৩ ডিসেম্বর : আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস-মনের আলোয় পথ চলা

বিশ্ববিদ্যালয় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক তিনি। ভালোবাসেন কবিতা পড়তে। শখের বসে অভিনয়ও করেছেন। তবু বন্ধুহীন বাদল। সহানুভূতি দেখানোর মানুষ অবশ্য আছে তবে ওই পর্যন্তই। সব মিলিয়ে কেমন কাটছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র বাদল কুমার দাসের ক্যাম্পাস-জীবন? সেই গল্পই বলছেন পিন্টু রঞ্জন অর্ক ভোরের আলো ফোটার আগেই ঘুম ভাঙে তাঁর। ঘুম থেকে উঠেই যান হলের মাঠে। সঙ্গে থাকে সাদা ছড়ি।


হাঁটাচলা করে ঘেমে উঠলে হলে ফিরে গোসল সারেন। নাশতায় থাকে চিঁড়া-গুড়, পাউরুটি। এরপর ক্লাস। বেলা যত বাড়ে ঘটনাও ঘটতে থাকে অনেক_গল্প বলা, বই দেওয়া-নেওয়া কতকিছুই তো। তবে আর সবার মতো একইরকম হয় না বদলের। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র বাদল কুমার দাসের। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বাদল পাঁচ ভাইবোনের পরিবারের চতুর্থ সন্তান। ছয় বছর বয়সে তিনি এবং তাঁর ছোট বোন হামে আক্রান্ত হন। তার পর থেকে নিভে যায় তাঁর চোখের আলো।

ক্লাসের গল্প
প্রথম প্রথম কলা ভবনে গিয়ে ক্লাস খুঁজে পেতে খুব সমস্যা হতো বাদলের। এখন অবশ্য সে অবস্থা নেই। ক্লাসের অনেকের সঙ্গেই বেশ ভালো সম্পর্ক তাঁর। বিভাগের বারান্দায় সাদা ছড়ি হাতে বাদলকে দেখলেই এগিয়ে আসেন কেউ না কেউ। এটা অবশ্য সব সময় খুব একটা পছন্দ হয় না তাঁর। মনে ভয়, না জানি বিরক্ত হচ্ছেন! ক্লাসে ঢুকেই মোবাইলের রেকর্ডার অন করে দেন। স্যারের লেকচার রেকর্ড করে হলে ফিরে প্রথমেই কম্পিউটারে শুনে দিনের পড়া তৈরি করেন। নোট নিতে থাকেন। এরপর গোসল সেরে দাবা খেলতে বসে যান তিনি। দাবার ঘুঁটিতে হাত দিয়েই বুঝতে পারেন, কোনটা রাজা, কোনটা মন্ত্রী। ফলে নিজেই চাল দেন। আর যেদিন ক্লাস থাকে না, সারাটা সকাল কাটিয়ে দেন কম্পিউটারে গেইমস খেলে।

কবিতার দুপুর
শীতের অলস দুপুর কিংবা বৈশাখের গনগনে মধ্যাহ্ন। পুরো হল যখন ভাতঘুমে, জগন্নাথ হলের উত্তরপাড় ভবনের ২০ নম্বর কক্ষে তখনো জ্বেগে। বাদলের দুপুর কাটে কবিতা শুনে আর আবৃত্তি করে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ভীষণ প্রিয়। মনে মনে তিনিও খুঁজে ফেরেন 'নীরা'কে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের কবিতাও ভালো লাগে। বাদল বিটিভিতে নিয়মিত কবিতা আবৃত্তি করেন। অভিনয়েও সমান পারদর্শী। স্কুলে থাকতেই অভিনয়ে হাতেখড়ি। এরই মধ্যে 'জীবন যুদ্ধে একটু আলো চাই' নামে একটি টেলিফিল্মের কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন।

