জেলহত্যা মামলার নিষ্পত্তি-সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে সন্দেহ by আশরাফ-উল-আলম ও এম বদি-উজ-জামান

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচারে সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে সন্দেহ দূর হয়নি। বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের তিন বছর পার হতে চলেছে। অথচ জেলহত্যার মতো একটি নারকীয় ঘটনার বিচার নিয়ে এগোতে পারেনি সরকার। এ বছরও এ মামলার সুরাহা হচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্টদের কাছে জানা যায়। আজ জেল হত্যাকাণ্ডের ৩৬ বছর পূর্ণ হবে। এত দিনেও চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হলো না জাতির কলঙ্কময় এই হত্যাকাণ্ডের।গত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে হাইকোর্ট এ মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত তিনি আসামির দুজনকে এবং যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কারাগারে থাকা চার আসামিকে বেকসুর খালাস দেন।


আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর মানুষের আশা ছিল, এই সরকার জেলহত্যা মামলায় হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আপিল করবে। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর প্রায় দুই বছর পর গত বছর ৬ নভেম্বর হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আপিল করার অনুমতির আবেদন (লিভ টু আপিল) দাখিল করে সরকার।
গত বছর ৩ নভেম্বর জেলহত্যা দিবসে পত্রপত্রিকায় জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার নিয়ে সংশয়ের খবর প্রকাশ হওয়ার পর ৬ নভেম্বর সরকারের পক্ষ থেকে লিভ টু আপিল করা হয়। এ বছরের ১১ জানুয়ারি ওই আবেদন মঞ্জুর করে নিয়মিত আপিল করার নির্দেশ দেওয়া হয়। নিয়মিত আপিল দায়েরও করা হয়। এরপর ১১ মাস কেটে গেলেও আপিল শুনানির জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এ বছর জেলহত্যা দিবসের প্রাক্কালে আবার সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আপিল শুনানির উদ্যোগ নেওয়া হবে।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর জেলহত্যা দিবস এলেই সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতারা জেলহত্যার বিচার নিয়ে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। দেশের মানুষকে আশার বাণী শোনান, জেলহত্যার বিচার হবে। কিন্তু পরে সবাই এসব বক্তব্য ভুলে যান। বিশিষ্টজনরা মনে করেন, মামলার শুনানিতে সরকারের ভূমিকা জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচারে আন্তরিক কি না, তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
জেলহত্যা মামলাকে রাজনৈতিকীকরণ করারও অভিযোগ রয়েছে। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে এ মামলার বিচারকাজ শেষ হয়। ওই সময় ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আসামিদের মধ্যে যারা জেলহত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। আর পলাতক তিন আসামিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নির্দেশ দেন। এরপর মৃত্যুদণ্ডাদেশ নিশ্চিতকরণ (ডেথ রেফারেন্স) ও কারাগারে থাকা আসামিদের আপিল শুনানি শেষে হাইকোর্ট আপিলকারী আসামিদের প্রত্যেককে খালাস দেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামিও খালাস পান। হাইকোর্ট একজনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে যারা আপিল করেনি, হাইকোর্টের রায়ে তাদের সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। তবে রায়ে উল্লেখ করা হয়, যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্তরা সবাই আপিল করলে প্রত্যেকে একই সুবিধা পেত। হাইকোর্টের এই রায় নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। এ সরকারের আমলে মামলাটি নিষ্পত্তি না হলে, আর সরকার পরিবর্তন হলে মামলাটি নিয়ে আবার নতুন রাজনীতিও শুরু হতে পারে বলে অনেকে মনে করেন।
