ভারতীয় প্রকল্প বাতিলেই সমাধান-টিপাইমুখ by তারেক শামসুর রেহমান

টিপাইমুখে প্রস্তাবিত বাঁধ নির্মাণ নিয়ে রাজনীতি এখন উত্তপ্ত। বাংলাদেশের চলমান রাজনীতিতে এটা একটা নতুন মাত্রা পেয়েছে। সনাতন রাজনৈতিক সংস্কৃতির মতোই এই বাঁধ নির্মাণের বিষয়টি নিয়ে সরকারি দল ও বিরোধী দলের অবস্থান পরস্পরবিরোধী। খালেদা জিয়া ইতিমধ্যে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে একটি চিঠি দিয়েছেন, যেখানে তিনি যৌথ সমীক্ষার প্রস্তাব করেছেন। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার এই ভূমিকার সমালোচনা করেছেন।


প্রধানমন্ত্রী দাবি করেছেন, তাদের শাসনামলে এই সমস্যা সৃষ্টি হয়নি। বিএনপির আমলে এই সমস্যার সৃষ্টি এবং তখন বিএনপি কিছুই করেনি। এর প্রতিউত্তরে বিএনপির মহাসচিব জানিয়েছেন, তাদের আমলে তিনটি চিঠি লেখা হয়েছে। এই উত্তর ও প্রতিউত্তরের মধ্য দিয়ে টিপাইমুখ ইস্যুটি বাংলাদেশের চলমান রাজনীতিতে নতুন একটি মাত্রা পেয়েছে। তবে একটা আশার কথা, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার চিঠির জবাব দিয়েছেন।
ভারতের টিপাইমুখ হাইড্রোইলেকট্রিক প্রজেক্ট নিয়ে সম্প্রতি নয়াদিলি্লতে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এখন যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, বাংলাদেশের এখন করণীয় কী? স্বাধীন বাংলাদেশের গত ৪০ বছরের ইতিহাসে বোধকরি এই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আস্থা রাখার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নে আস্থা রেখেই নিজেদের স্বার্থ আদায় করে নিতে হয়। যে কোনো দেশের পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে এই জাতীয় স্বার্থের বিষয়টি গুরুত্ব পায় অনেক বেশি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এর কোনো ব্যতিক্রম নয়। টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের প্রশ্নে এই জাতীয় স্বার্থের বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে টিপাইমুখ প্রশ্নে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে করে এই জাতীয় স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হবে, সে ব্যাপারে আমার সন্দেহ রয়েছে যথেষ্ট। গত ২৪ নভেম্বর সংবাদ সম্মেলনে তার দেওয়া বক্তব্যের কয়েকটি দিক বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এক. টিপাইমুখ প্রশ্নে ভারতের বক্তব্যে বাংলাদেশ পুরোপুরি আশ্বস্ত; দুই. যৌথ সমীক্ষা চায় বাংলাদেশ; তিন. বিরোধী দল কর্তৃক সরকারকে সহযোগিতার ঘোষণা ইন্টারেস্টিং; চার. একটি উচ্চ প্রতিনিধি দলকে নয়াদিলি্ল পাঠানো হবে; পাঁচ. জেআরসির বৈঠকে টিপাইমুখ নিয়ে কখনও আলোচনা হয়নি; ছয়. নেপালের সঙ্গে ৩২৭ মিটার উঁচু জলবিদ্যুৎ বাঁধ নির্মাণ নিয়ে যখন আলোচনা হচ্ছে, তখন কেউ এ বিষয়ে কোনো কথা বলে না। শুধু টিপাইমুখ নিয়ে বলে। তার এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে টিপাইমুখ প্রশ্নে বাংলাদেশের অবস্থান কিছুটা পরিষ্কার হয়েছে। কিন্তু টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের প্রশ্নে ভারতকে নিবৃত্ত রাখা যাবে কি-না, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীও বলেছেন, একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল নয়াদিলি্ল যাবে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই প্রতিনিধি দল গেলেই কি ভারত টিপাইমুখে কাজ বন্ধ করে দেবে? ২০০৯ সালেও একটি সংসদীয় প্রতিনিধি দল নয়াদিলি্ল তথা টিপাইমুখে গিয়েছিল। তাতে তো কোনো কাজ হয়নি। আবারও একটি প্রতিনিধি দল যদি ভারতে যায়, তা 'লোক দেখানো' হয়ে যেতে পারে। তবে কোনো সরকারি প্রতিনিধি দল না পাঠিয়ে একটি বিশেষজ্ঞ টিম সেখানে পাঠানো উচিত। বিরোধী দল একজন বা দু'জন