বৈষম্যের শিকার শিক্ষা ক্যাডার by পুলক চাকমা

স্বাধীনতার চার দশক পরেও হলেও জাতি একটি বাস্তবমুখী, অসাম্প্রদায়িক চেতনাসমৃদ্ধ শিক্ষানীতি পেয়েছে। এই শিক্ষানীতিতে শিক্ষার দিকনির্দেশনার পাশাপাশি শিক্ষকদের মর্যাদা ও অধিকারকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার কথা বলা হয়েছে। শিক্ষকতা একটি মহান পেশা, যা সব পেশার মূল উৎসও বটে। কিন্তু দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, সমাজের মূলভিত্তি রচনাকারী শিক্ষক সমাজ উপেক্ষিত রয়ে গেছেন। যে শিক্ষক সমাজের ওপর জাতি গঠন ও মানবসম্পদ উন্নয়নের মহান দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে, সেই শিক্ষক সমাজ অবমূূল্যায়িত হলে তাঁদের পক্ষে এ দায়িত্ব যথাযথভাবে সম্পন্ন করা কঠিন হয়ে পড়ে।
১৯৮৩ সাল থেকে সরকারি কলেজের শিক্ষকদের ক্যাডারভুক্ত করার পর থেকে ১৬ কোটি জনসংখ্যার এ দেশে মাত্র ১৫ হাজারের মতো সরকারি কলেজ শিক্ষক কর্মরত আছেন। বিসিএসে অন্তর্ভুক্ত ২৯টি ক্যাডারের মধ্যে শিক্ষা ক্যাডারটিই সর্ববৃহৎ। কিন্তু তুলনামূলক বিচার করলে দেখা যায়, শিক্ষা ক্যাডারের সঙ্গে অন্য ক্যাডারের মধ্যে বৈষম্য প্রকট। যেমন—জাতীয় পদমর্যাদা বা মানক্রম নির্ধারণী-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনেও (ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স, ১৯৮৬) শিক্ষকদের যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি বলে অনেকে মনে করেন। এই ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের ২০ নম্বর ক্রমিকে শিক্ষা ক্যাডারের সর্বোচ্চ পদ অর্থাৎ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালকের অবস্থান রাখা হয়েছে মাত্র। কিন্তু কলেজগুলোর অধ্যক্ষ বা অধ্যাপকদের ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের মানক্রমে স্থান হয়নি। ২২ নম্বর ক্রমিকে চিকিৎসা ও প্রকৌশল মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের, অন্যদিকে ২৩ নম্বর ক্রমিকে চিকিৎসা ও প্রকৌশল মহাবিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের জাতীয় মানক্রম নির্ধারণ করা আছে। অথচ এমন অনেক বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ রয়েছে, যেগুলোর গুরুত্ব চিকিৎসা-প্রকৌশল-পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে কলেজের অধ্যক্ষ বা অধ্যাপকদের মানক্রম নির্ধারিত না থাকার কারণে অনেক সময় জাতীয় অনুষ্ঠানে শিক্ষকদের বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। এ জাতীয় পদমর্যাদা বিন্যাসকরণে যে আন্তক্যাডার বৈষম্য রয়েছে, সেটি সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান হয় ২৫ নম্বর ক্রমিকে অর্থাৎ সর্বশেষ মানক্রমে। এ অংশে সিভিল সার্জন, উপসচিব, পুলিশ সুপারদের অবস্থান নির্ধারণ করা আছে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, এ সর্বশেষ ধাপেও সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ বা অধ্যাপকদের মানক্রম দেওয়া হয়নি। এখানে দুটি উদাহরণ তুলে ধরলে চিত্রটি আরও স্পষ্ট হবে। প্রশাসন ও পুলিশ ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তারা চাকরির তৃতীয় ধাপে এসে উপসচিব ও পুলিশ সুপারের মতো পদমর্যাদায় উন্নীত হন। অন্যদিকে, শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তাদের চাকরির সর্বোচ্চ ও সর্বশেষ ধাপটি অধ্যাপক বা অধ্যক্ষ হলেও জাতীয় মানক্রমে তাঁদের অবস্থান নির্ধারণ করা হয়নি। এ ছাড়া সহকারী অধ্যাপকেরা (৫ম গ্রেড) যখন পদোন্নতি পেয়ে সহযোগী অধ্যাপক পদে উন্নীত হন, তখন তাঁরা কেবল পদমর্যাদাটুকু লাভ করেন। কিন্তু আর্থিক বিবেচনায় প্রাপ্য চতুর্থ গ্রেড পান না, যেটি অন্য ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তারা পেয়ে থাকেন। এ ছাড়া শিক্ষা ক্যাডারকে অবকাশ বিভাগ হিসেবে গণ্য করার কারণে এই ক্যাডারের কর্মকর্তাদের অর্ধগড় বেতনে ছুটি ভোগ করতে হয়। অথচ অন্য ক্যাডার ও নন-ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তারা পূর্ণগড় বেতনে ছুটি ভোগ করেন। বরং বার্ষিক ছুটি হিসাবে দেখা যায়, শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তারা গ্রীষ্মকালীন ছুটিসহ অন্যান্য ছুটির দিনগুলোতে এইচএসসি, ডিগ্রি পরীক্ষাসহ বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় দায়িত্ব পালনে বাধ্য থাকেন। ফলে তাঁদের নির্ধারিত পূর্ণকালীন ছুটি ভোগ করার কোনো সুযোগ থাকে না। যে পেশায় বৈষম্য সর্বদা তাড়া করে বেড়ায়, সে পেশার প্রতি স্বাভাবিকভাবে মেধাবীরা বিমুখ থাকবে। অথচ শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত মান বাড়াতে হলে শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীদের সম্মিলন ঘটানো জরুরি।
বর্তমানে শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগ দেওয়ার প্রক্রিয়াটি বিসিএস, আত্তীকরণ, প্রদর্শক থেকে প্রভাষক পদে পদোন্নতীকরণ এবং ১০ শতাংশ কোটায় (রাষ্ট্রপতির নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে) নিয়োগ সম্পন্ন হয়ে থাকে। ফলে শিক্ষকদের জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণে বিরাট সমস্যা দেখা দেয়। তাই এ সমস্যা নিরসনের জন্য শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদ আপগ্রেড করাসহ পদোন্নতির বৈষম্য হ্রাস করতে সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন ও সুপার নিউমারারি পদ সৃষ্টি করে ব্যাচভিত্তিক পদোন্নতি নিশ্চিত করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গতিশীলতা ফিরিয়ে আনা জরুরি।
বর্তমান শিক্ষানীতিতে শিক্ষকদের জীবনমান উন্নয়নে আলাদা পে-স্কেলেরও সুপারিশ করা হয়েছে। বহির্বিশ্বের দিকে তাকালেও দেখি, সেখানে শিক্ষকদের জন্য উচ্চতর বেতন কাঠামো নির্ধারণ করা আছে। আমরা মনে করি, শিক্ষক সমাজের জীবনমান ও মর্যাদা বজায় রাখতে হলে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে শিক্ষকদের পদমর্যাদা যেমন নির্ধারণ করা জরুরি, তেমনই শিক্ষক সমাজের জন্য প্রস্তাবিত আলাদা পে-স্কেল দ্রুত কার্যকর করে শিক্ষকতা পেশার প্রতি মেধাবীদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। ‘২০২১-এর ভিশন-মিশন’ সফল করতে হলে শিক্ষা প্রশাসনকে গতিশীল করার কোনো বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে যে বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দেওয়া দরকার, সেটি হলো শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তাদের মধ্য থেকেই শিক্ষা প্রশাসনে নিয়োগ নিশ্চিত করা।
টিআইবির ২০১০ সালের প্রতিবেদনেই উল্লেখ করা হয়েছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতির পরিমাণ ২৯ শতাংশ থেকে কমে ১৫ শতাংশে নেমে এসেছে। আমরা মনে করি, শিক্ষাব্যবস্থার মানোন্নয়ন ও শিক্ষা-সংশ্লিষ্টদের যথাযথ মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থা থেকে দুর্নীতির শেকড় উপড়ে ফেলা সম্ভব। কাজেই শিক্ষক সমাজ মনে করে, বর্তমানে গৃহীত শিক্ষানীতিটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এনে জ্ঞান-বিজ্ঞাননির্ভর একটি ডিজিটাল ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে এর কোনো বিকল্প নেই।
পুলক চাকমা: শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা
pulakchakma21@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.