১৪ দফা ঢাকা ঘোষণা-অভিন্ন অবস্থানে থেকেই দাবি আদায় করতে হবে

৪ দফা ঢাকা ঘোষণার মধ্য দিয়ে গত সোমবার ঢাকায় শেষ হলো ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) দুই দিনব্যাপী সম্মেলন। এবারের সম্মেলনে ২০টি দেশের প্রতিনিধিরা যোগ দিয়েছিলেন। এ সম্মেলনে যোগ দিতে ঢাকায় এসেছিলেন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন। ঢাকা ঘোষণায় যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে তা হলো, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর অভিন্ন অবস্থান ধরে রাখা।


এটি আজ স্বীকৃত সত্য যে উন্নত বিশ্বের অবিবেচক আচরণ তথা অত্যধিক পরিমাণে কার্বন নিঃসরণের কারণেই বিশ্বব্যাপী জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে। আর তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলো। ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর এ বিশাল ক্ষয়ক্ষতি সামাল দেওয়ার মতো অর্থনৈতিক অবস্থা নেই। তাই কিয়োটো, বালি, কানকুন সম্মেলনসহ সব সম্মেলনেই সরবে উচ্চারিত হয়েছে উন্নত দেশগুলোকে তাদের কার্বন নিঃসরণ কমাতে হবে এবং ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কিন্তু কোনো প্রটোকল, কোনো ঘোষণাই উন্নত বিশ্বের মনোভাব পরিবর্তনে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারেনি। অনেক দেশ এখনো প্রটোকল স্বাক্ষরই করেনি। বরং গত বছর কার্বন নিঃসরিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো বাস্তবে কোনো ক্ষতিপূরণই পাচ্ছে না। বাংলাদেশ ১০ বিলিয়ন ডলার দাবি করলেও এ পর্যন্ত সহায়তা চুক্তি সই হয়েছে মাত্র ১২৫ মিলিয়ন ডলারের। কাজেই উন্নত বিশ্বের এই উদাসীনতার প্রতি অসহায়ের মতো তাকিয়ে না থেকে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে জোর দাবি তুলতে হবে, দুনিয়াব্যাপী মানবতাকে জাগিয়ে তুলতে হবে_ঢাকা ঘোষণায় তারই প্রতিফলন দেখা গেছে।
এর আগে জার্মানওয়াচের গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেঙ্ ২০১০-এ সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় এক নম্বরে দেখানো হয়েছে বাংলাদেশকে। গত মাসে জলবায়ুর ঝুঁকি বিশ্লেষণে অভিজ্ঞ লন্ডনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান 'ম্যাপলক্রাফট' ২০১১ সালের যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতেও বিশ্বে যে ৩০টি দেশকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশ এগুলোর শীর্ষে রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ২০১০ সালের তালিকায়ও বাংলাদেশ এক নম্বরে ছিল।
২০০৯ সালের আইলা-বিধ্বস্ত এলাকায় বাঁধ মেরামত না হওয়ায় এখনো সেখানকার মানুষ স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারছে না। এমনকি ২০০৭ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস সিডরের অবর্ণনীয় ক্ষয়ক্ষতির কারণে এখনো উপকূলের বহু মানুষ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেনি। উপকূল রক্ষা বাঁধের যেসব ক্ষতি হয়েছিল তা-ও সম্পূর্ণরূপে মেরামত করা যায়নি। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির মধ্যে কেবল যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধি বা সাগরের আগ্রাসী আচরণ রয়েছে, তা নয়। অতিরিক্ত খরা, ভয়াবহ বন্যা, মহামারি আকারে রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়াসহ আরো অনেক কিছুই এই ঝুঁকির অন্তর্ভুক্ত। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে এ লক্ষণগুলো যথেষ্ট স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বরেন্দ্র অঞ্চলসহ উত্তরাঞ্চলের অনেক এলাকায় ইতিমধ্যেই মরুকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। পানির স্তর ক্রমেই নিচে নেমে যাচ্ছে। অনেক এলাকায় গভীর নলকূপ দিয়েও পানি উঠছে না। চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে। নদীগুলোর নাব্যতা না থাকায় সারা দেশ মৌসুমি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বিদেশি সহায়তা পাওয়া না গেলে কিংবা অর্থাভাবের কথা বলে আমরা দায়িত্ব এড়াতে পারি না। তাতে দেশই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হবে। গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেঙ্ ২০১০ অনুযায়ী, ১৯৯০ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ১৮ বছরে বাংলাদেশে কেবল সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ১ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলারের। কয়েক লাখ মানুষ হতাহত হয়েছে। এ পরিমাণ সম্পদহানির পর এ দেশে দারিদ্র্য নিরসন কেবল কথার কথাই থেকে যাবে। কারণ এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রধান শিকারই হয় দরিদ্র জনগোষ্ঠী। কাজেই ঢাকা ঘোষণায় যে ১৪ দফা দাবি তোলা হয়েছে, সেগুলোর পরিপূর্ণ বাস্তবায়নে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকেই উদ্যোগী হতে হবে এবং অভিন্ন অবস্থানে থেকে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.