প্রতিনিধির নাম প্রস্তাব করবে, তাদেরও এই টিমে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। তারা সেখানে তথ্য-উপাত্ত যাচাই করবে এবং দেশে ফিরে এসে তা জাতিকে অবহিত করবে। বিরোধী দলনেত্রী সহযোগিতার যে প্রস্তাব দিয়েছেন, তা সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করে ভবিষ্যৎ করণীয় কী, এ ব্যাপারে বিরোধী দলের মতামত নেওয়া যেতে পারে। সরকার ও বিরোধী দলের মাঝে যে আস্থাহীনতার সৃষ্টি হয়েছে, এই সুযোগে সেই আস্থাহীনতা কাটিয়ে ওঠার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। উদ্যোগটি নিতে হবে সরকারকেই। অতীতমুখিতা আমাদের রাজনৈতিক, সংস্কৃতির একটি অংশ। প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা অতীতের অভিজ্ঞতাকে টেনে নিয়ে আসি। টিপাইমুখের ক্ষেত্রেও তেমনটি হয়েছে। অতীতমুখিতা সমস্যা সমাধানে কোনো ভূমিকা রাখে না। বরং তিক্ততার জন্ম দেয়। অতীতে বিএনপি টিপাইমুখ নিয়ে কোনো কথা বলেনি বলে কি বর্তমান সরকার বলবে না! জনগণ তাদের দায়িত্ব দিয়েছে। জনগণের দেখভাল করার দায়িত্ব তাদের। মনে রাখতে হবে, বৃহত্তর সিলেট জেলা আজ বড় ধরনের পরিবেশগত ঝুঁকির মুখে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এটা একটা ইস্যু হয়ে যেতে পারে। সুতরাং সরকারি দলের স্থানীয় নেতৃবৃন্দকে টিপাইমুখ প্রশ্নে সোচ্চার হতে হবে। জনগণের আস্থা অর্জন করতে হলে এটা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। একটি যৌথ সমীক্ষার প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু অভিজ্ঞতা বলে, ভারত এ ধরনের প্রস্তাবে কখনোই রাজি হবে না। সে ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রস্তাব কাগজ-কলমে থেকে যেতে পারে। সরকার স্বউদ্যোগে একটি সমীক্ষা চালাতে পারে। ওই সমীক্ষায় বেরিয়ে আসবে পরিবেশগত কী কী সমস্যা হতে পারে বাঁধ নির্মাণ করার ফলে। বাংলাদেশ দাতাগোষ্ঠীর সহযোগিতাও নিতে পারে সমীক্ষা পরিচালনার জন্য। সমীক্ষার ওই ফল নিয়ে ভারতের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা যেতে পারে। যৌথ নদী কমিশন বা জেআরসির বৈঠকের কথাও বলা হচ্ছে। এ জন্য অতীতের কোনো বাংলাদেশ সরকারকেই দায়ী করা যাবে না। ভারত জেআরসির বৈঠকগুলো ব্যবহার করেছে তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য। জেআরসির বৈঠকের ব্যাপারে বাংলাদেশের আগ্রহ থাকলেও ভারতের আগ্রহ ছিল কম। আলোচনার কোনো বিকল্প নেই। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে অবশ্যই ভারতের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। সে সঙ্গে বিশ্ব আসরে এ সমস্যাটা তুলে ধরাও প্রয়োজন। কেননা পরিবেশগত সমস্যার ব্যাপারে সারাবিশ্ব আজ অত্যন্ত সচেতন। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যে একটি বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হতে যাচ্ছে, সেটা বলা কোনো অপরাধ নয়। আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহার সংক্রান্ত হেলসিংকি নীতিমালা, ১৯৯২ সালে প্রণীত ডাবলিন নীতিমালা, আন্তর্জাতিক জলপ্রবাহ কনভেনশন বা সার কনভেনশন (জলাভূমি বিষয়ক), জীববৈচিত্র্য কনভেনশন, প্রতিটি আন্তর্জাতিক আইনে ভাটির দেশের অধিকার রক্ষিত। