পুলিশ সদস্য থেকে জাল টাকার কারবারি হুমায়ুন

দ সামনে রেখে ব্যবসায়ীরা যেমন পণ্য তৈরি ও বিক্রিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তেমনি ওরাও। তবে ওদের পণ্য 'জাল টাকা'। এক লাখ জাল টাকা বিক্রিতে মেলে আসল ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। আর খরচ মাত্র দুই থেকে তিনশ' টাকা। জাল টাকা বিক্রি ও বিপণনে যাতে কোনো ঝামেলায় পড়তে না হয় সে জন্য মাদকদ্রব্যের মতো রেখেছে সাংকেকিত নাম।


একশ' টাকার জাল নোটের সাংকেতিক নাম 'গেঞ্জি', পাঁচশ' টাকা 'পাঞ্জাবি' আর এক হাজার টাকার নোট 'জোব্বা'। এসব জাল টাকা বাজারজাতে রাজধানীর একাধিক নামি হাসপাতালের কতিপয় কর্মচারী জড়িত রয়েছে।
কোরবানি ঈদে তাদের টার্গেট ছিল জাল পাঁচশ' কোটি টাকার মুদ্রা বাজারজাতের। কিন্তু বিধিবাম। তাদেরই এক 'বেইমান' সহকর্মীর সহায়তায় মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ জাল চক্রের কয়েকজনকে গ্রেফতার করে। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্যই দিয়েছে জাল টাকা তৈরির দলনেতা চাকরিচ্যুত পুলিশ কনস্টেবল হুমায়ুন কবির। গত ১৯ অক্টোবর মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সহকারী পুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করেন জাল টাকা প্রস্তুতকারী দলের প্রধান হুমায়ুন কবির, তার সহযোগী আলাউদ্দিন ও শাহীন আক্তার এবং আবুল খায়ের, পলাশ, সাইফুল ইসলাম ও সুমনকে। তাদের কাছ থেকে ডিবি উদ্ধার করে ৫১ লাখ জাল টাকা, সাড়ে ৩ লাখ ভারতীয় জাল রুপি, ৩০ হাজার জাল মার্কিন ডলার এবং কয়েক কোটি টাকার জাল নোট তৈরির সরঞ্জাম। ডিবি পুলিশ তাদের দুই দফায় ৫ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে।
পুলিশ থেকে জাল টাকার কারবারি : ১৯৯৮ সালে অনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য পুলিশ বাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত হয় হুমায়ুন কবির। এরপর সড়ক ও জনপথে ঠিকাদারি ব্যবসা শুরু করে। কিন্তু সেখানে তেমন সুবিধা করতে পারেনি। পরে জড়িয়ে পড়ে জাল টাকার কারবারে। এরপরের কাহিনী হুমায়ুনের মুখ থেকেই শোনা যাক_ টেবিলের ওপর কম্পিউটার প্রিন্টার। কিছুক্ষণ কম্পিউটারের কিবোর্ডে আঙুল চালিয়ে প্রিন্টিং অর্ডার দেয় জামান। সঙ্গে সঙ্গে প্রিন্টার থেকে চকচকে পাঁচশ' টাকার নোট বেরিয়ে আসতে থাকে। এ দৃশ্যটি চার বছর আগে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার একটি ফ্ল্যাটে। এ দৃশ্য দেখেই জাল টাকা তৈরির সিদ্ধান্ত নেয় হুমায়ুন কবির। ২০০৭ সালের শেষের দিকে পরীক্ষামূলকভাবে সে অল্প করে জাল টাকা তৈরি ও বাজারজাত শুরু করে। দু'মাস পরই দিনে-রাতে শুরু করে জাল টাকা তৈরি। জাল টাকা বাজারজাত ও টাকা তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জাম ক্রয়ের জন্য আলাদা লোকও নিয়োগ দেওয়া হয়। এভাবে গত চার বছরে কমপক্ষে ৩০০ কোটি টাকা বাজারজাত করে হুমায়ুন কবির।
যেভাবে এ জগতে প্রবেশ : ২০০৭ সালের শেষের দিকে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সড়ক ও জনপথের অফিসের নিচে একদিন চা-বিস্কুট খাচ্ছিল হুমায়ুন কবির। সেদিন সেখানে জাল টাকা প্রস্তুতকারী চক্রের সদস্য জামানের সঙ্গে তার পরিচয়। একপর্যায়ে তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। একদিন জামানের বাসায় গিয়ে হুমায়ুন কবির দেখে টাকা আর টাকা। জাল টাকা তৈরি করে বিভিন্ন স্থানে বান্ডিলে বান্ডিলে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। কীভাবে জাল টাকা তৈরি করা হয় তাও হুমায়ুন কবিরকে দেখিয়ে দেয় জামান। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি হুমায়ুনকে। জাল টাকা তৈরি ও ব্যবসা করে প্রতিদিন ২০-৩০ হাজার টাকা আয় করে সে। অধিক টাকা উপার্জন করে সে দুটি বিয়েও করেছে। জাল টাকা প্রস্তুত সম্পর্কে হুমায়ুন কবির জানায়, জাল টাকা প্রস্তুতের জন্য বাজার থেকে ভালো মানের নিউজপ্রিন্ট কাগজ ও আসল টাকায় ব্যবহৃত রঙ সগ্রহ করা হয়। আসল টাকা স্ক্যান করে সাদা কাগজের ওপর প্রিন্ট করা হয়। আর রঙের সঙ্গে হালকা গাম ব্যবহার করা হয়। এতে জাল টাকা আসল টাকার মতোই শক্ত হয়ে যায়। প্রিন্টের টাকায় সিকিউরিটি থ্রেডের স্থলে জুতা ও বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত প্লাস্টিক জাতীয় কাগজ লাগানো হয়। তিনি জানান, প্রিন্টের কাজে তার পাশাপাশি আইটি বিশেষজ্ঞ পলাশ সহায়তা করে। জাল টাকা বাজারজাত করে আবুল খায়ের। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান জানান, গ্রেফতারকৃতরা ৫-৬ বছর ধরে জাল টাকা তৈরি করে আসছে। তারা প্রতিদিন গড়ে ৫ লাখের মতো জাল টাকা তৈরি করে। তাদের দেওয়া তথ্য মতে, জাল টাকা তৈরি চক্রের আরও সদস্যের নাম-ঠিকানা পাওয়া গেছে। তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

No comments

Powered by Blogger.