ঘোষণার আগেই চলছে বাড়তি ভাড়া আদায়-রাজধানীতে নিষ্ক্রিয় বিআরটিএ by পার্থ সারথি দাস

রকার নতুন ভাড়ার হার ঘোষণা না করলেও দেশের কমপক্ষে ৩০০টি রুটে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার রাত ১২টার পর থেকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়। পরের দিন থেকেই যাত্রীদের পকেট কাটছে পরিবহন শ্রমিকরা। খোদ রাজধানীতেই কাউন্টার ও গেট-লক সার্ভিসের নামে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে দ্বিগুণ ভাড়া আদায় হচ্ছে বাস ও মিনিবাসে।


যোগাযোগমন্ত্রী অতিরিক্ত ভাড়া আদায় রোধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিলেও খোদ বিআরটিএর (বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ) কর্মকর্তারা এ ব্যাপারে নির্বিকার।
পথে পথে অতিরিক্ত ভাড়া : আবদুল্লাহপুর থেকে চিড়িয়াখানা রুটে নবকলি পরিবহনের ২৪টি বাস নিয়মিত চলাচল করে থাকে। প্রায় ২৮ কিলোমিটার দূরত্বের এই রুটে সরকার নির্ধারিত ভাড়া মানা হচ্ছে না। সরকার সর্বনিম্ন ভাড়া নির্ধারণ করেছিল সাত টাকা। কিন্তু এই বাস কম্পানি আদায় করছে ১৫ টাকা। লোকাল বাসে খিলক্ষেত থেকে কাকলি পর্যন্ত যাত্রীপ্রতি ভাড়া ছয়-সাত টাকা হলেও এই বাসে নেওয়া হয় ১৫ টাকা। একইভাবে কমপক্ষে ১৫০টি পরিবহন কম্পানিই নগরীতে এভাবে সরকারের নির্ধারণ করা ভাড়ার হার মানছে না।
গতকাল মঙ্গলবার সকালে খিলক্ষেতে নবকলি পরিবহনের কাউন্টারে উপস্থিত এই কম্পানির পরিচালকদের একজন হেদায়েতুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এক টিকিটে তিন থেকে চারজন যাত্রী বাসে উঠে পড়ে। তাদের বাধা দিলেই গণ্ডগোল বাধিয়ে দেয়। এ কারণেই আমরা এই ভাড়া নির্ধারণ করেছি।' গতকাল সকাল ১০টার দিকে নবকলির কাউন্টারে বাসের জন্য অপেক্ষমাণ যাত্রী মিরাজ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'কাউন্টার বাসে এক কিলোমিটার গেলেও ১৫-২০ টাকা নেয়। ১০ কিলোমিটার গেলেও সেটা নেয়। এটা কেমন নিয়ম?'
বিমানবন্দর এলাকায় সকাল থেকেই কাউন্টারগুলোয় টেবিল নিয়ে টিকিট বিক্রি শুরু হয়। গতকাল সকাল ৯টার দিকে দেখা যায়, গাজীপুর পরিবহন, নবকলি পরিবহন, বেলাল পরিবহনসহ সাত-আটটি পরিবহন কম্পানির টিকিট নিতে যাত্রীরা ভিড় করছে। কিন্তু বাসের দেখা নেই। কাউন্টার থেকে বলা হচ্ছে, বাস আসলেই টিকিট মিলবে। কাউন্টারগুলোয় গিয়ে দেখা যায়, কোথাও পুরনো টিকিটের মূল্যের স্থলে সিল মেরে নতুন ভাড়ার হার বসানো হয়েছে। কোনো কম্পানির বিক্রেতারা নিজেই হাতে লিখে বসিয়েছেন নতুন ভাড়ার হার। কেউ আবার যাত্রী এলে তবেই ঝটপট মুদ্রণ করে দিচ্ছেন 'ডিজিটাল টিকিট'। এই ক্ষেত্রে কত ভাড়া নেওয়া হচ্ছে, তা যাত্রীদের আগে জানানো হচ্ছে না।
'এইটা সবাই করে' : গাজীপুর পরিবহনের কাউন্টারে গাজীপুর যাওয়ায় জন্য টিকিট কিনে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন সদর উদ্দিন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, বিমানবন্দর থেকে মতিঝিলের শাপলাচত্বর পর্যন্ত এই বাসে আগে ভাড়া ছিল ২০ টাকা। এখন ২৫ টাকা দিতে হচ্ছে। এ পরিবহনের বিমানবন্দরের কাউন্টার মাস্টার আবুল মনসুরের সামনে গিয়ে দেখা যায়, ২০ টাকার পুরনো টিকিটের গায়ে ২৫ টাকার সিল মারা হয়েছে। আবুল মনসুর বলেন, তাঁদের পরিবহনের ৪০-৪২টি বাস এই রুটে চলাচল করে। সব কাউন্টারেই এভাবে ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। জানা গেল, বিমানবন্দর থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ভাড়া ২০ টাকা। একই হারে ভাড়া বিমানবন্দর থেকে মগবাজার পর্যন্ত। ভিন্ন দূরত্বের পথে সমান ভাড়া কেন জানতে চাইলে আবুল মনসুর বলেন, 'এইটা সবাই করে'।
