প্রেরণার নাম ফারজানা by একরামুল হক শামীম

০০৩ সালের ঘটনা। নিশা শর্মা নামের ভারতের মধ্যবিত্ত পরিবারের এক মেয়ে বিয়ের আসরেই বিয়ে ভেঙে দেন। মধ্যবিত্ত সমাজে মেয়ে যখন বিয়ে ভেঙে দেয় তখন তা নিয়ে নানা ধরনের কানাঘুষা শুরু হয়। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্রী নিশা শর্মার বিয়ে ঠিক হয়েছিল এক কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে। নিশার বাবা-মা মেয়ের জন্য যোগ্য পাত্র ঠিক করতে পেরে আনন্দিত হয়েছিলেন।


কিন্তু তাদের আনন্দ দুঃখে রূপ নেয় যখন পাত্রপক্ষ ২৫ হাজার রুপি যৌতুক চেয়ে বসে। নিশা শর্মা সঙ্গে সঙ্গে যৌতুকের প্রতিবাদ করেন, যৌতুকলোভী পাত্রকে বিয়ে করবেন না বলে জানিয়ে দেন। এছাড়া পুলিশ ডেকে যৌতুকলোভী পাত্রকে আটক করান। পরে পাত্রপক্ষ নিশা শর্মার নামে নানা ধরনের কুৎসা রটনা শুরু করে। তার অন্য একটা ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল, দুরারোগ্য ব্যাধি আছে_ এই ধরনের নানা কুৎসা। নিশা এতে মানসিকভাবে কষ্ট পেলেও ভেঙে পড়েননি। দীপ্ত উচ্চারণে মিডিয়ার মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছিলেন_ শিক্ষিত হয়ে যদি আমি যৌতুকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করি তাহলে অন্যেরা কীভাবে করবে? মেয়েদের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে বলেছিলেন, যৌতুকের নামে বরপক্ষকে একটা পয়সাও দেবেন না। নিশা শর্মা ভারতে তখন যৌতুকবিরোধী আইকন হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। ৮ বছর পর একই ধরনের ঘটনা ঘটল বাংলাদেশে। ইডেন কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণীসহ স্নাতকোত্তর পাস করা ফারজানার বিয়ে ঠিক হয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হীরণের সঙ্গে। বিয়ের আসরে বরের ফুপু কনেপক্ষের কাছে যৌতুক চান, বর তাতে সায় দেন। যৌতুকের প্রতিবাদে ফারজানা বিয়ের আসরেই বরকে তালাক দিয়েছেন। বিয়ের আসরে বসে যৌতুকের প্রতিবাদ করার মতো কঠিন কাজটিই তিনি করেছেন। এর মাধ্যমে যৌতুকবিরোধী আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ হলো। নিশা শর্মার মতো কুৎসার শিকার তাকেও হতে হচ্ছে এখন। বরপক্ষ বলার চেষ্টা করছে, বিয়ের আসরে তার কানে মোবাইল ছিল, অন্য একটা ছেলের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল। এমনকি ফারজানাকে হেনস্তা করতে বর শওকত আলী হীরণ তার ফেসবুক প্রোফাইলে নোংরা মন্তব্যসহ ফারজানার ছবি ও মোবাইল ফোন নম্বর তুলে দিয়েছেন। তবে সবকিছু ছাপিয়ে মানুষের কাছে ফারজানার প্রতিবাদী রূপটাই উঠে এসেছে। ব্লগ, ফেসবুক এমনকি পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের নিচে থাকা মন্তব্য অংশে মানুষের অজস্র মন্তব্য ফারজানার পক্ষে। বিয়ের আসরেই যৌতুকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় সবাই অভিনন্দন জানিয়েছেন তাকে।
ঘটা করে বিয়ের অনুষ্ঠানটি হয়েছিল ১১.১১.১১ তারিখের সকাল ১১টা ১১ মিনিটে। এমন দিনকে সারাবিশ্বে অনেকেই বিয়ের জন্য বেছে নিয়েছেন। কিন্তু যৌতুকের কারণে ভেঙে গেল বিয়ে। এরই মধ্যে তালাক পাওয়া বর ও তার ফুপুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক। আশা করা যায় তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। যৌতুকের বিরুদ্ধে ফারজানা যে প্রতিবাদ করেছেন তা আরও অনেক মেয়েকে যৌতুকের অভিশাপ থেকে বাঁচিয়ে দেবে। ব্লগার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা ১১ নভেম্বরকে তাই যৌতুকবিরোধী দিবস ঘোষণা করার দাবি করেছেন। যৌতুকবিরোধী প্রতিবাদকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য যৌতুকবিরোধী দিবস পালন জরুরি।
নিশা শর্মার কাহিনী দিয়ে লেখাটি শুরু করেছিলাম, শেষও করি পরবর্তীকালে ঘটে যাওয়া তার জীবনের আরেকটি কাহিনী বর্ণনা করে। নিশার মধ্যবিত্ত পরিবারের আশপাশে থাকা প্রতিবেশীদের অনেকেই মনে করেছিল এই মেয়ের বিয়ে হবে না, মেয়েকে নিয়ে বিপদে পড়বে বাবা-মা। নিশা শর্মা সব বাধার বিরুদ্ধে হেঁটেছেন। নিজের মতো করে কাজ করেছেন। ছয় মাস পর ২০০৩ সালের নভেম্বরে এক সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। প্রতিবেশীদের ধারণা এতে ভুল প্রমাণিত হয়। নিশা শর্মার ঘটনার সঙ্গে ফারজানার ঘটনার অনেক মিল রয়েছে। ফারজানার বিরুদ্ধেও এখন অনেকেই অনেক ধরনের কথা বলছে। আশা করব ফারজানা সব প্রতিকূলতাকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাবেন।

No comments

Powered by Blogger.