সংগ্রামের প্রদীপ্ত মশাল ইমদাদ হোসেন by কামাল লোহানী

বিরাট যে লাল সূর্যটাকে দেখি শহীদ মিনারের স্তম্ভজুড়ে, সে গর্জে ওঠে ভাষাসংগ্রামী শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে, প্রতি ফেব্রুয়ারিতে। যেন বয়লারের গনগনে আগুনের মতো জ্বলতে থাকে। প্রতিরোধের আগুনে ঝলসে ওঠে ওই লাল সূর্যটা। উত্তাপ দেয় যত প্রতিবাদী মানুষকে। জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ভস্ম করে দেয় প্রতিক্রিয়ার যত জঞ্জাল। একে সামনে রেখে আমরা লাখো-অযুত মানুষ শ্রদ্ধা নিবেদন করি ভাষাশহীদদের।


সংকল্প গ্রহণ করি মুষ্টিবদ্ধ হাত আকাশে উঠিয়ে দেশমাতৃকার দুশমন দস্যুদের নিপাত করার। প্রতিজ্ঞায় উজ্জ্বল হয়ে উঠি দৃপ্ত যৌবনে, অঙ্গীকারে প্রবল শক্তি ধারণ করি ওই লাল সূর্যটাকে সাক্ষী রেখে।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বিশাল লম্বা স্তম্ভগুলোকে অবলম্বন করে বিরাট গোলাকার লাল বৃত্তটির উদ্ভাবক শিল্পী ইমদাদ হোসেন। যে বছর এই সৃজনী প্রতিভায় সমুজ্জ্বল চিত্রকর লাল সূর্যটাকে স্থাপন করলেন, সে বছর ইমদাদ ভাই ছিলেন বাংলাদেশ টেলিভিশনে। ছিলেন শিল্পীপ্রধান। সঙ্গে তার একদঙ্গল তরুণ প্রগতি চিন্তার শিল্পী_ কেরামত মওলা, আনোয়ারুল হোসেন, নান্টু, মহিউদ্দিন ফারুকের মতো পরিশ্রমী, দৃঢ়চেতা প্রতিবাদী যুবক। দিনরাত পরিশ্রম করে একুশের আগেই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সমবেত প্রচেষ্টায়। নেতা ছিলেন শিল্পী ইমদাদ হোসেন।
শিল্পী ইমদাদ হোসেন বহু রোগভোগের পর রোববার (১৩ নভেম্বর) ঢাকার হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন সকালে। ঠিক সাতদিন পরেই ছিল তার ৮৬তম জন্মদিন। এই নিভৃতচারী মানুষটি জীবনের এই সুদীর্ঘ পথপরিক্রমায় কোথায় যে কত সৃজনশীলতার প্রবল স্বাক্ষর রেখে গেছেন, তার শুমার করা মুশকিল। জন্মেছিলেন চাঁদপুরে, কিন্তু বাল্যকাল কেটেছে তার কেরানীগঞ্জের রোহিতপুরে। দীর্ঘকায় এই দৃঢ়চিত্ত, আপসহীন মানুষটি লেখাপড়া শেষ করার এক পর্যায়ে ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা আর্ট স্কুলে, যা শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের অধ্যবসায়, পরিশ্রম ও শিল্পসাধনার মূর্ত প্রতীক হিসেবে গড়েছিল আর্ট কলেজ। ইমদাদ এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক অসাধারণ প্রতিভার যেন উদ্ভাস-দীপ্তি ছড়াতেন। এই তো সময় আমাদের মাতৃভাষাকে রক্ষার লড়াইয়ের। কিন্তু বায়ান্নতে দিতে হলো প্রাণ। বুকের রক্তে রঞ্জিত রাজপথ। রাজপথে এই আন্দোলনে পড়েছিল পোস্টার নাজিমুদ্দিন আর নূরুল আমীনের কল্লা চেয়ে। কী অসম সাহসী সেই পোস্টার লেখার উদ্যোগ ছিল, আজ তা বর্ণনা করে বোঝানো যাবে না। এই সেই শিল্পী ইমদাদ, যার হাত দিয়ে পোস্টার যেন মেশিনের মতো লেখা হয়ে জমা হতো গণনাকারীদের হাতে।
তখনকার দিনে পোস্টার লেখা হতো নিউজপ্রিন্টের সংবাদপত্রের পাতায়। একেকটা বাটিতে বা মাটির পাত্রে লাল, কালো, নীল রঙ গুলিয়ে তা দিয়ে পোস্টার লিখতেন ইমদাদ হোসেন, আমিনুল ইসলামরা। নেতা ছিলেন শিক্ষক কামরুল হাসান। আর পাটখড়িতে নেকড়া জড়িয়ে পোস্টার লেখার কলম বানানো হতো। সিদ্ধহস্ত ইমদাদ ভাই মিনিটে নাকি একটা করে পোস্টার লিখতেন। তা ছাড়া প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার মানুষ হিসেবে তাকে আর তার সতীর্থদের সেকালের সাম্প্রদায়িক শাসকগোষ্ঠী মুসলিম লীগ সরকারের নিপীড়ন সইতে হয়েছে। সে সময়ের রাজনীতিতে আজকের মতো যত্রতত্র, যখন খুশি, যেমন চান তেমনি চিৎকার কারণে-অকারণে করা সম্ভব ছিল না। আন্দোলনকালে লীগ সরকারের নিষেধাজ্ঞার কারণে নদীবক্ষে গোপন বৈঠকও করতে হতো। ইমদাদ ভাই ছিলেন সক্রিয় ভাষাসংগ্রামী। তাকে সঠিক মূল্যায়ন করা হয়নি কোনোদিন।
