আইনি লড়াই চালিয়ে যাবেন বাবা-মা by মাসুম মিজান

রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুলের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী ছিল দিহান মেহজাবিন রিদিতা। বাবা শেখ আলিউজ্জামান একজন প্রতিষ্ঠিত হোমিও চিকিৎসক। মা ফাতেমা সুলতানা ভিকারুননিসা নূন স্কুলের আজিমপুর শাখার শিক্ষিকা। কর্মজীবী এই দম্পতির একমাত্র সন্তান রিদিতা ছিল সংসারের মধ্যমণি। হঠাৎ পারিবারিক অশান্তির ঝড় ওঠে তাদের সুখের সংসারে। রিদিতার মা-বাবার কলহ থানা-পুলিশ ও আদালত পর্যন্ত গড়ায়।


গত তিন বছর ধরে অভিভাবকদের এই নিষ্ঠুর যুদ্ধের মধ্যে পড়ে মেয়েটির জীবন বিষিয়ে ওঠে। এক পর্যায়ে পৃথিবীকে চির বিদায় জানিয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেয় রিদিতা। মেয়ের এই নির্মম পরিণতির পরও থামেনি ফাতেমা-আলিউজ্জামান দম্পতির আইনি লড়াই। সন্তানের মৃত্যুর জন্য তারা একে অন্যকে দোষারোপ করছেন। মৃত্যুর পরও লাশ নিয়ে টানা-হেঁচড়ায় রিদিতার দাফন আট ঘণ্টা দেরিতে হয়েছে।
গত ৮ অক্টোবর সকালে মোহাম্মদপুর টিক্কাপাড়ার হাজি চিনু মিয়া রোডের ১৫এ/৯ নম্বর বাড়ির দ্বিতীয় তলার একটি ফ্লাট থেকে রিদিতার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ। স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর থেকে ফাতেমা সন্তানকে নিয়ে তার বাবার এই বাড়িতে থাকতেন।
একমাত্র মেয়েকে হারানোর পর আলিউজ্জামান-ফাতেমার দাম্পত্য কলহ আরও ভয়াবহ রূপ নেয়। রিদিতার মৃত্যুর ব্যাপারে তারা পরস্পরবিরোধী অভিযোগ ও আইনি লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েন। আত্মহত্যায় রিদিতাকে বাধ্য করার অভিযোগে ফাতেমার বিরুদ্ধে একটি মামলা করেছেন আলিউজ্জামান। অন্যদিকে ফাতেমার অভিযোগ, নারীলিপ্সু স্বামীকে ঘরে ফেরানোর অনেক চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয়নি। এ নিয়ে গত ৩ বছর ধরে তাদের সংসারে অশান্তি চলছিল। এতে রিদিতা বিষিয়ে ওঠে। প্রিয়জনদের মধ্যে এই সংঘাত কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি মেয়েটি।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ১৭ বছর আগে পারিবারিকভাবে আলিউজ্জামান-ফাতেমার বিয়ে হয়। তখন আলিউজ্জামান রাজধানীর একটি কলেজের প্রভাষক ছিলেন। আর ফাতেমা অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী। সেই থেকে তারা দু'জন অনেক পরিশ্রম করে নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। মেধাবী আলিউজ্জামান প্রভাষক থেকে অধ্যাপক এবং পরে হোমিও চিকিৎসাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। অন্যদিকে রিদিতাকে গর্ভে নিয়ে অনার্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ফাতেমা। পরে মাস্টার্স পাস করে তিনি ভিকারুননিসা নূন স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন।
