বিল পাস সাড়ে তিন মিনিটেই by সজল জাহিদ

বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক মহলের তীব্র আপত্তি উপেক্ষা করে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে (ডিসিসি) উত্তর ও দক্ষিণ দুই অংশে ভাগ করার বিল জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে। মাত্র সাড়ে তিন মিনিটের মধ্যে কোনো আলোচনা ছাড়াই সরকারদলীয় সদস্যদের 'হ্যাঁ' সূচক কণ্ঠভোটের মাধ্যমে বিলটি পাস হয়। সংসদ থেকে আজ বুধবার বিলটি রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য পাঠানো হবে। সে ক্ষেত্রে আগামীকাল প্রশাসক নিয়োগের বিষয়টি আসবে বলে জানিয়েছেন
সংশ্লিষ্টরা। পাস হওয়া বিলটির গেজেট হওয়ার পরপরই বর্তমান মেয়র এবং ১৩২ জন কাউন্সিলর আর দায়িত্বে থাকবেন না। আগামী সিটি নির্বাচন পর্যন্ত অনির্বাচিত (প্রশাসক) ব্যক্তিই মেয়রের দায়িত্ব পালন করবেন। বিল পাসের পর স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম জানিয়েছেন, যত দ্রুত সম্ভব গেজেট প্রকাশের পর নির্বাচন কমিশনকে তারা অনুরোধ করবেন আইনানুসারে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের। অন্যদিকে স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক জানান, দু'একদিনের মধ্যেই প্রাশসক নিয়োগ করা হবে। পরে এক সংবাদ
সম্মেলনে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেন, মূলত জনগণের দোরগোড়ায় সেবা নিয়ে যাওয়ার জন্যই এই বিভক্তিকরণ। ডিসিসির বর্তমান মেয়রের বক্তব্য সম্পর্কে তিনি বলেন, বিএনপি যদি জনগণের ভোটে ক্ষমতায় এসে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে আবার একত্রিত করতে পারে করবে। আওয়ামী লীগ তা মেনে নেবে।
গতকাল বিকেল ৪টা ৩৮ মিনিটে 'স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) (সংশোধন) বিল-২০১১' বিলটি পাসের জন্য উত্থাপন করেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী। সাড়ে তিন মিনিটের মধ্যে বিল পাসের সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেন স্পিকার। তার আগে উপজেলা পরিষদ (সংশোধন) বিলটিও তিন মিনিটের মধ্যে পাস হয়ে যায়। সব মিলে গতকাল মাত্র ৯ মিনিটের মধ্যেই দিনের কার্যসূচি শেষ হয়ে যায়। সিটি করপোরেশন বিলটি পাসের জন্য উত্থাপনের আগে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বিলটির বিরোধিতার বিষয়ে বক্তব্য দিতে চাইলেও স্পিকার তাকে কেবল বিলটি পাসের সুপারিশের অনুরোধ জানান। ফলে দ্রুত সময়ের মধ্যে বিলটি পাস হয়ে যায়।
সাংসদদের 'হ্যাঁ' উচ্চারণের মাধ্যমেই চারশ' বছরের ঐতিহ্যের এ নগরটি বিভক্তিকরণের শেষ হার্ডল পার করল। রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের আনুষ্ঠানিকতা বাদ দিলে সিটি করপোরেশনের ৯২টি ওয়ার্ড দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। পাস হওয়া বিল অনুসারে ১ থেকে ২৩; ৩৭ থেকে ৪৭ এবং ৫৪ ও ৫৫ ওয়ার্ড (মোট ৩৬টি) নিয়ে গঠিত হবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। অন্যদিকে ২৪ থেকে ৩৬; ৪৮ থেকে ৫৩, ৫৬ থেকে ৯২ পর্যন্ত মোট ৫৬টি ওয়ার্ড নিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন হবে।
বিলটি পাসের সময় অধিবেশন কক্ষে ৯০ জনের মতো সাংসদ ছিলেন। এ সময় সামনের সারিতে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ছাড়া কেবল সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী এবং কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিল পাসের সময় সংসদে থাকার কথা থাকলেও তিনি আসার আগেই বিলটি পাস হয়। তখন অধিবেশন কক্ষে ছিলেন না জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদও। দ্বিতীয় সারিতে কয়েকজন মন্ত্রী থাকলেও তাদের সংখ্যা ছিল নিতান্তই কম।
পাস হওয়া বিল অনুসারে গেজেট হওয়ার পরপরই প্রশাসক নিয়োগ হবে এবং ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে কোনো কারণে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন না হলে নতুন করে প্রশাসক নিয়োগ হবে। এ ক্ষেত্রে নতুন প্রশাসকও আরও ৯০ দিন সময় পাবেন। তার মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতেই হবে। সংশোধিত বিলে অন্তর্বর্তী দায়িত্ব পালনের জন্য 'উপযুক্ত' ব্যক্তির কথা বলা হলেও তার যোগ্যতার কোনো মাপকাঠি নির্ধারিত হয়নি। এছাড়া সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নিয়োগে সেনা মেতায়েনের আইনি সুযোগ বাদ দিয়ে বিলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। ফলে জানুয়ারিতে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন থেকেই আর সেনাবাহিনী পাওয়ার সুযোগ পাবে না নির্বাচন কমিশন। এর আগে সদ্যসমাপ্ত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সেনা মোতায়েন না করা নিয়ে নির্বাচন কমিশন ও সরকারের মধ্যে টানাপড়েন সৃষ্টি হয়েছিল। এবার তার অবসান হবে।