শিল্পী ইমদাদ হোসেন জনগণের কল্যাণের রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। বিশ্বাসে অবিচল ছিলেন চিরদিন। কাউকে সমালোচনা করতে হলে মুখের ওপরই তা বলে দিতেন। প্রতিক্রিয়ার অপশক্তিকে বিন্দুমাত্র ভয় করতেন না, মাথা উঁচু করে চলতেন। আর সে কারণেই নির্ভয় প্রাণের মানুষ ছিলেন। স্বার্থহীন জীবনকে ভালোবেসেছিলেন বলেই পার্থিব জগতের কোনো মায়া তাকে প্রলুব্ধ করতে পারেনি।
ইমদাদ হোসেন শিল্পী হিসেবেই নন, মানুষ হিসেবে এক অপরাজেয় চরিত্রের ছিলেন। অনন্য ব্যক্তিত্ব নিয়েও তিনি একজন সাধারণ মানুষ ছিলেন। আদর্শবান যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী ভূমিকায়ও। দেখেছি তাকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে, দেখেছি বাংলার মানুষের সংস্কৃতিকে ভালোবাসতে, চর্চা করতে। সাধারণ মানুষের জীবন পরিবর্তনে সমাজকে ঢেলে সাজানোর প্রচণ্ড কামনা ছিল তার বুকে। কিন্তু আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিভাজন-মতবিরোধকে ইমদাদ ভাই সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেননি। ক্ষুব্ধ মনে কেবল সমালোচনা করেছেন, কিন্তু খণ্ডবিখণ্ড চরিত্রগুলোকে মেলাতে পারেননি। নির্লোভ এই মানুষটি চেয়েছিলেন এই বিশ্বটা হোক দুর্জয় মেহনতি মানুষের। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার। পঞ্চাশ আর সত্তরের দশকে কোরিয়া যুদ্ধে কিংবা ভিয়েতনামে মার্কিনি আগ্রাসনে প্রচণ্ড বিক্ষুব্ধ হতেন। শিল্পীদের তো বটেই, জনগণকেও সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তিকে প্রতিহত করতে একাট্টা করার প্রয়াস নিয়েছিলেন। ঔপনিবেশিকতা, সাম্প্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মানসিকতায় ঋদ্ধ ছিলেন বলেই মানুষ হিসেবে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত যারা জানেন এবং চেনেন, তাদের অপ্রকাশ্য শ্রদ্ধা তিনি পেয়ে গেছেন। আজ মানুষটি চলে যাওয়ায় আমার কাছে মনে হচ্ছিল, যুগ অবসানে ওই সূর্যসন্তানরা চলে যাচ্ছেন; যারা ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সালের রক্তাক্ত একুশের ইতিহাস সৃষ্টি করে গোটা জাতিকে নাড়িয়ে দিয়েছিলেন; শিল্পী ইমদাদ হোসেন আর মানুষ ইমদাদ হোসেন তো চলে গেলেন না, যেন বাঙালি জাতির সংগ্রাম যুগের অবসান ঘটল। সত্য ভাষণে বলিষ্ঠ মনের মানুষগুলো একে একে চলে যাচ্ছেন, এ নিশ্চয়ই অশনিসংকেত কোনো, আমাদের জীবনে। আজকাল যে সংগ্রামের নমুনা দেখি, তাতে অর্জন কতটা তা কি আদৌ বুঝতে পারছি? এমনই পরিস্থিতিতে আত্মবিশ্বাসী, দৃঢ়প্রত্যয়ী নির্মোহ মানুষের অভাব যে প্রকট হয়ে উঠছে।
রাজনীতিসচেতন মানুষ, প্রচারবিমুখ সংগঠক, গণমানুষের মুক্তির চিন্তায় উদ্বুদ্ধ আপসহীন ব্যক্তিত্বের অভাব আজ বিপুল হয়ে দেশজ রাজনীতি-সংস্কৃতিকে ভয়াবহ সংকটে পড়তে হচ্ছে। 'রাজনীতি' করছি সবাই, কিন্তু জনগণের কল্যাণচিন্তা কারও নেই মনে হচ্ছে। কিন্তু ইমদাদ ভাইরা ছিলেন সে ক্ষেত্রে দিশারী, কারণ তারা তথাকথিত রাজনীতির হৈ-হুল্লোড়ে কোনোদিন মাতেননি। সংগ্রামে উজ্জীবিত জীবনের অধিকারী ছিলেন তারা।
শহীদ মিনারের লাল সূর্যটাকে যিনি সৃষ্টি করেছিলেন, তার স্মৃতিও তেমনি চিরভাস্বর হোক সংগ্রামের প্রজ্বলিত মশালের মতো। ওই পথেই আমাদের সত্যিকারের মুক্তি।

কামাল লোহানী : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.