আপিল শুনানির বিষয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সরকারের আপিল সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ গ্রহণ করেছেন। ইতিমধ্যে পেপারবুক তৈরি হয়েছে। আগামী জানুয়ারিতে আপিল শুনানির জন্য আদালতে আবেদন জানানো হবে।
এদিকে এ মামলার জন্য রাষ্ট্র নিয়োজিত প্রধান আইনজীবী আনিসুল হক জানান, জেলহত্যা মামলার হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল শুনানির জন্য পেপারবুক তৈরি হয়েছে। তবে নিম্ন আদালত, হাইকোর্টের রায়সহ মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণী তৈরি হয়নি। খুব শিগগির এটা তৈরি করার পর আদালত খুললেই শুনানির উদ্যোগ নেওয়া হবে।
উল্লেখ্য, আগামী ১৩ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট খুলছে। বর্তমানে ঈদ উপলক্ষে ছুটি চলছে। আদালত খোলার পর ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত আদালতের কার্যক্রম চলবে। এরপর আবার আগামী বছরের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত বার্ষিক ছুটি থাকবে। এ বছর শুনানি হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলেই ধারণা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক ও জেলহত্যা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে দায়িত্ব পালনকারী আইনজীবী শ ম রেজাউল করিম কালের কণ্ঠকে বলেন, মামলাটি শুনানি করতে রাষ্ট্রপক্ষের দায়িত্ব অনেক বেশি। এ জাতীয় নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করা না হলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের জন্য বিচারহীনতা সৃষ্টি করে। এ ধরনের ঘটনায় দায়ীরা পার পেয়ে গেলে তারা এর চেয়েও ভয়ানক ঘটনায় উৎসাহ বোধ করবে। অবিলম্বে আপিল শুনানির জন্য রাষ্ট্রপক্ষের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। তিনি আরো বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ থেকে ত্বরিত উদ্যোগ নিলে আরো আগে বিষয়টি নিষ্পত্তি হতে পারত।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির বর্তমান সম্পাদক ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল বলেন, সরকারদলীয় নেতাদের বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছে, মামলাটি রাজনৈতিক কারণে জিইয়ে রাখা হচ্ছে। সরকারের আচরণে মনে হচ্ছে, সরকার জেলহত্যা মামলার শুনানি নিয়ে আন্তরিক না।
এ মামলার বিচার নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে। সব সরকারের আন্তরিকতার অভাব জেলহত্যার সুষ্ঠু বিচারের পথে অন্তরায় ছিল। বিচারে ছিল রাজনৈতিক প্রভাবের ছাপ।
কোনো অন্যায় সংঘটিত হলে রাষ্ট্র সুবিচার পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করবে। কিন্তু জেলহত্যার মতো একটি জঘন্য হত্যাকাণ্ডের সুবিচার করতে পারেনি রাষ্ট্র। আইনের শাসন এ ক্ষেত্রে বারবার ভূলুণ্ঠিত হয়েছে।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে ২১ বছর পর জেলহত্যা মামলার বিচার শুরু হয়। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তা থেমে যায়। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার করতে গিয়ে জেলহত্যা মামলার কার্যক্রম চলে ধীরগতিতে। অথচ পৃথক আদালতে এ মামলার বিচার হতে পারত। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের এমনই ধারণা ছিল যে এ মামলা পরিচালনা করতে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আইনজীবীরা ছাড়া অন্য কেউ পারবেন না। বা অন্য কোনো আদালতও এ হত্যা মামলার বিচার করতে পারবে না। ফলে মামলাটির বিচার ওই সরকারের আমলে নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়নি। বিচার গড়ায় চারদলীয় জোট সরকারের আমল পর্যন্ত।
চারদলীয় জোট সরকারের আমলে বিচার চলাকালে এ মামলায় নিয়োগপ্রাপ্ত আইনজীবীদের সঠিকভাবে মামলা পরিচালনা করার সুযোগ দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ ওঠে। এ কারণে আওয়ামী লীগ সরকার আমলে নিয়োগ পাওয়া বিশেষ সরকারি কেঁৗসুলিরা একযোগে পদত্যাগও করেন। পরে মামলা পরিচালনা করেন চারদলীয় সরকার আমলের সরকারি কেঁৗসুলি (পিপি)। অভিযোগ রয়েছে, জোট সরকারের আমলে যেসব সাক্ষীর সাক্ষ্য নেওয়া হয়, তাঁরা সঠিকভাবে সাক্ষ্য দেননি। ফলে বিচারে অনেক আসামিকেই সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। পলাতক তিনজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
