ব্রোকারেজ হাউসে এখন শূন্য চেয়ার, ছাঁটাই আতঙ্ক by নাজমুল আলম শিশির

ধুমিতা ভবনের তিন তলায় হাজি আহমেদ ব্রাদার্স সিকিউরিটিজের অফিস। গতকাল মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১১টায় গিয়ে দেখা যায় আট থেকে ১০ জন বিনিয়োগকারী বসে আছেন। বেশির ভাগ চেয়ারই খালি। অলস সময় কাটাচ্ছেন কর্মকর্তারা। এই ব্রোকারেজ হাউসটির অনুমোদিত প্রতিনিধি হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, গত বছর এই সময়ে হাউসে আমরা বসার জায়গা দিতে পারতাম না।


গড়ে প্রতিদিন ৩৫ থেকে ৪০ কোটি টাকার লেনদেন হতো। আর এখন গড়ে সাত-আট কোটি টাকার মতো লেনদেন হচ্ছে আমাদের হাউসে।
পাশে বসা এক সহকর্মীকে দেখিয়ে তিনি বলেন, 'আগে উনি কান থেকে মোবাইল ফোন নামাতেই পারতেন না, আর এখন তাঁর কোনো গ্রাহকই আসছে না। বসে ঝিমানো ছাড়া কোনো কাজ নেই বললেই চলে।' তিনি আরো বলেন, যে অল্পসংখ্যক বিনিয়োগকারী আসছেন, তাঁরাও লেনদেন করছেন না। অনেকেই আসছেন কেবল সময় কাটাতে আর বাজারের পতনে অন্যের সঙ্গে দুঃখ ভাগাভাগি করতে।
মতিঝিলের হাজি আহমেদ ব্রাদার্স সিকিরিটিজের মতোই করুণ অবস্থা এখন দেশের ব্রোকারেজ হাউসগুলোর। তবে ঠিক এক বছর আগেও অবস্থা ছিল পুরোপুরি ভিন্ন। গত বছরের নভেম্বরে পুঁজিবাজার ছিল চাঙ্গা। সেই সময়ে প্রতিদিন লেনদেন গিয়ে ঠেকেছিল তিন হাজার কোটি টাকায়। লেনদেন বেড়ে যাওয়ায় ব্রোকারেজ হাউসগুলোয় ছিল চাঙ্গা ভাব। ব্যবসাকে সম্প্রসারণে উপজেলাপর্যায়েও ব্রোকারেজ হাউসের শাখা খোলার হিড়িক পড়ে। ঠিক এক বছর পরে এসে চিত্রটা পাল্টে গেছে! লেনদেন কমতে কমতে দৈনিক তিন শ কোটির টাকার নিচে নেমে গেছে। আর লেনদেনের কমিশনে চলা ব্রোকারেজ হাউসগুলোর রমরমা ভাবও আর নেই। হাউসগুলোর আয়ও কমে গেছে। মাসের খরচ মেটাতেই হিমশিম খাচ্ছে ব্রোকারেজ হাউসগুলো।
ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জের (ডিএসই) সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ২৩৮টি ব্রোকারেজ হাউস রয়েছে। সারা দেশে তাদের শাখা রয়েছে ৬৪১টি। আর চট্টগ্রাম স্টক এঙ্চেঞ্জের (সিএসই) ১৩৭টি ব্রোকারেজ হাউসের ১৬০টির মতো শাখা রয়েছে। এসব শাখার মাধ্যমে একসময় শেয়ার ব্যবসাকে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত সম্প্রসারিত করেছিল এসব ব্রোকারেজ হাউসগুলো। 'এখানে বিও অ্যাকাউন্ট খোলা হয়' লেখা ব্যানার ঝুলানো হয়েছিল জেলা শহর থেকে উপজেলার বাজার পর্যন্ত।
লেনদেনের বিপরীতে কমিশন পেয়ে থাকে হাউসগুলো। ব্রোকারেজ হাউসগুলোর প্রধান আয় হচ্ছে এই কমিশন। তবে বাজার মন্দায় লেনদেন কমে যাওয়ায় তাদের আয়ও কমে গেছে। কমিশনও কমতে হয়েছে তাদের। এখন কমিশন কমিয়ে তারা বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে এক হাজার টাকায় ৪০ পয়সা নিচ্ছে। এক বছর আগেও যেখানে হাউসগুলোর দৈনিক আয় হতো গড়ে সাত থেকে ১০ লাখ টাকা, তা এখন ৫০ হাজারেরও নিচে দাঁড়িয়েছে।
আয় কমে যাওয়ায় হাউসগুলোর সুযোগ-সুবিধাও কমে গেছে। আগে গ্রাহকদের জন্য চা-নাশতার ব্যবস্থা থাকলেও অনেক হাউস তা বাদ দিয়েছে। কর্মীরা রয়েছেন ছাঁটাই আতঙ্কে। এক ব্রোকারেজ হাউসের প্রতিনিধি জানান, অনেক হাউসে এরই মধ্যে কর্মী ছাঁটাই শুরু হয়েছে। বাজার যেভাবে পড়ছে তাতে হাউসগুলোর পক্ষে জনবলের বেতন দেওয়া কঠিন হয়ে যাবে। খরচ কমানোর জন্য অনেক ব্রোকারেজ হাউস তাদের শাখা কমিয়ে আনার পরিকল্পনা নিচ্ছে। বর্তমানে বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউসে আট হাজারের মতো কর্মী রয়েছে।
ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জের (ডিএসই) ঊর্ধ্বতন সহসভাপতি আহসানুল ইসলাম টিটু বলেন, প্রতিটি মন্দারই খারাপ দিক আছে। বর্তমানে শেয়ারজারের যে অবস্থা তৈরি হয়েছে, তাতে হাউসগুলো তাদের খরচ কমানোর জন্য যা করার প্রয়োজন, তা-ই করবে। আয় কমে গেলে তাদের ব্যয়ও কমাতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাস্তবতা হচ্ছে পরিস্থিতির উন্নতি না হলে হাউসগুলো তাদের শাখা বন্ধ এবং কর্মী ছাঁটাই করতে হয়তো বাধ্য হবে।
চট্টগ্রাম স্টক এঙ্চেঞ্জের (সিএসই) সভাপতি ফখর উদ্দিন আলী আহমদ কালের কণ্ঠকে বলেন, লেনদেন কমে যাওয়ায় ব্রোকারেজ হাউসগুলো বিরাট আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন। কর্মীদের মধ্যেও চাকরি হারানোর আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কে তিনি বলেন, লেনদেনের পরিমাণ না বাড়লে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে না। প্রতিযোগিতা বাড়ায় হাউসগুলোর খরচ আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। হাউসগুলোর মধ্যে যে সক্ষমতা তৈরি হয়েছিল, তা এখন পুরোপুরি কাজে লাগছে না। বর্তমান যে অবস্থা তৈরি হয়েছে, তাতে পুরো ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে বলে আশঙ্কা করেন ফখর উদ্দিন আলী আহমদ।

No comments

Powered by Blogger.