যেমন কাজ তেমন সাজা

যুগে যুগে কম কেলেঙ্কারি হয়নি ক্রীড়াঙ্গনে। যে জন্য শাস্তি হিসেবে বিভিন্ন মেয়াদে নিষেধাজ্ঞাও পেতে হয়েছে খেলোয়াড়-কর্মকর্তাদের। জেলেও যেতে হয়েছে তাঁদের অনেককে। জেলে যাওয়া সর্বশেষ তিন ক্রীড়াবিদ পাকিস্তানের। স্পট ফিঙ্ংি কেলেঙ্কারিতে জড়ানোয় পাকিস্তানের তিন ক্রিকেটার সালমান বাট, মোহাম্মদ আসিফ আর মোহাম্মদ আমিরকেও এখন জেল খাটতে হচ্ছে। এর আগে কিন্তু আর কোনো ক্রিকেটারকে জেলে যেতে হয়নি। তবে সালমান,


আসিফ আর আমির কষ্টটা একটু হলেও হয়তো ভুলতে পারবেন অতীতে শাস্তি ভোগ করা কিছু ক্রীড়াবিদের কথা জানলে।
জ্যাক মলিনাস (বাস্কেটবল, ১৯৬৪)
অমিত সম্ভাবনাময় যুক্তরাষ্ট্রের এই বাস্কেটবল খেলোয়াড় ১৯৫৩ সালে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে গড়েছিলেন এক ম্যাচে সর্বোচ্চ পয়েন্ট স্কোর করার রেকর্ড। তাই সেই সময়ের ঐতিহ্যবাহী দল ফোর্ট ওয়েন পিস্টন ১৯৫৪ সালে দলে নিয়ে আসে মলিনাসকে। কিন্তু টাকার নেশায় এ তরুণ হারিয়ে ফেলেন নৈতিকতা, জড়িয়ে যান জুয়াড়ি চক্রের সঙ্গেও। ম্যাচ পাতানোর প্রমাণ পাওয়ায় মাত্র ২৯ ম্যাচ খেলার পরই আজীবন নিষিদ্ধ হতে হয় তাঁকে। তবে ম্যাচ পাতানোর নেশাটা এর পরও যায়নি মলিনাসের।
বলা হয়ে থাকে অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। বাস্কেটবলে নিষিদ্ধ হওয়ার পর কর্মহীন জীবনে সে কারণেই হয়তো বিপথে পা বাড়িয়ে মাফিয়া চক্রের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়েন মলিনাস। হয়ে যান বড় মাপের জুয়াড়ি। ১৯৬১ সালে এনসিএএ টুর্নামেন্টে বেশ কয়েকজন খেলোয়াড়কে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে বেশ কিছু ম্যাচ পাতান তিনি। এ অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় ২২টি স্কুলের ৩৭ জন খেলোয়াড়কে। গ্রেপ্তার হন মলিনাসও। শঙ্কার কালো মেঘে ঢাকা পড়ে যায় এনসিএএ টুর্নামেন্টের ভবিষ্যৎ।
অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ১৫ বছরের জেল হয় মলিনাসের। তবে ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত পাঁচ বছর হাজতবাসের পর ছাড়া পেয়ে যান। মলিনাসের শেষটা খুব মর্মান্তিক। ১৯৭৫ সালে সন্ত্রাসীর গুলিতে নিহত হন তিনি।

জিমি গোল্ড (ফুটবল, ১৯৬৪)
তেমন উঁচু মানের খেলোয়াড় ছিলেন না জিমি গোল্ড। তবে ষাটের দশকে ম্যাচ পাতানো কেলেঙ্কারির 'নায়ক' হিসেবে খুব আলোচিত ছিলেন ব্রিটিশ এ ফুটবলার। শেফিল্ড ওয়েডনেসডের খেলোয়াড় ডেভিড লায়ানকে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে ম্যাচ পাতানোয় প্ররোচিত করেছিলেন তিনি। গোল্ডের হয়ে ডেভিড ১৯৬২ সালে ইপসুইচ টাউনের বিপক্ষে একটা ম্যাচ ইচ্ছে করে হারার প্রস্তাব দেন দুই সতীর্থ সোয়ান পিটার ও টনি কি-কে। ১৯৬৪ সালে ব্রিটিশ একটি পত্রিকার কাছে সাত হাজার পাউন্ডের বিনিময়ে সেই কেলেঙ্কারির কথাটা ফাঁস করে দেন গোল্ড। 'সানডে পিপল' ১২ এপ্রিল প্রতিবেদনটা ছাপানোর পর গ্রেপ্তার করা হয় চারজনকেই, দেওয়া হয় বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড। আজীবন নিষিদ্ধ হন শেফিল্ড ওয়েডনেসডের তিন ফুটবলার। গোল্ড পরে জানান, মোট ৩৩ জন খেলোয়াড়কে ম্যাচ পাতানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন তিনি!

টনিয়া হার্ডিং (ফিগার স্কেটিং, ১৯৯৪)
ফিগার স্কেটিংয়ের উজ্জ্বল নক্ষত্র হওয়ার যথেষ্টই সম্ভাবনা ছিল টনিয়া হার্ডিংয়ের। যুক্তরাষ্ট্রের এ তরুণী ২১ বছর বয়সেই ১৯৯১ সালে হয়েছিলেন দেশসেরা ফিগার স্কেটার। সে বছর দ্বিতীয় হয়েছিলেন বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপেও। কিন্তু ১৯৯৪ সালের ৬ জানুয়ারি ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাসেরই এক ন্যক্কারজনক কেলেঙ্কারির জন্ম দেন টনিয়া। বডিগার্ড ও সাবেক স্বামীর পরামর্শে প্রতিদ্বন্দ্বী ন্যান্সি ক্যারিগানের পা ভাঙতে ভাড়া করেন এক সন্ত্রাসীকে। অনুশীলনের সময় সেই সন্ত্রাসী হামলে পড়ে ন্যান্সির ওপর। অবশ্য বড় কোনো ক্ষতি হয়নি তাঁর। তবে টনিয়াকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় ঠিকই। ৫০০ ঘণ্টা অনির্ধারিত সামাজিক সেবামূলক কাজ করার শাস্তি হয় তাঁর। সেই সঙ্গে গুনতে হয় এক লাখ ১০ হাজার ডলার জরিমানা। ইউএসএফএসসি আজীবন নিষিদ্ধও করে টনিয়াকে। ২০০৩ সালে তাই ফিগার স্কেটিং ছেড়ে বঙ্ংিয়েও নাম লেখাতে দেখা যায় তাঁকে!

রবার্ট হোয়েজার (ফুটবল, ২০০৫)
প্যাডারবর্ন সেভেনের বিপক্ষে ২-০ গোলে এগিয়ে হামবুর্গার এসভি। প্যাডারবর্নের যা সামর্থ্য তাতে জার্মান কাপের ম্যাচটিতে তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর কথা কেউ স্বপ্নেও হয়তো ভাবেননি। কিন্তু প্রথমার্ধেই হামবুর্গের একজনকে বিতর্কিত লাল কার্ড দেখালেন রেফারি হোয়েজার। অবিশ্বাস্যভাবে দিলেন দু'দুটি পেনাল্টিও। এ কারণে প্যাডারবর্ন মাঠ ছাড়ে ৪-২ গোলের জয় নিয়ে। সন্দেহের ডানা মেলতে থাকে এরপর থেকে। ম্যাচটা নিয়ে তদন্তে নামে জার্মান ফুটবল ফেডারেশন। থলের বেড়াল বেরিয়ে আসে তাতেই। তদন্তের পর জানা যায় পাতানো ছিল ম্যাচটা আর এর নায়ক ছিলেন রেফারি হোয়েজার। এর আগেও নাকি অনেক ম্যাচে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে অবিশ্বাস্য সব সিদ্ধান্ত দিয়েছেন তিনি। এসব জানার পর গ্রেপ্তার করা হয় হোয়েজারকে, হাজতে কাটাতে হয় দুই বছর পাঁচ মাস।