ক্রিকেটময় বিকেল
পড়ালেখা আর কবিতার বাইরে বাদলের আরেকটি পছন্দের কাজ ক্রিকেট খেলা। বিকেল এলেই তাই চলে যান খেলার মাঠে। বাংলাদেশ জাতীয় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ক্রিকেট দলের সহ-অধিনায়ক তিনি। অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ক্রিকেট দল ও ঢাকা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ক্রিকেট ক্লাবের। প্রায় বিকেলেই তাঁর দলের খেলা থাকে। এ জন্য যেতে হয় ধানমণ্ডি মাঠে। মাঝেমধ্যে মল চত্বরেও চলে অনুশীলন। খেলা না থাকলে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যান টিএসসি কিংবা নিউমার্কেটে। তবে খুব মন খারাপ করে বাদল বললেন_'অনেক দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের ক্রিকেট হয় না। নিয়মিত খেলা হলে আমাদের আরো ভালো লাগত।'

পড়ার টেবিলে রাত
সন্ধ্যা হতে না হতেই বসতে হয় পড়ার টেবিলে। রেকর্ড করা ক্লাস লেকচার শুনে শুনে মুখস্থ করেন রাত ১২টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত। বিছানায় যেতে যেতে কখনো বেজে যায় রাত ২টাও। পড়তে পড়তে শুনে নেন বিবিসির খবর। কখনো একঘেয়েমি কাটাতে বন্ধুদের সঙ্গে চ্যাট করেন ফেইসবুকে। নিয়মিত ক্লাস আর পড়াশোনা করলেও পরীক্ষার সময় বেশ টেনশনেই পড়ে যান বাদল। শ্রুতিলেখক খুঁজে পেতে খুব সমস্যা হয়। দশ-বারোজনকে বলার পর হয়তো কেউ রাজি হয়। তাদের জন্য নিতে হয় বিভাগীয় চেয়ারম্যানের অনুমতি। সমস্যা হয় পড়া রেকর্ড করার বন্ধু জোগাড় করতেও। মাঝেমধ্যে টাকা দিয়েও রিডার খুঁজে পাওয়া যায় না। এ জন্য বেশ আফসোস আছে তাঁর মধ্যে। এ সমস্যা না থাকলে লেখাপড়া আরো ভালো হতো বাদলের।

আমার কোনো বন্ধু নেই
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চার বছর কেটে গেলেও এখনো কাছের বন্ধু নেই বাদলের। পরিচিতদের কেউ কেউও এড়িয়ে চলে। কেউবা করুণা দেখায়। এ জন্য কারো সঙ্গে সে অর্থে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেনি। নিজের কম্পিউটারই বাদলের একমাত্র বন্ধু। কম্পিউটারে কাজ করতে 'জজ' আর 'কথা' সফটওয়্যার ব্যবহার করেন।
অন্য অনেকের মতোই হলে সিট পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তাঁকেও। প্রথম বর্ষে থেকেছেন হলের বাইরে। যে সিট পেয়েছেন, সেখানে দুটো বেডে গাদাগাদি করে থাকেন চারজন। তাঁদের হলে প্রতিবন্ধীদের জন্য মাত্র একটা কক্ষই বরাদ্দ আছে। থাকার কষ্টের সঙ্গে আছে আর্থিক সমস্যাও। বাড়ি থেকে মাঝেমধ্যে পাওয়া টাকা আর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপবৃত্তি দিয়েই কোনোরকমে লেখাপড়ার খরচ চালাচ্ছেন তিনি।

স্বপ্নের সিঁড়ি
অন্ধ বলে ছোটবেলায় হাই স্কুলেও ভর্তি করাতে চাননি স্যাররা। কিন্তু হার মানেননি নড়াইল জেলার কালিয়া উপজেলার পাটনা গ্রামের সংগ্রামী বাদল। তবে এখন নানা কারণে এই তরুণের ভবিষ্যৎ স্বপ্ন খুবই ছোট_কোনোরকমে একটা চাকরি জোগাড় করে বেঁচে থাকা।

No comments

Powered by Blogger.