ধানের বাম্পার ফলন, বাজারে স্বস্তি বনাম কৃষকের শঙ্কা-সময়ের কথা by অজয় দাশগুপ্ত

মন ধান কাটার ধুম পড়েছে, এটা বলা যাবে না। এ জন্য আরও কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু ইতিমধ্যেই দিনাজপুরের বাজারে এসেছে নতুন ধান। বঙ্গোপসাগরের তীরের জেলা বরগুনাতেও লবণসহিষ্ণু জাতের ধান কাটা শুরু হয়েছে। সমকালের বরগুনা জেলা প্রতিনিধি জানালেন, এ ধানের (বিনা-৮) ফলন এতদিন স্থানীয়ভাবে চালু বিভিন্ন জাতের চেয়ে বেশি এবং ধান লাগানো থেকে শুরু করে ফসল তোলা পর্যন্ত সময়ও প্রয়োজন পড়ে কম।


চার মাস বা ১২০ দিনে আমন ফসল ঘরে উঠেছে, বোরো তোলা যাবে ১৩৫ থেকে ১৪০ দিনে। স্পষ্টতই আধুনিক কৃষি বিজ্ঞানের সঙ্গে কৃষক ও কৃষি মজুরদের চমৎকার সমঝোতা গড়ে উঠেছে 'সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা বাংলাদেশে'। বিজ্ঞানীরা নতুন জাতের ধান উদ্ভাবন করছেন এবং বাংলাদেশের জমিতে তার প্রয়োগ ঘটছে। বিশ্বের নানা দেশে যখন খাদ্যশস্যের ফলন নিয়ে উদ্বেগ, বাংলাদেশে তখন বোরোর পর আমন ধানেও বাম্পার ফলন। ধানের ফলনের সূচক ঊর্ধ্বমুখী। আমন ধান পুরোপুরি কাটার আগেই চালের বাজারে নিত্যদিনের ক্রেতারা খুশি_ ২৫-২৬ টাকাতেই পাওয়া যায় এক কেজি মোটা চাল। দিনাজপুর থেকে সমকালের জেলা প্রতিনিধি জানালেন, সিদ্ধ চিকন চাল কিছুদিন আগেও ছিল ৪০-৪২ টাকা কেজি_ এখন তা মেলে ২৮-৩২ টাকায়। দাম আরও কমবে। বাজারে সবজিও কম দামি।
রংপুরেও মোটা ও চিকন চালের দাম কমতে শুরু করেছে। তবে পাইকারি বাজারে যতটা কমেছে, খুচরা বাজারে তার প্রভাব কম। ৮৪ কেজির বস্তা পাইকারি বাজারে মোটা-চিকনভেদে এক হাজার ৯০০ থেকে দুই হাজার ১০০ টাকা। খোলা বাজারে মোটা চাল ২৬-২৭ টাকা কেজি। পাইকারি বাজারের দাম অনুযায়ী খুচরা বাজারে ২৩-২৪ টাকায় এক কেজি মোটা চাল পাওয়ার কথা। কিন্তু কেন মিলছে না, কেউ জবাব দেওয়ার নেই।
রংপুর-দিনাজপুরে আলু, বাঁধাকপি-ফুলকপি, বেগুন বেজায় সস্তা হলেও বরগুনার মতো দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে তার অনেক দাম। সবজির কেজি সর্বনিম্ন ৪০ টাকা। এক কেজি ফুলকপি ৫০ টাকা (সেখানে ওজন হিসেবে এসব বিক্রি হয়)। শসা ৪০ টাকা এবং আলু ২৫ টাকা কেজি।
কুষ্টিয়ায় মজুদদাররা 'লোকসান' দিয়ে বাজারে চাল ছাড়তে শুরু করেছেন। খাজা নগরের মোকামে এক মাস ধরে চালের দাম পড়ছে। স্বর্ণা চিকন চাল ছিল প্রতি কেজি ৩৮ টাকা, এখন তা ৩২ টাকায় মেলে। মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তের চাল মিনিকেটের দামও কমছে। কেজিতে ৫-৬ টাকা দাম কমানো হয়েছে এবং তাতেও লাভ থাকছে। একবার ভাবুন তো, কৃষকের শ্রমে-ঘামে উৎপাদন করা ফসল নিয়ে ব্যবসা করে কী অকল্পনীয় পরিমাণ লাভ ঘরে তুলেছে ধান-চালের ব্যবসায়ীরা। আমন ধানের মজুদ গড়ে তোলার জন্য বড় পাইকাররা বোরো চাল ছেড়ে দিচ্ছে। চাল ছেড়ে দিলেও প্রকৃতপক্ষে তাদের লোকসান নেই। বাজার নিয়ন্ত্রণ করে তারা ভালো লাভ করে নিয়েছে। এ জন্য কেউ তাদের কাছে কৈফিয়ত চায়নি। এখন লোকসান নয়, প্রকৃতপক্ষে কম লাভে বাজারে চাল ছেড়ে দিচ্ছে। গুদাম খালি না করলে আমন চাল রাখবে কোথায়?