বিমানবন্দর-গুলিস্তান রুটে চলাচলকারী বেলাল পরিবহনের কাউন্টারে গিয়ে দেখা যায়, আগের টিকিটের স্থলে হাতে লিখে নতুন মূল্য লেখা হয়েছে। এখানে বিমানবন্দর থেকে গুলিস্তানের ভাড়া দুই টাকা বাড়িয়ে ৩০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। টিকিটের গায়ে আগে মুদ্রিত ২৮ টাকার স্থলে কলমে লেখা হয়েছে ৩০ টাকা। বিমানবন্দর থেকে শাহবাগ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে এক টাকা। আগে টিকেটে মুদ্রিত ভাড়া ছিল ২৩ টাকা। এর স্থলে হাত দিয়ে লেখা হয়েছে ২৪ টাকা। কারণ জানতে চাইলে কাউন্টার মাস্টার সুমন দেব কালের কণ্ঠকে বলেন, 'মালিকের নির্দেশেই হাতে লিখে টিকিট দেওয়া হচ্ছে। আমরা বেশি ভাড়া নিচ্ছি না'। এই কাউন্টারে টিকিটের জন্য আসা যাত্রী সাজেদুল হক বলেন, 'বাস ও মিনিবাসের জন্য অপেক্ষা করেও পাওয়া যায় না। তাই বাড়তি ভাড়া দিতে রাজি থাকি আমরা।'
দুপুরে কাকলি এলাকায় বিভিন্ন পরিবহনের কাউন্টারে গেলে একইভাবে সিল দেওয়া ও হাতে লিখে বাড়তি ভাড়া আদায়ের দৃশ্য চোখে পড়ে। টিকিট বিক্রেতা মো. বিল্লাল হোসেন বলেন, 'গত কয়েক মাসে এখান থেকে মেট্রো ক্লাসিক, আজমেরী, প্রভাতী-বনশ্রী, দুলদুল, মনজিল, হিমালয়, জাগুয়ার পাঞ্জেরিসহ বিভিন্ন পরিবহনের কাউন্টার তুলে নেওয়া হয়েছে। এখন মাত্র চারটি কাউন্টার রয়েছে এখানে। যাত্রীর চাপ বেশি। কেউ এক-দুই টাকা বেশি নিলেও কিছু বলে না।'
শুধু কাউন্টার আর সিটিং সার্ভিস নয়, দূরপাল্লার বিভিন্ন রুটেও আদায় হচ্ছে অতিরিক্ত ভাড়া। ঢাকা-সিলেট রুটে চলাচলকারী বিভিন্ন পরিবহনের ভাড়া ছিল সাড়ে ৩০০ টাকা। এখন নেওয়া হচ্ছে ৩৮০ টাকা। মনজুর হোসেনে নামের এক যাত্রী অভিযোগ করেন, গতকাল দুপুরে সায়েদাবাদে ইউনিক পরিবহনের কাউন্টারে গিয়ে টিকিটের বেশি দাম দেখে তিনি যান শ্যামলী পরিবহনে। কিন্তু সেখানেও বাড়তি ভাড়া দাবি করা হচ্ছিল। তবে শ্যামলী পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রমেশ চন্দ্র ঘোষ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা বাড়তি ভাড়া আদায় করছি না। সরকার ভাড়া পুনর্নির্ধারণ করলেই আমরা ভাড়া বাড়াব।'
দাম বেড়েছে জ্বালানি তেলের। কিন্তু সিএনজিচালিত যানবাহনেও অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। গতকাল দুপুরে এলেনবাড়ি এলাকায় সিএনজি অটোরিকশা (ঢাকা মেট্রো-থ-১৩৪০৯৫) চালক বেলাল হোসেন জানান, মিটারে তিনি গাড়ি চালান না। তবে সামনে পুলিশ দেখলেই মিটার চালু করেন। দিনে মালিককে ৭০০ টাকা দিতে হয়। এ ছাড়া পুলিশের মোবাইল টিমের চাঁদা হিসেবে আরো ৫০০-৭০০ টাকা রাখতে হয়। কিন্তু মিটারে গেলে খরচের চেয়ে আয় কম হয়। গতকাল তিনি জুরাইন থেকে প্রেসক্লাব পর্যন্ত এক যাত্রীর কাছ থেকে আদায় করেন ১০০ টাকা। অথচ তিনি নিজেই বলেন এই দূরত্বের ভাড়া বড়জোড় ৬০ টাকা। গতকাল দুপুরে এলেনবাড়ি থেকে পল্টন যেতে যাত্রী সাহেদ আলীর সঙ্গে তিনি চুক্তি করেন ১৮০ টাকায়।