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ওই আইনে বর্ণিত অধিকার বলেই দেশটির সমস্যার কথা তুলে ধরতে পারে। অতীতে ভারত যখন একতরফাভাবে গঙ্গার পানি প্রত্যাহার করে নিয়েছিল, তখন বাংলাদেশ ১৯৭৬ সালে আন্তর্জাতিক আসরে তার সমস্যার কথা তুলে ধরেছিল। ফলে ১৯৭৭ সালে প্রথমবারের মতো গঙ্গার পানি বণ্টনের ব্যাপারে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ডারবানে এই ডিসেম্বরে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত ঈঙচ ১৭ঃয সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। বেশ ক'টি এনজিও বেসরকারি প্রতিনিধি দল হিসেবে ওই সম্মেলনে অংশ নেবে। তারাও টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণ সংক্রান্ত বিষয়টি বিশ্ববাসীকে জানাতে পারে। সারাবিশ্বই আজ বড় বড় বাঁধের ব্যাপারে সোচ্চার। বাঁধ নির্মাণের ফলে হাজার হাজার লোক গৃহহীন হয়, স্থানীয় আদিবাসীরা তাদের শত বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হারিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নেয়_ এটা আজ আন্তর্জাতিকভাবেই ঘৃণিত একটি কাজ হিসেবে গণ্য হয়। মণিপুরে টিপাইমুখে ওই বাঁধটি নির্মিত হলে ওই এলাকার বেশ কিছু গ্রাম পানির নিচে তলিয়ে যাবে। শত শত স্থানীয় আদিবাসী নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ হবে। আন্তর্জাতিক আইন এটা অনুমোদন করে না। ভারত আরও একটি বিষয়ে লুকোচুরির আশ্রয় নিচ্ছে। টিপাইমুখের আরও উজানে আসামের কাছাড় জেলার ফুলেরতাল নামক স্থানে (সেচের জন্য) ভারত একটি ব্যারাজ তৈরি করছে। এর ফলে বরাক নদী থেকে ভারত কিছু পানি প্রত্যাহার করে নেবে। এই বিষয়টি ভারত খোলাসা করছে না। টিপাইমুখ নিয়ে চুক্তির কথা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলেও ফুলেরতাল ব্যারাজ নিয়ে সে সংবাদ প্রকাশিত হয়নি।
টিপাইমুখ নিয়ে মানুষের যে উৎকণ্ঠা, তা যে শুধু বাংলাদেশেই তা নয়। বরং ভারতের 'সাতবোন' রাজ্যের মধ্যে তিনটি রাজ্যে মণিপুর, আসাম ও মিজোরামেও এই উৎকণ্ঠা আমরা লক্ষ্য করেছি। অতি সম্প্রতি ভারতের ওই রাজ্যগুলোর ৩০টি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন নিয়ে গঠিত হয়েছে 'কমিটি অন পিপলস অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট' (কোপে)। টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের ফলে ওই অঞ্চলে যে ক্ষতি হবে, তার প্রতিবাদ করতেই তারা ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। বাংলাদেশের পরিবেশবাদীরা এখন 'কোপের' সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে পারেন। ডারবানে যৌথভাবেও বিষয়টি উত্থাপন করা যায়। মনে রাখতে হবে, ভারতে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে। যত দূর জানা যায়, তাতে দেখা গেছে ভারত সরকার উত্তর-পূর্ব ভারতে ২২৬টি বড় বাঁধ নির্মাণের সম্ভাব্য স্থান নির্ধারণ করছে। যার লক্ষ্য হবে আগামী ৫০ বছরের মধ্যে ৯৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা। ইতিমধ্যে সেখানে ১৬টি বৃহৎ বাঁধ চালু হয়েছে এবং ৮টি বৃহৎ বাঁধ নির্মাণাধীন। পানি সম্পদমন্ত্রী গত ২৬ নভেম্বর একটি সেমিনারে বলেছেন, 'বাংলাদেশের সম্পত্তি ছাড়া ভারত টিপাইমুখ প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে দেশের স্বার্থে প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক আদালতে যাব।' পানি সম্পদমন্ত্রীর এই বক্তব্যের মাঝে 'রাজনীতি' কতটুকু কিংবা 'বাস্তবতা' কতটুকু তা ভিন্ন প্রশ্ন। এই মুহূর্তে যা দরকার তা হচ্ছে ভারতকে ওই প্রকল্প বাতিল করতে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পর্যায়ে উদ্যোগ নেওয়া ও সে সঙ্গে এই অঞ্চলের পানি ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে হিমালয় অঞ্চলভুক্ত দেশ ও চীনের সমন্বয়ে একটি ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা। আর অভ্যন্তরীণভাবে যে বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি, তা হচ্ছে পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষ মনোভাব পরিত্যাগ করে জাতীয় স্বার্থে একটি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা।

ড. তারেক শামসুর রেহমান : প্রফেসর, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yohoo.com

No comments

Powered by Blogger.