ফুলবাড়িয়ায় আখের বাম্পার ফলন-লাল চিনি উৎপাদনে রেকর্ড by ম কবীর উদ্দিন সরকার হারুন

লতি মৌসুমে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় আখের বাম্পার ফলন হওয়ায় ঐতিহ্যবাহী লাল চিনির উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার কয়েকগুণ ছাড়িয়ে যাবে। আখের ফলন ভালো হওয়ায় উপজেলার বাকতা, কালাদহ ও এনায়েতপুর ইউনিয়নের ২০টি গ্রামের কৃষকদের ঘরে ঘরে চলছে আনন্দ-উল্লাস। উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে বলা হয়, এ মৌসুমে ফুলবাড়িয়া উপজেলায় ৩২৪ হেক্টর জমিতে আখ চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য থাকলেও কৃষকরা চাষ করেছেন এক হাজার ২২৫ হেক্টর। প্রতি কাঠায় আখ মাড়াইয়ে ৪৫-৫০ টিন আখের রস থেকে এ বছর ৩ থেকে সাড়ে ৩ মণ লাল চিনি পাওয়া যাবে। ঐতিহ্যবাহী ফুলবাড়িয়ার লাল চিনি তৈরিতে কৃষকদের আখ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রার কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ায় এবারের বাম্পার ফলন অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।
বাকতা ইউনিয়নের কালনাজানী গ্রামের আখচাষি ও লাল চিনির উৎপাদক রুবেল মিয়া জানান, এবারের মতো ভালো ফলন এর আগে কখনও হয়নি। চাঁদপুর গ্রামের মকবুল হোসেন জানান, ফুলবাড়িয়ার ঐতিহ্য লাল চিনির কদর সারাদেশেই রয়েছে। প্রায় শতবর্ষ আগে থেকেই দেশের একমাত্র ওই উপজেলা ফুলবাড়িয়ায় লাল চিনি উৎপাদন হচ্ছে। তবে অতীতে চিনিকলের মিহি ও সাদা চিনি বাজারে আসার পরই ফুলবাড়িয়ায় হাতে তৈরি চিনি লাল চিনি হিসেবে পরিচিত পায়। এ লাল চিনি দিয়ে বানানো চিড়া-মুড়ির মোয়ার স্বাদই আলাদা। লাল চিনির তৈরি কটকী তো এলাকায় বহুল প্রচলিত একটি শিশুখাদ্য এবং শীতের ফোঁকা পিঠার তুলনা নেই। লাল চিনি তৈরি প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে কালাদহ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শাহজাহান সিরাজ সাজু বলেন, 'আগে চিনি তৈরিকালে আখ মাড়াইয়ে ৪টি গরু (বলদ) প্রয়োজন হতো। এখন প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে আখ মাড়াই হচ্ছে ইঞ্জিনচালিত মেশিনে। ফলে কম সময় ও খরচে লাল চিনি উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে। আমাদের ধারণা, সভ্যতার জাঁতাকলে পিষ্ট প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারক ঐতিহাসিক চিনি এখনও তার অস্তিত্ব বজায় রাখতে পেরেছে। কালের বিবর্তনে লাল চিনি নাম ধারণ করে সভ্যতার সাক্ষী হয়ে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া এলাকার কৃষকের ঘরে ঘরে বেঁচে আছে।'
লাল চিনি তৈরিতে প্রথমে আখ থেকে রস বের করা হয়। রস বের করার পর মাটিতে গর্ত করে তৈরি চুলায় কড়াই বসিয়ে রস জ্বাল দেওয়া হয়। রস পূর্ণ জ্বাল হওয়ার পর কড়াইসহ চুলা থেকে নামিয়ে কাঠের ডাং বা কাঠি_ আঞ্চলিক কথ্য ভাষায় 'ডোভ' দিয়ে বিরামহীন ঘুটতে হয় যতক্ষণ না শুকনো ধুলার মতো আকার ধারণ করে। আখের গুণগত মান খারাপ হলে ধুলার মতো না হয়ে গুটি গুটি আকার ধারণ করে। এটিই লাল চিনি। চিনি তৈরি করার জন্য যে অস্থায়ী গৃহনির্মাণ করা হয় তাকে বলা হয় জ্বালঘর। দেখতে ধূসর-খয়েরি হলেও সাদা চিনির বিপরীতেই হয়তো লাল চিনির নামকরণ।
বয়স্ক ব্যক্তিদের মতে, আজ থেকে ৭০-৮০ বছর আগেও এ এলাকায় চিনি বলতে বর্তমান লাল চিনিকেই বোঝাত। কালের বিবর্তনে মেশিনে উৎপাদিত চিনি (ফুলবাড়িয়ার মানুষের ভাষায় যা সাদা চিনি) প্রসার লাভ করায় অত্র এলাকায় উৎপাদিত চিনি হয়ে গেছে লাল চিনি। এখনও অবশ্য ফুলবাড়িয়ার কোনো মানুষ চিনি প্রসঙ্গ উঠলে জিজ্ঞাসা করে নেয় লাল চিনি, না সাদা চিনি।
লাল চিনি মাড়াই মৌসুম শুরু হয় অগ্রহায়ণ মাসে, চলে চৈত্র মাস পর্যন্ত। মাড়াই মৌসুমে ওই এলাকায় উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করে। আখ মাড়াই অত্যন্ত পরিশ্রমী প্রক্রিয়া। লাল চিনি তৈরিতে আখ থেকে রস বের করার জন্য ব্যবহার করা হয় একটি যন্ত্র। এর তিনটি শলা থাকে লোহার। তার মধ্যে দুটি শলা আকারে বড়, একটি ছোট। এটিকে বলা হয় ওক (আখ) গাছ। শলাগুলো ঘোরালে আখ থেকে রস বের হয়। আগে শলাগুলো ঘোরানোর কাজে ব্যবহার করা হতো চারটি শক্তিশালী গরু।
সে যাই হোক। কষ্টের উৎপাদন পদ্ধতি, দীর্ঘমেয়াদে মাঠ দখল করে রাখা, বিকল্প ফসলের আশঙ্কা প্রভৃতি কারণে অদূর ভবিষ্যতে হারিয়ে যেতে পারে ইতিহাসের মূল্যবান এ উপাদান।

No comments

Powered by Blogger.