সাংবাদিকতায় ফলোআপ 'অবহেলিত' by আবিদ রহমান

বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমের ক্রমবিকাশের ধারাবাহিকতায় আমি এক বিগতা যৌবন। একদিন আমিও ছিলাম! তবে সেই উপস্হিতি ছিলো ভীড়ের মধ্যে অনায়াসে হারিয়ে যাওয়া অতি সাধারণ নগন্য একজন। অসাধারণ সব শিক্ষক (চিফ রিপোর্টার, বার্তা সম্পাদক ও সম্পাদক) আমার মতো ‘গাধা’ পিটিয়ে ‘মানুষ’ বানাতে ব্যর্থ হয়েছেন। সাহিত্য না সাংবাদিকতা, এই জটিল ধাঁধার জিজ্ঞাসায় কোনোটাই হয়ে ওঠেনি।

ফলাফল অনিবার্যভাবেই নীরব-নিঃশব্দ প্রস্হান সাতাশিতে। অতি সাধারণের ‘মৃত্যু’ কারো হৃদয়ে দাগ কাটে না!  সিফিলিস আক্রান্ত পতিতা ও বেকার সাংবাদিকের কোনো ‘সামাজিক’ চাহিদা থাকে না! পত্রিকা অফিসে থাকা মাত্র দু’তিনটি টেলিফোনের সেই জমানায়ও যেকোনো রিপোর্টের ফলোআপ হতো। জুনিয়ার বা অ্যাপ্রেন্টিস কোনো রিপোর্টার বাসে ঝুলে পায়ে হেঁটে ফলো আপ করতেন। মাসে সর্বোচ্চ আড়াই শ’ টাকা কনভেন্সে রিক্সায় চাপার সামর্থ্য থাকতো কেবল সিনিয়র রিপোর্টারদের। রিপোর্টিং সেকশনের সবেধন নীলমণি টেলিফোনটিও থাকতো সিনিয়রদেরই দখলে। রাত আটটার পর ক্রাইম রিপোর্টার দখল নিতেন সিটি রাউন্ড আপ যোগাড়ে। এতো প্রতিকুলতা সত্ত্বেও ফলোআপ যেতো। এখনো কোনো একটা ঘটনা-দুর্ঘটনা নিয়ে ক`দিন সংবাদ মাধ্যমগুলোতে দারুণ-নিদারুণ মাতামাতি-দাপাদাপি চলে। তারপর একেবারে গায়েব। এধরনের কোনো ঘটনা ঘটেছে এমন কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ-চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় না।

কিছুদিন আগে সংবাদ শিরোনাম হয়েছিলো ভিকারুন্নেসার ধর্ষক-শিক্ষক পরিমল। পরিমলের সাথে আরো অনেক নাম উচ্চারিত হয়েছে মিডিয়ায়। পৃষ্ঠপোষক ও মদদদাতা হিসাবে কয়েকজন শিক্ষকের দিকে সন্দেহের অঙ্গুলি নির্দেশ ছিলো মিডিয়ার। এখন মিডিয়ার কোথাও পরিমল ও তার সঙ্গীসাথীরা নেই। রাজনৈতিক ‘বিবেচনায়’ পরিমলকে ছেড়ে দেওয়া হলেও সাধারণের জানার কোনো উপায় নেই, যদি কোনো সোর্স নিউজটা লিক না করে? ভিকারুন্নেসার বসুন্ধরা শাখার অধ্যক্ষ কী কোনও শাস্তি পেয়েছিলেন? পারসোনার মান-সম্মান ধূলিসাৎ করা নিউজগুলো পড়তে পড়তে কানিজ আলমাসকে ‘খলনায়িকা’জেনেছিলাম। তিনি দোষী না নির্দোষ সেই বিচারের ভার আমার নয়। কিন্তু সেই মামলা ও ঘটনার ফলো আপ দেখি না। কেবল ‘খল নায়িকা’ কানিজকে দেখি টিভির পর্দায় অনুষ্ঠান উপস্হাপনায়। 

রোজার মাসে শক্তিশালী বাজার সিন্ডিকেটের মনোপলি বাণিজ্যের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিল সংবাদমাধ্যমগুলো। সেই সিন্ডিকেট এখনো আছে দোর্দণ্ড প্রতাপে। কেবল  সংবাদমাধ্যমে সিন্ডিকেটের শিকার অসহায় মানুষগুলোর দুর্দশা দেখিনা। হত্যা-গুম-ছিনতাই মাদক সম্রাট-সম্রাজ্ঞীদের রসালো কাহিনী ক`দিন ধরে পাঠকের কৌতূহল জাগিয়ে মেঘনার চরের মতো ডুবে যায়। কারাগারে মাদক সরবরাহকারী জেলারের ভাগ্যে শেষাবধি কি ঘটেছিলো জানতে ইচ্ছে করলেও কোথাও কোনো খবর দেখি না। মন্ত্রী-সাংসদদের নারী-জমি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের কেলেংকারীতে কিছু সংবাদমাধ্যম কিছুদিন দাপাদাপি করলেও পরে নিজ থেকেই অজানা কারণে চুপ মেরে যায়। সংবাদগুলো প্রকাশের কারণকে কোনওভাবেই ‘উদ্দেশ্যহীন’ ভাবতে দিল্ সায় দেয় না। সংবাদ মাধ্যমের কাছে সংবাদের গুরুত্ব বাণিজ্যিক স্বার্থেই। সংবাদের স্বার্থে সংবাদ দেখি না আজকাল। সংবাদ মাধ্যমগুলোর দায়িত্ববোধ নিয়ে সন্দিহান হই মাঝেমধ্যেই।

ইদানিং নরসিংদীর মেয়র লোকমান হত্যাকান্ড নিয়ে সংবাদ মাধ্যমগুলোতে মাতামাতি দেখি। অতীত অভিজ্ঞতার আশংকায় জানি, কয়েকদিনের মধ্যে লোকমানের সংবাদ `নাই` হয়ে যাবে। সাহসী উচ্চারণের ফারজানা নিপার দুঃসাহসিক তালাকের ঘটনায় অভিযুক্তদের পরিণতি কী আমরা সংবাদমাধ্যমে দেখবো? কিংবা সংবাদমাধ্যম কী অনুগ্রহ করে ফারজানা নিপার ব্যক্তিগত জীবনের অগ্রযাত্রা জানাবেন?

আস্হা হয় না। সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতি তীব্র আস্হাহীনতায় ভুগি। পুলিশের ’তদন্তে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে তবে মামলার স্বার্থে কিছু বলা যাচ্ছে না’ বক্তব্যের হিমাগারযাত্রার সাথে সংবাদ মাধ্যমের পার্থক্য খুঁজে পাই না।

সাংবাদিকতার স্বচ্ছতার স্বার্থেই সংবাদমাধ্যমগুলোকে ফলোআপে মনোনিবেশ করতে হবে নিউজ সেন্সের কারণেই। প্রত্যাশায় থাকলাম। অপেক্ষা-প্রতীক্ষায় রইলাম।

ইমেলঃ abid.rahman@ymail.com
Abid Rahman
Melbourne, Australia
Mobile:61.432.333.584

No comments

Powered by Blogger.