প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিলেন আশরাফ :বিলটি পাসের প্রস্তাব করার আগে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেন, তিনি যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিলেন। ঢাকা বিভক্তিকরণের বিল নিয়ে মিডিয়াতে ও টকশোতে অনেক কথা হচ্ছে। যেসব সদস্য সংশোধনী প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তারা উপস্থিত থাকলে কথা বলার সুযোগ হতো। যেহেতু তারা নেই সে কারণে এ বিষয়ে কথা বলার রেওয়াজ নেই। এ সময় স্পিকার তাকে কেবল বিলটি পাসের জন্য উত্থাপন করতে বলেন। তবে সঙ্গে সঙ্গে তিনি এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জাতির সামনে বিস্তারিত তুলে ধরতে স্পিকারের অনুমতি প্রার্থনা করেন।
উত্থাপিত হয়নি জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব :বাইরে প্রধান বিরোধী দলের প্রবল আপত্তি থাকলেও গতকাল কেবল এ বিষয়ে জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব করেন ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন, জাসদের হাসানুল হক ইনু, একই দলের মইন উদ্দিন খান বাদল ও শাহ জিকরুল। তাছাড়া স্বতন্ত্র সদস্য মোহাম্মদ ফজলুল আজিম এবং জামায়াতের এএইচএম হামিদুর রহমান আজাদও জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব দেন। তাদের কেউ ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে আবার কেউ বা ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে এ বিষয়ে জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব করেন। অন্যদিক স্বতন্ত্র সাংসদ মোহাম্মদ ফজলুল আজিম চারজন সদস্যকে নিয়ে যাচাই-বাছাই কমিটি করার প্রস্তাব দেন। সেই কমিটিতে এম কে আনোয়ারকে সভাপতি করার পাশাপাশি তিনিসহ বিএনপির জাফরুল ইসলাম চৌধুরী ও নাজিম উদ্দিন আহমেদকে সদস্য করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু বিলটি পাসের জন্য উত্থাপিত হওয়ার সময় তাদের কেউই অধিবেশন কক্ষে ছিলেন না। ফলে তাদের প্রস্তাবগুলোও তখন উত্থাপিত হয়নি।
তবে এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে রাশেদ খান মেনন বলেন, ৪টা ৪০ মিনিটে অধিবেশন কক্ষে ঢুকেও তিনি তার সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করতে পারলেন না। তিনি কেবল বিল পাস হওয়া 'হ্যাঁ' সূচক ধ্বনিই শুনেছেন। মেনন বলেন, তার প্রস্তাব হয়তো শেষ পর্যন্ত গৃহীত হতো না। কিন্তু জনগণ তো তাদের কথা শুনতেন। এ ক্ষেত্রে স্পিকারের কৌশলী না হয়ে বরং আরও কিছুটা দায়িত্বপূর্ণ আচরণ করা দরকার ছিল বলেও মনে করেন তিনি।
জাতীয় পার্টির বেশ কয়েকজন সদস্য অধিবেশনে থাকলেও বিলটি পাসের ক্ষেত্রে তারা তেমন ভূমিকা রাখেননি। এমন কি তাদের অনেকে 'হ্যাঁ' শব্দ করে হাতও তোলেননি। তবে চিফ হুইপ উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদ শুকরিয়া আদায় করেন যে জাতীয় পার্টির সদস্যরা এদিন সংসদে আসবেন না বলে যে গুঞ্জন ছিল তা সত্যি হয়নি বলে।
স্পিকারের বক্তব্য : ঢাকা বিভক্তিকরণ বিল বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি স্পিকার। তবে দ্রুততার সঙ্গে বিল পাস হওয়া বিষয়ে তিনি সমকালকে বলেন, কেউ যদি সংশোধনী দিয়েও সংসদে না আসেন তাহলে ধরে নিতে হবে তিনি মূল প্রস্তাবের সঙ্গে একমত হয়েছেন। সে কারণে তারা অনুপস্থিত। না হলে তো তারা আগেভাগেই সংসদে এসে বসে থাকতেন। তবে দ্রুততার সঙ্গে বিল পাস হওয়ায় সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান স্পিকার।
ডিসিসির ভাগবাটোয়ারা : ঢাকা সিটি করপোরেশন দুটি ভাগে ভাগ হওয়ার ফলে এর কর্মকর্তা ও কর্মচারী, সম্পদ, অধিকার, ঋণসহ দায় ও দায়িত্ব সবই দু'ভাগে ভাগ হবে। তাছাড়া ডিসিসির আওতাধীন সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি, নগদ ও ব্যাংক স্থিতি, সংরক্ষিত সঞ্চিত তহবিল, বিনিয়োগও সমান হারে ভাগ হবে। অন্যদিকে ডিসিসি যেসব অধিকারপ্রাপ্ত হতো সেগুলোও ভাগ হবে। রেজিস্ট্রার, রেকর্ডপত্র এবং অন্য সব দলিল-দস্তাবেজ সরকার, বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে ভাগাভাগি হবে।
এর আগে ২৩ নভেম্বর ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দু'ভাগ করতে স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইনের সংশোধন বিল সংসদে উত্থাপন হয়। ২৭ নভেম্বর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি বিলটি চূড়ান্ত করে পরদিন এর রিপোর্ট সংসদে উত্থাপন করে। তারও আগে ডিসিসিকে দু'ভাগ করার লক্ষ্যে বিলটি ১৭ অক্টোবর মন্ত্রিসভায় নীতিগত অনুমোদন পায়। আর ৩১ অক্টোবর সেটি মন্ত্রিসভার বৈঠকে চূড়ান্ত অনুমোদন পায়।

No comments

Powered by Blogger.