ফাতেমা সুলতানা সমকালকে জানান, আর্থিক সচ্ছলতার সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যেতে থাকেন আলিউজ্জামান। গত ২-৩ বছর আগে থেকে নিজের চেম্বারের রেশমা নামে এক পরিচ্ছন্নতাকর্মীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন আলিউজ্জামান। এক পর্যায়ে ওই মেয়েকে বিয়ে করার পদক্ষেপ নিলে ফাতেমা বাধা দেন। এ নিয়ে শুরু হয় পারিবারিক অশান্তি। পরে ফাতেমা ও রিদিতাকে ফেলে চেম্বারের ওই মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে যাত্রাবাড়ীতে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করেন আলিউজ্জামান। ফাতেমা একপর্যায়ে আইনের আশ্রয় নেন। রাজধানীর যাত্রবাড়ী থানায় আলিউজ্জামানের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে একটি মামলা করেন ফাতেমা। এই মামলায় গ্রেফতার হয়ে ১৩ দিন কারাগারে ছিলেন আলিউজ্জামান। সে সময় ফাতেমার সঙ্গে আপস করার শর্তে মুচলেকা দিয়ে জামিন পান তিনি। তবে জামিনে বের হয়ে বিরোধ মীমাংসার পরিবর্তে তিনি আরও হিংস্র হয়ে ওঠেন।
ফাতেমা আরও অভিযোগ করে বলেন, মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে ওকে বুকে আগলে ধরে বেঁচে ছিলাম। কিন্তু রিদিতা কোনোভাবেই আমাদের আলাদা হওয়ার বিষয়টি মেনে নেয়নি। তাই বারবার তাকে ফোন করত। কিন্তু ওর বাবা আমার সম্পর্কে অনেক অশ্লীল কথা বলত রিদিতাকে। এসব কারণে প্রায়ই মন খারাপ থাকত তার। তবে ওর মন এতটা বিষিয়ে উঠেছে তা কল্পনাও করতে পারিনি। শেষ পর্যন্ত আমাকে নিঃস্ব করে মেয়েটি চলে গেল।
ঘটনার দিন সকালেই আলিউজ্জামানকে জানানো হয় তার মেয়ে রিদিতার মৃত্যুর খবর। রাত পর্যন্ত লাশ নিয়ে অপেক্ষা করেন ফাতেমা। কিন্তু মেয়ের মৃত্যুও তাকে টলাতে পারেনি। তিনি মেয়ের জানাজা ও দাফনেও অংশগ্রহণ করেননি। মোহাম্মদপুর থানা পুলিশের পক্ষ থেকে ফোন করা হলে আলিউজ্জামান মেয়ের লাশ তার কাছে পাঠিয়ে দিতে বলেন। এর পর দিন রিতিদাকে আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে ফাতেমার বিরুদ্ধে আদালতে একটি মামলা করেন আলিউজ্জামান।
এসব অভিযোগের ব্যাপারে আলিউজ্জামান সমকালকে বলেন, গ্রেফতারের ভয়ে আমি মেয়ের লাশ দেখতে যাইনি। আমাকে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশই যেতে বারণ করেছে। মেয়ের মৃত্যুতে আমিও ব্যথিত। তাই এই মৃত্যুর জন্য ওর মায়ের বিরুদ্ধে আমি মামলা করেছি। পুলিশ তদন্ত করছে। এতেই প্রকৃত ঘটনা বের হয়ে আসবে।
নিজ চেম্বারের নারীঘটিত অভিযোগের ব্যাপারে তিনি বলেন, ২-৩ বছর আগে আমার অফিসে ৭-৮ জন মহিলা ছিল। ওরা আমার কাজে সহযোগিতা করত। এক পর্যায়ে মহিলাদের নিয়ে বাজে কথার সৃষ্টি হলে আমি তাদের বাদ দেই। আমার বিরুদ্ধে করা সব অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।
আত্মহত্যায় প্ররোচনার ব্যাপারে ডিএমপির মতিঝিল জোনের ডিসি আনোয়ার হোসেন সমকালকে জানান, দণ্ডবিধির ৩০৬ ধারায় আত্মহত্যায় প্ররোচনার ঘটনা গুরুতর অভিযোগ বলা হয়েছে। কোনো মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হত্যার শামিল। অভিযোগ প্রমাণ হলে কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.