স্মরণ-মোবাশ্বের আলী : এক মৃত্যুঞ্জয়ী ব্যক্তিত্ব

নভেম্বর ২০১১ ছিল মোবাশ্বের আলীর ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী। একজন সাবেক ছাত্রী হিসেবে তিনি আজও আমার মনের মণিকোঠায় অম্লান হয়ে আছেন। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে বাংলায় অনার্স পড়ার সুবাদে তাঁর ছাত্রী হওয়ার সুযোগ হয়েছিল। অধ্যাপক মোবাশ্বের আলীর আরেক বোনও আমাদের অধ্যাপিকা ছিলেন_ বাংলা বিভাগের অধ্যাপিকা নুরুজাহান বেগম।


অধ্যাপক মোবাশ্বের আলী জীবনের শেষ দিকে অনেক বই লিখেছেন। তাঁর বইয়ের সংখ্যা ৪৫। এসব বইয়ের মধ্যে 'গ্রিক ট্র্যাজেডি', 'শিল্পীর ট্র্যাজেডি', 'শিল্পীর ভুবন', 'গ্রিসের দার্শনিকরা' প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। নজরুলের ওপরও তাঁর বই রচিত হয়েছে। মধুসূদনের ওপর রচনা করেছেন তিনটি বই। রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর যে ভালোলাগা, তা তাঁর ক্লাসে বারবার উচ্চারিত হয়েছে। তিনি মনে করতেন, বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চারজন দার্শনিকের একজন হচ্ছেন বঙ্কিমচন্দ্র। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর 'বঙ্কিমচন্দ্রের জীবন ও সাহিত্যকৃতি' গ্রন্থটি প্রকাশ করে জাতীয় সাহিত্য প্রকাশন। তাঁর 'বাংলাদেশের সন্ধানে' বইটিও মাতৃভূমির প্রতি তাঁর একরাশ ভালোবাসাকে প্রস্ফুটিত করেছে। তিনি গভীর অনুরাগের সঙ্গে, স্বদেশ মৃত্তিকার সঙ্গে দেশের মানুষকে পরিচয় করিয়ে দিতে চেয়েছেন। তাঁর রচিত এ গ্রন্থখানির মূল উদ্দেশ্য ছিল তিনি স্বদেশপ্রেমে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ছিলেন। তাইতো বাঙালির ইতিহাসের গভীরতা তিনি ফুটিয়ে তোলেন। অনুবাদকর্মেও তিনি নৈপুণ্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। মোবাশ্বের আলী কঠিন জীবনসংগ্রামের মধ্যেও বারবার দেশের জন্য কাজ করে গেছেন। কুমিল্লাবাসী হিসেবে তিনি ষাটের দশক থেকে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আন্দোলন করেছেন। তিনি এক মৃত্যুঞ্জয়ী ব্যক্তিত্ব। জীবনের কাছে তাঁর চাওয়া-পাওয়া তেমন ছিল না। তবু তিনি বাংলা একাডেমী, একুশে পদক, কুমিল্লা ফাউন্ডেশন পদক পেয়েছিলেন। হয়তো তিনি প্রকাশ্যে কোনো দলের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত না করায় তাঁকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া হয়নি। তাঁর তিন ছেলের মধ্যে একমাত্র মুহম্মদ মাহবুব আলী জীবিত। আমি যখন ছাত্রী ছিলাম, তখন তার বয়স ছিল ৯ বছর। আজ মাহবুব আলী প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কুল অব বিজনেসে কর্মরত অধ্যাপক হিসেবে। সে নিজেও একজন গল্পকার ও ঔপন্যাসিক। দুঃখ করে সেদিন বলেছিল, একুশে পদকপ্রাপ্তদের ক্ষেত্রে শহীদ বুদ্ধিজীবী, অস্থায়ী কবরস্থানকে স্থায়ী করার অনুমতির নিয়ম থাকলেও দরখাস্ত করা সত্ত্বেও ঢাকা সিটি করপোরেশন অনুমোদন দিচ্ছে না। জানি না, একজন গবেষক, ভাষাসৈনিক এবং বাংলা ভাষাকে ঋদ্ধ করার জন্য নিবেদিতপ্রাণ একজন শিক্ষাবিদের প্রতি এ কোন ধরনের শ্রদ্ধা নিবেদন।
অবশ্য বাংলা একাডেমীও কম যায় না। তারা মোবেশ্বর আলীর মৃত্যুবার্ষিকী পালন করে না। এমনকি তাঁর ওপর একটি জীবনীগ্রন্থ রচনা প্রকাশের প্রকল্পও নেয়নি। নজরুল ইনস্টিটিউটের নীরবতা সম্পর্কে কিছু না বলাই ভালো। মোবাশ্বের আলী অবশ্য তাঁর গ্রন্থগুলোর মধ্যে দীর্ঘকাল বেঁচে থাকবেন। কিন্তু তাঁর কর্মের যদি সুষ্ঠু পরিমাপ হয়, তাহলে আমাদের উত্তরসূরিদের লাভ হবে। মোবাশ্বের আলী স্যার যেন তাঁর কাজের স্বীকৃতি পান, সেটাই আমাদের দাবি।
জাহানারা বেগম

No comments

Powered by Blogger.