কেন ধানের ফলন ভালো হয়েছে, সেটা মোটামুটি সবার জানা। এবারে আবহাওয়া ভালো ছিল। বন্যা হয়নি। একটানা বৃষ্টিও হয়নি। সারের দাম বেশি, কিন্তু সরবরাহ ছিল যথেষ্ট। বীজ নিয়েও কোনো সংকট হয়নি। এর পেছনে সরকারের ভালো ভূমিকা রয়েছে। কৃষিমন্ত্রী কৃতিত্ব পাবেন।
এখন কৃষকের শঙ্কার কথাটা বলি। সীমিতসংখ্যক কৃষক ছাড়া ধান বা পাট তারা ধরে রাখে না। উৎপাদিত ফসল বিক্রি করেই তারা নতুন ফসল ফলানোর পুঁজি সংগ্রহ করে। বসতবাড়ি মেরামত বা নতুন ঘর তোলা, ছেলেমেয়ের বিয়ে কিংবা পরিবারের অন্যান্য আনন্দোৎসবেও ভরসা ফসল। ধানের দাম কমে গেলে তাদের মাথায় হাত পড়ে। সবজির দাম না পেলেও চাষিরা উদ্বিগ্ন হয়। বহু বছর ধরে এটাই চালু, কৃষকরা যে ফসল বাজারে ছাড়বে, তাতে উৎপাদন খরচের তুলনায় লাভ থাকবে সামান্য কিংবা আদৌ লাভ থাকবে না। বাজারে শহুরে মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত ক্রেতার সংখ্যা অনেক। বাজারে গিয়ে চাল-আলু-কপি বা ভোজ্যতেল-ডালের চড়া দাম দেখলে তারা ক্ষুব্ধ হয়। এক কেজি কাঁচা লঙ্কার দাম কেন ১০০ টাকা, তা নিয়ে লঙ্কাকাণ্ড ঘটে যায়। পেঁয়াজ-রসুনেরও দাম থাকা চাই কমের মধ্যে। সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে প্রচার হয় ক্রেতাদের ক্ষোভের কথা। কিন্তু কৃষকের কথা কে বলবে? খাদ্য মন্ত্রণালয় বোরো ধান ও চাল সংগ্রহ করেনি এই মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তের কথা ভেবে। বাজারে সরকার সক্রিয় হলে দাম আরও চড়ে যেতে পারে বলে শঙ্কা ছিল। এবারে আমনের বাম্পার ফলনের পরও সরকার সক্রিয় হবে কি-না, সেটা স্পষ্ট নয়। খাদ্য মন্ত্রণালয় বাজারে গেলে তাদের প্রতিযোগিতা হবে চাতাল মালিক এবং খাদ্যের মজুদদারের সঙ্গে। তাতে কৃষকের লাভ হতে পারে, কিন্তু ক্ষোভ সৃষ্টি হবে শহরের মানুষের মধ্যে। ধনী-গরিব সবাই অসন্তুষ্ট হবে। কিন্তু কৃষকের কথা কে লিখবে? এটা ঠিক যে, চালের দাম বাড়লে শহর ও গ্রামের গরিব মানুষের নিদারুণ কষ্ট হয়। ২৩-২৪ টাকা কেজিও তাদের জন্য অনেক বেশি। সরকার গত কয়েক মাস ২৫ টাকা কেজি দরে ওএমএস কর্মসূচির মাধ্যমে চাল বিক্রি করছে। এতে প্রচুর ভর্তুকি দিতে হয়। চাল ছাড়াও জ্বালানি তেলে সরকার ভর্তুকি দেয়, রাসায়নিক সারে ভর্তুকি দেয়, বিদ্যুতে ভর্তুকি দেয়, পোশাক শিল্পে ভর্তুকি দেয় এবং রফতানিকারকদের ভর্তুকি দেয়। বাজেটের উল্লেখযোগ্য অংশ চলে যায় এই ভর্তুকির পেছনে। কৃষকদের জন্যও কিছু ভর্তুকি রয়েছে। তবে অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে এ খাতের বিপুল অবদানের তুলনায় এর পরিমাণ খুব কম। আমাদের দেশে যেসব ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি রয়েছেন তারা ব্যবসার পরিমাণ কম হলে বলেন_ ভালো নেই। শেয়ারবাজারে যারা বিনিয়োগ করে তারা চায় প্রতিদিন লাভ করতে। কিন্তু কৃষকের যেন লাভ করতে নেই কিংবা করলেও তার পরিমাণ থাকতে হবে সীমিত। সরকার বলছে, জ্বালানি তেলে এই অর্থবছরে ভর্তুকির পরিমাণ ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি হবে। এ খাতের ভর্তুকির সুফল জনসাধারণের সব অংশই কমবেশি ভোগ করে। ডিজেলের ভর্তুকির সুফল কৃষকরাও পায়। কিন্তু উৎপাদন বাড়ানোর জন্য তাদের পাশে সরকার কতটা দাঁড়ায়? পাটের ব্যবসায়ী ও পাটশিল্পের জন্য সরকারের যতটা মনোযোগ, পাটচাষিদের জন্য ততটা নয়। গত বছর চাষিরা পাটের ভালো দাম পেয়েছে। এবারে আরও