈরি চক্রের নেপথ্যের চার 'বিগ বস'কে খুঁজছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তারা হলো_ পলাশ, আলাউদ্দিন, তোতলা বাবু ও দাঁতভাঙা মামুন। তারা জাল মুদ্রা তৈরিতে সবচেয়ে অভিজ্ঞ কারিগর হিসেবে পরিচিত। তারা অত্যন্ত নিখুঁতভাবে জাল মুদ্রা তৈরি করতে সক্ষম। জানা গেছে, সেকেলে পদ্ধতি নয়, গত ঈদে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জাল মুদ্রা শনাক্তকরণে বিশেষ যন্ত্র কেনে। ১৭ অক্টোবর পুলিশের ত্রৈমাসিক অপরাধ সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ওই সিদ্ধান্তের আলোকে এরই মধ্যে জাল মুদ্রা শনাক্তকরণ যন্ত্র কেনা হয়েছে। এসব যন্ত্র রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন পশুর হাটেও বসিয়েছিল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। রাজধানী ও এর আশপাশ এলাকায় অভিযান চালিয়ে ডিবি জাল মুদ্রা তৈরি চক্রের অন্যতম হোতা হুমায়ুন কবির, আবুল খায়ের, পলাশ, সাইফুল ইসলাম, সুমন, আলাউদ্দিন ও শাহিন আক্তারকে গ্রেফতার করে। ডিবি কর্মকর্তারা জানান, এ চক্রের সদস্যরা পুরান ঢাকার বিভিন্ন দোকান থেকে পাইকারি কাগজ কেনে। এরপর ওই কাগজ রাজধানীর উপকণ্ঠে জাল মুদ্রা তৈরির সঙ্গে জড়িত সিন্ডিকেট সদস্যদের বাসায় নেওয়া হয়। সেখান থেকে জাল টাকা তৈরি করে কমিশনভোগীদের মাধ্যমে বাজারে ছাড়া হয়। অধিকাংশ সময় মেলা, গরুর হাট, পাইকারি পণ্যের বড় বড় মার্কেট, ঈদকে টার্গেট করে থাকে জাল মুদ্রা চক্রের সদস্যরা। বাংলাদেশি মুদ্রা ছাড়াও ডলার, ভারতীয় রুপি ও ইউরো তৈরি করে থাকে চক্রটি। গ্রেফতার হওয়া চক্রটির সদস্যদের কাছ থেকে জাল ৫১ লাখ টাকা, সাড়ে ৩ লাখ ভারতীয় রুপি, ৩০ হাজার মার্কিন ডলার এবং কয়েক কোটি টাকার জাল নোট তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতার হওয়া আলাউদ্দিন জানায়, বছরখানেক আগে সে জাল টাকা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ডিবির হাতে গ্রেফতার হয়েছিল। পরে জামিনে ছাড়া পায়। এরপর আবার শুরু করে জাল টাকার ব্যবসা। সে আরও জানায়, জাল টাকা বাজারজাতে রাজধানীর একটি নামিদামি হাসপাতালের কয়েক কর্মচারীও জড়িত। আলাউদ্দিন আরও জানায়, ১ লাখ টাকার জাল নোট বিক্রি করে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা কমিশন পাওয়া যায়।

জাল নোট তৈরি চক্রের সদস্যরা জানায়, তিনটি ধাপে জাল মুদ্রা তৈরি করা হয়। এমনকি জাল মুদ্রা তৈরি চক্রের দুটি প্রজন্মও রয়েছে। প্রথম প্রজন্মের নেতৃত্বে ছিল নুরুজ্জামান, ছগীর ও রশিদ মাস্টার। আশির দশকে বাজার থেকে ১০০ টাকার নোট নিয়ে কাস্টিং পাউডারমিশ্রিত পানিতে ভেজানো হতো। টাকাটি নরম হলে এরপর সাবানের গুঁড়া দিয়ে ধুয়ে অন্য কাগজে ছাপ দিয়ে নকল টাকা তৈরি করা হতো। বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে জাল টাকা তৈরি করা হয়। পুলিশ সদর দফতরের এআইজি মাহবুবুর রহমান সমকালকে বলেন, জাল মুদ্রা শনাক্তে এরই মধ্যে বেশ কিছু যন্ত্র কেনা হয়েছে।
ডিবির সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান জানান, গ্রেফতার হওয়া চক্রের মধ্যে সাইফুল ইসলাম প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করে। সে এসব জাল টাকার ডিজাইন করে। এ চক্রটির সঙ্গে আন্তর্জাতিক কোনো চক্রের যোগাযোগ রয়েছে কি-না সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এ ছাড়া জাল টাকা তৈরির দেশীয় আরও কয়েকটি চক্রকে গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.