অদৃশ্য বাসিন্দাদের সঙ্গে

ছোটবেলায় আমার সঙ্গে অনেক ভৌতিক ব্যাপার ঘটত। রক্ষণশীল খ্রিস্টান পরিবারে জন্ম আমার। ফলে ১৭ বছর বয়সে নিজেকে বন্দি করে ফেললাম নিজের মধ্যে। নিজেকে আর সামলাতে পারছিলাম না। ভয় ছিল অনেক। নিজেকে আর এই ভৌতিক জীবনে বন্দি রাখতে চাচ্ছিলাম না। তাই আশপাশের এ রকম অস্বাভাবিক ঘটনাবলিকে এড়িয়ে যেতে লাগলাম।কাজটা সহজ ছিল না। কিন্তু ২০ বছর বয়সে এসে চারপাশের অস্বাভাবিক ঘটনা দিয়ে আর তাড়িত হলাম না।


এগুলোকে বিশ্বাস করাও বাদ দিলাম। সে রকম কিছু ঘটলে আমি নজর দিতাম না, চিন্তাও করতাম না। এই কাজের কোনো সুনির্দিষ্ট ফল ছিল না। তবুও আমি খুশি হলাম। আমার মধ্যে কিছুটা ভূতবিরোধী আচরণ কাজ করতে লাগল। ভেঙে বলি। যখন কোনো ভৌতিক স্থানে যেতাম, তখন সেখানকার যেকোনো ধরনের অস্বাভাবিক ব্যাপার অনুভব করা ছেড়ে দিলাম আমি। এটা আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠল। কারণ, আমি মনে করি, যারা ভূতের দিকে নজর দেয় না, ভূতও তাদের বিরক্ত করে না।
আমি যখন শেষবার এক ভৌতিক স্থানে গেলাম, সেখানে তাদের অনুভব করতে পারলাম। আমার উপস্থিতিতে তারা অস্বাভাবিক কাজকর্ম বন্ধ করল না। আমার বাসার পাশে একটা বাড়ি ছিল। খুব সুন্দর। ইট আর পাথরে তৈরি। একদিন বাড়িটি বিক্রির নোটিশ দেখলাম। আমার খুব কিনতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু এ বয়সে সেটা কেনার সামর্থ্য আমার ছিল না। তাই যতবারই বাড়িটার সামনে দিয়ে যেতাম, ততবারই নিজের মধ্যে একটা বেদনাবোধ কাজ করত।
বাড়িটা তখন খালি ছিল। একদিন মালিককে ফোন করে আমি বাড়িটা দেখার ব্যবস্থা করলাম। ঘুরে দেখতে দেখতে বাড়িটার আরও প্রেমে পড়ে গেলাম। ঘটনাচক্রে বাড়ির ভেতর নিজের নাম দেখে চমকে গেলাম আমি! রান্নাঘরের একটা আলমারিতে একটা পর্দার বাক্স ছিল। সেই বাক্সে আমার নাম লেখা ছিল। সত্যি কথা বলতে, বাড়িতে ঢুকে প্রথমেই আমার খটকা লেগেছিল। এটাকে যেরকম খালি দেখাচ্ছে, সে রকম খালি যে নয়_ বুঝলাম। বুঝতে পেরে গা ছমছম করে উঠল আমার।
কিনতে না পারলেও বাড়িটাতে ভাড়ায় উঠলাম আমি। আমার রুমমেট আর আমি সারাদিন জিনিসপত্র আনছিলাম। সারাদিন ধরেই আমার মনে হচ্ছিল, অন্য রুম থেকে কেউ আমার নাম ধরে ডাকছে। জবাবে 'কী?' বললাম। রুমমেটের সামনে গেলাম। সে বলল, সে ডাকেনি আমাকে। আরও কয়েকবার এ রকম হওয়ার পর নিশ্চিত হলাম, রুমমেট ডাকেনি আমাকে। ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতে গেলাম। তাই সাড়া দেওয়া বন্ধ করে দিলাম। সেদিন সারাদিন পিছনের দরজাটা বারবার বাড়ি খাচ্ছিল। নিজের চোখে দেখার আগে এ কথা আমার রুমমেট বিশ্বাস করল না। আর দেখেই ভীষণ ভয় পেয়ে গেল সে। সেই মুহূর্তে আমার একটু অস্বস্তি লাগল। কারণ, সুন্দর বাড়িটা ততক্ষণে মনের ভেতর ভৌতিক রূপ ধারণ করেছে। আমি ভাবলাম, ব্যাপার না; এটা এখন আমার বাড়ি, এটা আমার জন্য তৈরি হয়েছে, আর আমি এটাকে ছেড়ে যাব না।
সাড়া দেওয়া বন্ধ করতেই ডাকাডাকিও থেমে গেল। দরজাটাও আর বাড়ি খেল না। তাই রুমমেটকে পাঠালাম তার বাড়ি থেকে বাকি জিনিসপত্র নিয়ে আসার জন্য। আর জোরে জোরে তাকে বললাম, 'তুমি এমন শব্দ করে পেছনের দরজা বন্ধ করতে পার না। আমার একটা বিড়াল আছে, সেটা বাইরে চলে যেতে পারে। আমি এটা বরদাস্ত করব না। ভিতরের দরজা নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই; কিন্তু বাইরের দরজা বন্ধ রাখতে হবে।' আর ভয়ানকভাবেই সেইদিনই সেরকম হওয়া থেমে গেল। বাড়ির ভেতরের দরজাগুলো নিয়েও আর কিছু ঘটল না।
যখন থেকে এই বাড়িতে এসেছি, টুকটাক কিছু ঘটনা ঘটেছে। তেমন বড় কিছু কখনও হয়নি। সবকিছুরই ব্যাখ্যা থাকে। এই বাড়িটা পুরনো। তাই এ রকম আচরণ স্বাভাবিক। একটা ব্যাপার ঘটেছিল, একদিন আমি কাজে যাওয়ার জন্য বের হব, তখনই স্টোভ থেকে একটা প্যান উড়ে এসে আমার সামনে পড়ল। সেটা আমার দিকে ছোড়া হয়েছে বলে মনে হচ্ছি না; বরং আমার বাইরে যাওয়া ঠেকানোর জন্যই যেন এ কাজ। যেন আমার বাসায় থাকাটাই পছন্দ এ বাড়ির অদৃশ্য বাসিন্দাদের! রুমমেট ভয় পেলেও আমি তাই বাড়িটি ছাড়িনি এখনও।

No comments

Powered by Blogger.