আদালতের রায়ে যা বলা হয় : জেলহত্যার প্রায় ২৯ বছর পর ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকার মহানগর দায়রা জজ মো. মতিউর রহমান মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে রিসালদার মোসলেম উদ্দিন, দফাদার মারফত আলী ও দফাদার মো. আবুল হাশেম মৃধাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। একই সঙ্গে তাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডেও দণ্ডিত করা হয়। এই তিন আসামি পলাতক ছিল। এখনো পলাতক।
অপর আসামি কর্নেল (অব.) ফারুক রহমান, মেজর (অব.) বজলুল হুদা ও মেজর (অব.) সুলতান শাহরিয়ার রশিদ, কর্নেল (অব.) খন্দকার আবদুর রশিদ, লে. কর্নেল (অব.) শরিফুল হক ডালিম (মেজর ডালিম), কর্নেল (অব.) এম বি নুর চৌধুরী, মেজর (অব.) এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ, লে. কর্নেল (অব.) এ এম রাশেদ চৌধুরী, মেজর (অব.) আহম্মদ শরিফুল হোসেন, ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদ, ক্যাপ্টেন (অব.) কিশমত হাশেম, ক্যাপ্টেন (অব.) নাজমুল হোসেন আনসারকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
বিএনপি নেতা কে এম ওবায়দুর রহমান, জাতীয় পার্টি নেতা শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ও বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়। বেকসুর খালাস দেওয়া হয় সরকারি কর্মকর্তা খায়রুজ্জামানকে।
হাইকোর্টের রায় : ২০০৮ সালের ২৮ আগস্ট হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ জেলহত্যা মামলায় তিনজন আসামির মৃত্যুদণ্ডাদেশ নিশ্চিতকরণ ও কারাগারে থাকা আসামিদের আপিলের শুনানি শেষে রায় দেন। নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি দফাদার মারফত আলী, দফাদার মো. আবুল হাশেম মৃধা; যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি কর্নেল (অব.) ফারুক রহমান, মেজর (অব.) বজলুল হুদা, মেজর (অব.) সুলতান শাহরিয়ার রশিদ ও মেজর (অব.) এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদকে এ রায়ে খালাস দেওয়া হয়। শুধু রিসালদার মোসলেম উদ্দিনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখা হয়। পলাতক অন্য আসামিরা আপিল না করায় তাদের বিষয়ে আদালতের রায়ে কিছু বলা হয়নি। তবে তাদের যাবজ্জীবন শাস্তি বহাল রয়েছে বলে আইনজীবীরা মনে করেন।
১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জেল হত্যাকাণ্ডে খালেদ মোশাররফের সঙ্গে অভ্যুত্থানকারীদের সম্পর্ক থাকতে পারে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে রায় দেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, জেলহত্যার আগে সেনা কর্মকর্তারা বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন_এর প্রমাণ আছে। কিন্তু কী উদ্দেশ্য নিয়ে তাঁরা বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন তা স্পষ্ট নয়। এ কারণে হাইকোর্টও জেলহত্যায় ষড়যন্ত্রের কিছু দেখেননি। হাইকোর্ট ১৯৭৫ সালে বঙ্গভবনে ও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যাঁরা কর্মরত ছিলেন, তাঁদের সাক্ষ্য বিশ্বাস করেননি। আবার কারাগারের রেজিস্টার মামলায় জব্ধ ও আদালতে উপস্থাপন করা হয়নি। ফলে ঘটনার রাতে কারা কারাগারে প্রবেশ করেছিল, তা শনাক্ত হয়নি বলে হাইকোর্টের রায়ে উল্লেখ করা হয়। তবে একজনের মৃত্যুদণ্ড কেন বহাল রাখা হলো তা রায়ে স্পষ্ট নয়। হাইকোর্টের রায়ে এটা স্পষ্ট যে যারা পলাতক রয়েছে, আপিল করলে তারাও খালাস পেত। অর্থাৎ জেলহত্যার ঘটনায় হাইকোর্ট একজনের জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে, যা দেশের মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়নি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর তাঁর ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহচর সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয়।
আজ কলঙ্কময় জেলহত্যা দিবস

No comments

Powered by Blogger.