নিষ্ক্রিয় বিআরটিএ : যোগাযোগমন্ত্রী গত রবিবার যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সভা শেষে বলেছিলেন, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় রোধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু রাজধানীর প্রধান তিনটি টার্মিনাল ও বিভিন্ন কাউন্টার এবং পথে পথে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া হলেও বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ নিষ্ক্রিয় রয়েছে। গতকাল দুপুর সোয়া ১২টার দিকে রাজধানীর এলেনবাড়ির বিআরটিএর প্রধান কার্যালয়ে গেলে দেখা যায়, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এস এম রেজাউল করিম তাঁর কক্ষে পরিচিত দুই ব্যক্তিকে নিয়ে ভূমি খাতের দুর্নীতি নিয়ে কথা বলছেন। পথে পথে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া হচ্ছে_জানানো হলে তিনি এ প্রতিবেদককে জানান, গত সোমবার তিনি আজিমপুর এলাকায় অবস্থান করে দেখেছেন সেখানে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় হচ্ছে না। রাজধানীর অন্যান্য স্থানে পরিস্থিতি কী তিনি জানেন না স্বীকার করে বলেন, 'আমরা অভিযান চালানোর চিন্তা-ভাবনা করছি।'
অপর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তোফায়েল ইসলামের কক্ষে গেলে তাঁকে পাওয়া যায়নি। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিনি একটি মামলার সাক্ষ্য দিতে সিলেট অবস্থান করছেন। মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তোফায়েল ইসলাম কালের কণ্ঠকে জানান, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর অতিরিক্ত ভাড়া আদায় রোধে তিনি অভিযানে বের হতে পারেননি। সোমবার তিনি সিলেটের উদ্দেশে রওনা দেন। বুধবার অফিসে উপস্থিত হওয়ার কথা রয়েছে। তিনি বলেন, 'আমাদের জনবল কম। তাই সব স্থানে নিয়মিত অভিযান চালানো সম্ভব হয় না।'
গতকাল দুপুরে বিআরটিএ অফিস প্রাঙ্গণে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের অভিযানে ব্যবহারের জন্য দুটি গাড়িই (মাইক্রোবাস ঢাকা মেট্রো চ-৫৩২২৩৩ ও মেট্রো-চ-৩৪০১১ পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
বিআরটিএর পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) মশিয়ার রহমানের সঙ্গে বিকেলে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, 'অভিযান শুরু হবে। বিকেলে অভিযানে বের হবেন ম্যাজিস্ট্রেট রেজাউল করিম।' রেজাউল কোন এলাকায় অভিযান চালাবেন জানতে চাইলে তিনি কোনো জবাব দিতে পারেননি।
নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, ম্যাজিস্ট্রেট রেজাউল করিমের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত গত জুলাই মাস থেকে গত ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত মাত্র ৩২ দিন অভিযান চালায়। সর্বশেষ ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয় ১৯ সেপ্টেম্বর। কিন্তু ওই মাসে তাঁর আদালত অভিযান চালান তিন দিন।
এদিকে গতকাল রাতে বিআরটিএর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এস এম রেজাউল করিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, অফিসের অন্যান্য কাজে ব্যস্ত ছিলাম। তাই অভিযানে বের হইনি। আগামীকাল অভিযানে বের হতে পারি।'
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী খান অতিরিক্ত বাস ভাড়া আদায় প্রসঙ্গে বলেন, 'বিআরটিএর ভাড়ার হারের তালিকাটি অপরিকল্পিত। বিভিন্ন রুটের টোলের বিষয়টি এখানে সমন্বয় করা হয়নি। এর ওপর চালকদের বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজির শিকার হতে হচ্ছে। এ কারণে নির্ধারণ করা ভাড়ার তালিকা অনুসরণ করা যায় না। ১৯৯৮ সাল থেকে এ ব্যাপারে দেন-দরবার করছি। কোনো ফল হচ্ছে না। গতকাল বিভিন্ন পরিবহনে সর্বশেষ বাড়ানো ভাড়ার তালিকা চোখে পড়েনি। অভিযোগ রয়েছে, তালিকার তথ্য হেরফের করে বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.