ক্যালসিয়োপোলি কেলেঙ্কারি (ফুটবল, ২০০৬)
২০০৬ বিশ্বকাপ চলার সময়ই বেরিয়ে আসে ইতালিয়ান ক্লাব ফুটবলে ম্যাচ পাতানোর চাঞ্চল্যকর তথ্যগুলো। জুভেন্টাস, এসি মিলান, ফিওরেন্টিনা, লাৎসিও, রেজিনার মতো ক্লাবগুলোর ম্যাচ পাতানোর এ কেলেঙ্কারি পরিচিতি পায় 'ক্যালসিয়োপোলি স্ক্যান্ডাল' নামে। শাস্তি হিসেবে জুভেন্টাস কয়েকটা ট্রফি হারিয়ে নেমে যায় সিরি বি'তে। পয়েন্ট কাটা যায় মিলান, ফিওরেন্টিারও। আর আজীবন নিষিদ্ধ হন জুভেন্টাসের মহাব্যবস্থাপক লুসিয়ানো মোগ্গি। তাঁর চেয়েও কপাল মন্দ ছিল তিনজনের। জুভেন্টাসের সাবেক পরিচালক অ্যান্তোনিও জিরাওদো এবং সিরি এ'র দুই রেফারি পাওলো দোনদারিনি ও তুলিও লানেসাকে যেতে হয় জেলে। জিরাওদোর ৩, দোনদারিনি ও লানেসার জেল হয় দুই বছরের।

মারিয়ন জোন্স (অ্যাথলেটিঙ্, ২০০৮)
ট্র্যাকের রানিই ছিলেন মারিয়ন জোন্স। ২০০০ সিডনি অলিম্পিকে জিতেছিলেন পাঁচটি পদক, যার তিনটিই আবার সোনা। ১০০ ও ২০০ মিটার স্প্রিন্টের পাশাপাশি সোনা জিতেছিলেন ৪ গুণিতক ৪০০ মিটার রিলেতেও। এ ছাড়া ১৯৯৭ ও '৯৯ সালের বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জিতেছিলেন ১০০ মিটারে আর ২০০১ সালের বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে সোনা ছিল ২০০ মিটারে। রানি হওয়ার মতোই অর্জন। কিন্তু ড্রাগ কেলেঙ্কারিতে সেই রানিই হয়ে গেছেন 'ভিখারিনী'। ব্যালকো কেলেঙ্কারিতে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাথলেটিঙ্ অঙ্গনে উথাল-পাতাল শুরু হলেও ২০০৭ সাল পর্যন্ত ড্রাগ নেওয়ার কথা অস্বীকার করে এসেছিলেন জোন্স। কিন্তু ২০০৭ সালে প্রমাণিত হয় সিডনি অলিম্পিকে জোন্সের সাফল্যের পেছনে ভূমিকা রেখেছিল পারফরম্যান্সবর্ধক ড্রাগ। তাই আদালতে মিথ্যে বলায় ছয় মাসের জেল হয় এ অ্যাথলেটের। সেই সঙ্গে কেড়ে নেওয়া হয় ২০০০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে জেতা সব পদক। ছোট দুটো সন্তানকে দেখিয়ে জোন্স আবেদন জানিয়েছিলেন জেলের শাস্তি থেকে মুক্তি দেওয়ার। কিন্তু আদালত শাস্তি বহাল রেখে জানিয়ে দেন, 'আপনাদের মতো অ্যাথলেটদের আদর্শ করে বেড়ে ওঠে হাজার হাজার শিশু। আপনাকে শাস্তি না দিলে সেই শিশুরাও তো বিপথে যাবে।' ওয়েবসাইট

* যুক্তরাষ্ট্রের এক বাস্কেটবল খেলোয়াড়ের পাঁচ বছরের জেল হয়েছিল ম্যাচ পাতানোর অভিযোগে।
* ইংল্যান্ডে ফুটবল ম্যাচ পাতানোয় জেল হয়েছিল চারজনের।
* প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে অপকৌশল অবলম্বন করায় শাস্তি হয় যুক্তরাষ্ট্রের ফিগার স্কেটার টনি হার্ডিংয়ের।
* পাতানো ম্যাচ খেলায় বেশ কয়েকটি ট্রফি হারিয়ে সিরি 'বি'তে নেমে যেতে হয়েছিল জুভেন্টাসকে।
* ড্রাগ নেওয়ার অভিযোগে পদক হারানোর পাশাপাশি ছয় মাসের কারাদণ্ডও মেনে নিতে হয় যুক্তরাষ্ট্রের স্প্রিন্ট কুইন মারিয়ন জোন্সকে।

No comments

Powered by Blogger.