নতুন ঢাকা, পুরান ঢাকা by মাহবুব মোর্শেদ

ঢাকার অধিবাসীদের কাছে শহরটি বহুদিন ধরেই দুই ভাগে বিভক্ত। সিটি করপোরেশন ভাগ নিয়ে তুমুল বিতর্কের মধ্যে এই সাধারণ তথ্যটির দিকে কারও মনোযোগ আকৃষ্ট হয়নি বলেই মনে হয়। তীব্র রাজনৈতিক তর্কের মধ্যে অত্যন্ত সাধারণ তথ্যটিও অনেক সময় সবার অলক্ষ্যে থেকে যায়। সেটা স্বাভাবিকও। ঢাকার অধিবাসীদের কাছে শহরের পুরাতন অংশটি পুরান ঢাকা আর নতুন অংশটি নতুন ঢাকা বা ঢাকা বলে পরিচিত।
একদা বুড়িগঙ্গার তীরে এ নগরীর পত্তন ঘটেছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত ঢাকা মোটামুটিভাবে পুরাতন অংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। স্বাধীনতার পর ঢাকা উত্তরে বিস্তৃত হয়েছে_ টঙ্গীর সীমান্ত উত্তরা পর্যন্ত। স্বাধীনতার পরের চার দশকে যে ঢাকা তৈরি হয়েছে তাকে সহজে চেনা যায়। পুরান ঢাকাকেও আলাদা করে চিনতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ২৯ নভেম্বর সংসদে বিল পাস হয়ে ঢাকা দু'ভাগ হলো। আর এ বিলে ঢাকা ভাগের যে প্রস্তাব করা হয়েছে তাতে ঢাকার ওই ধারণাগত বিভক্তিটাই সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেল। ঢাকা দক্ষিণ মোটাদাগে স্বাধীনতার আগের শহুরে জনবসতি। আর ঢাকা উত্তর স্বাধীনতার পরের জনবসতি। বিভক্ত ঢাকার ম্যাপের দিকে তাকালে এ সত্যটি সহজেই সবার চোখে ধরা দেওয়ার কথা। আর যারা সচক্ষে প্রতিদিন এ শহরকে দেখেন তারা সহজেই এ দুই ঢাকার গুণগত পার্থক্যের কথা জানেন। এ কথা সত্য, পুরান ঢাকার উত্তরাংশে অর্থাৎ ধানমণ্ডি-মোহাম্মদপুরে কিছু উন্নয়ন ঘটলেও, এর অধিকাংশ এলাকাই অবহেলিত। ঠিক যেন মেট্রোপলিটন শহর হয়ে উঠতে পারেনি। এক রাইডে উত্তরার রাস্তা থেকে চলমান একটি গাড়ি ওয়ারির রাস্তায় এসে পড়লে সহজে বোঝা যেতে পারে গুণগত পার্থক্যটি। সরকার ঢাকাকে দু'ভাগ করে ফেলায় এখন বুঝতে সুবিধা হবে। শহরের দুই অংশে উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের সমতা বিধানের জন্য যদি ইতিবাচক প্রতিযোগিতা হয় তবে নিশ্চয়ই নাগরিকরা তাকে স্বাগত জানাবেন। দুটি সিটি করপোরেশন হওয়ার পর ভবিষ্যৎ উন্নয়নের পার্থক্যও বোঝা যাবে সহজে।
সবচেয়ে ভালো হতো যদি উত্তর-দক্ষিণ দিকনির্দেশ না করে পুরান ঢাকা ও নতুন ঢাকা নাম দেওয়া হতো। ভারতের রাজধানী দিলি্লর ক্ষেত্রে এমন উদাহরণ আছে। তবে দিলি্ল বলতে যে পুরনো শহরের কথা আমরা জানি তা কিন্তু রাজধানী নয়। রাজধানী হলো নয়াদিলি্ল। দিলি্লর নতুন ও পুরাতনের সঙ্গে ঢাকার নতুন ও পুরাতনের বেশ মিল আছে। তবে দিলি্ল শুধু শহর নয়, শহরভিত্তিক একটি রাজ্যও। দিলি্লর পথ অনুসরণ করে ঢাকা নামটি শহরের পুরনো অংশকে দিয়ে নতুন অংশের আলাদা একটি নাম খোঁজা হলে আরও ভালো হতো। ঢাকার এই বিভক্তি নিয়ে সমাজের সর্বস্তরে এক ধরনের সংশয় কাজ করেছে আগাগোড়া। সত্যি কথা বলতে, নাগরিক সমাজ, মিডিয়া, রাজনৈতিক দল সবাই ঢাকা ভাগের বিপক্ষে। বলা যায়, সরকারি দলের গুটিকয় মানুষ ছাড়া প্রকাশ্যে কেউ ভাগ সমর্থন করেননি। তবু সংসদে বিল পাস হয়েছে। এখন দ্বিখণ্ডিত সিটি করপোরেশন নগরবাসীর জন্য বাস্তবতা। ঢাকা শুধু সিটি করপোরেশন নয়, বাংলাদেশের রাজধানীও। সিটি করপোরেশন দু'ভাগ হলেও রাজধানী নিশ্চয়ই দু'ভাগ হতে পারবে না। সঙ্গত কারণেই যে কোনো এক ভাগকে রাজধানী ঘোষণা করতে হবে, নয়তো বলতে হবে উত্তর-দক্ষিণ মিলিয়ে পুরোটাই রাজধানী। অর্থাৎ শুধু সিটি করপোরেশনের সেবা দু'ভাগ হলো, রাজধানী নয়। তবে ঢাকা শহরের যে বাস্তবতা তাতে রাজধানীটিকে যে কোনো একটি অংশে ফেললেই ভালো হতো। যদিও পুরান ঢাকা রাজধানী নয় তবু রাজধানী ঐতিহ্যের কাছাকাছি থাকল। সে ক্ষেত্রে প্রশাসনিক সব ভবন পুরাতন অংশে স্থানান্তর করে ফেলা যেতে পারে। আবার নতুন ঢাকাতেও রাজধানী আসতে পারে, নতুন রূপ নিয়ে নতুন কোনো জায়গায় প্রশাসনিক ভবনগুলো স্থাপন করা যেতে পারে। শহরের দুই অংশের আলাদা চরিত্রও দাঁড় করানো যেতে পারে। এসব গঠনমূলক চিন্তা_ অবশ্যই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়ে। আমাদের রাজনীতি যেভাবে চলে সে ধারায় ঢাকা চললে, যে ঢাকা সেই ঢাকাই থাকবে। দুই কেন চার ভাগ করলেও কোনো পরিকল্পিত, আধুনিক ও উন্নত শহর অদূর ভবিষ্যতে আমরা পাব না।

No comments

Powered by Blogger.