বেশি মনোযোগ ছিল তাদের সোনালি আঁশ চাষে। কিন্তু বাজারে যে দাম গত বছরের তিন-চার ভাগের এক ভাগ! শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের লোকসান হলে সমাজে যে উদ্বেগ দেখা দেয়, রফতানি বাণিজ্যে মন্দা দেখা দিলে সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে যেভাবে মন্তব্য প্রকাশ হতে থাকে তার তুলনায় সিকি ভাগও বরাদ্দ থাকে না কৃষকের জন্য। শেয়ারবাজারে অনেকের লোকসান হয়েছে এবং অতি ধুরন্ধর কিছু লোক লাভ তুলে নিয়েছে। এখন দাবি উঠছে, ব্যাংক বাজারে টাকা খাটিয়ে শেয়ারবাজার চাঙ্গা করুক। কৃষকের লোকসান হলে কিন্তু এমন দাবি ওঠে না। কেউ বলে না যে ব্যাংকগুলো তাদের অর্থ খাদ্য ব্যবসায়ীদের ঋণ দিয়ে বাজার চাঙ্গা করুক।
এটাও মনে রাখতে হবে যে, কৃষক 'ন্যায্যমূল্য' না পেলে দিনমজুর-ক্ষেতমজুরদের তারা বেশি মজুরি দিতে পারে না। এখন গ্রামের মজুররাও দিনে 'সকাল-সন্ধ্যার চেয়ে কিছুটা কম সময়' কাজ করেও ২০০-৩০০ টাকা পর্যন্ত মজুরি পায়। শহরে রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে এমন অনেকেও এখন ধান কাটতে চলে গেছেন গ্রামে। এভাবে পরিবারের সঙ্গেও থাকা হয়, আবার বছরের খোরাকির একটি অংশও সংগ্রহ করা সম্ভব হয়। কিন্তু এভাবে মাস শেষে যে ১০ হাজার টাকাও হাতে আসে না। অর্থনীতির চাকা আরও বেশি করে সচল করতে হলে কৃষকদের স্বার্থের প্রতি আরও মনোযোগ দিতেই হবে। ফসল উৎপাদন করে তাদের ভালো লাভ থাকলে তারা কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়াতে পারবে_ ভালো মানের বীজ কিনতে পারবে এবং সময়মতো দিতে পারবে সেচের পানি ও সার। কৃষির বাইরেও গ্রামীণ অর্থনীতির বিভিন্ন শাখায় বিনিয়োগের জন্যও তাদের হাতে অর্থ থাকা চাই। তারা মাছ চাষ করতে পারে, সবজি লাগাতে পারে। গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির খামার করতে পারে। শিল্পপণ্য কেনার জন্য তাদের হাতে বাড়তি অর্থ এভাবে আসতে পারে। ছেলেমেয়ের শিক্ষার ব্যয় আসতে পারে।
আমাদের অর্থনীতিতে সংস্কারের কথা দশকের পর দশক ধরে বলা হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক সংস্কার বলতে বোঝায় কেবল বেসরকারি খাতকে শক্তিশালী করা। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর কাছেও সংস্কারের একটাই অর্থ_ কলকারখানা এবং ব্যাংক-বীমা ব্যক্তি খাতে থাকবে। সবকিছু বাজারের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। কৃষক-ক্ষেতমজুরদের স্বার্থ রক্ষা তাদের এজেন্ডায় পড়ে না। কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন চাইলে কৃষি ও কৃষককে উপেক্ষা করার দিনকে অতীতের বিষয়ে পরিণত করতেই হবে। তাদের ফসলের জন্য ন্যায্যমূল্য নয়, বরং ভালো পরিমাণে লাভ দিতে হবে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বছরে ১২-১৩ হাজার কোটি টাকা কৃষি খাতে ঋণের জোগান দিয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করা নয়, বরং এর পরিমাণ আরও বাড়াতে হবে এবং এ জন্য বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে রাজি করাতে হবে। ব্যাংকে যত অর্থ জমা রয়েছে (চার লাখ কোটি টাকারও বেশি) তার প্রায় ৭০ শতাংশ এখন বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকগুলোর হাতে। কৃষি খাতকে এর ন্যায্য হিস্যা পেতেই হবে।

অজয় দাশগুপ্ত :সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.