‘জামিন দেওয়া হলে খারাপ নজির সৃষ্টি হবে’ মন্ত্রীর ভাইসহ তিন আসামি হাইকোর্টে, জামিন হয়নি

নরসিংদী পৌরসভার মেয়র লোকমান হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত তিন আসামির জামিনের আবেদন হাইকোর্ট গতকাল সোমবার ফিরিয়ে দিয়েছেন। আদালত বলেছেন, ‘জামিন দেওয়া হলে খারাপ নজির সৃষ্টি হবে। আমরা বিবেকের কাছে বন্দী।’ পুলিশের খাতায় পলাতক এই তিন আসামি হলেন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর ছোট ভাই সালাউদ্দিন আহমেদ, মন্ত্রীর একান্ত সহকারী সচিব (এপিএস) মাসুদুর রহমান ও নরসিংদী শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি মন্তাজউদ্দিন ভূঁইয়া।
নরসিংদী জেলা পুলিশ সুপার খন্দকার মহিদউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেছেন, পলাতক এই তিন আসামির গতকাল হাইকোর্টে হাজির হওয়ার খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশকে (ডিবি) অবহিত করেছেন। কিন্তু ডিবি পৌঁছানোর আগেই আসামিরা আদালত এলাকা ত্যাগ করেন। তাই তাঁদের ধরা যায়নি।
এ ছাড়া লোকমান হত্যার ঘটনায় ভাড়াটে খুনি সন্দেহে গোপালগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার করা টিপন কাজীকে (৩০) গতকাল আট দিনের রিমান্ডে নিয়েছে নরসিংদী পুুলিশ।
আর গতকাল সকালে হাইকোর্টে হাজির হন তিন আসামি—সালাউদ্দিন, মাসুদুর রহমান ও মন্তাজউদ্দিন। বেলা সোয়া ১১টায় বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন ও বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে তাঁদের জামিনের বিষয়ে শুনানি হয়। প্রায় এক ঘণ্টা শুনানিকালে তিন আসামি আদালতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। শুনানির পর তাঁরা এজলাসকক্ষ ত্যাগ করেন।
আবেদনকারীদের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী আনিসুল হক। আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সেলিম।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আনিসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, আদালত আবেদনটি ফেরত দিয়েছেন। আর ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সেলিম বলেছেন, আদালত আবেদনটি দৈনন্দিন কার্যতালিকা থেকে বাদ দিয়েছেন।
শুনানি: সকালে আদালতে শুনানিতে আইনজীবী আনিসুল হক আবেদনকারী তিনজনের জামিনের আরজি জানান। আদালত জানতে চান, ‘নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ না করে সরাসরি হাইকোর্টে কেন এলেন।’ জবাবে আনিসুল হক বলেন, ‘পরিস্থিতি খারাপ না হলে আমরা (আবেদনকারীরা) এখানে আসতাম না।’
আদালত প্রশ্ন রাখেন, ‘এ ধরনের হত্যা মামলায় জামিন দিয়ে কি নজির তৈরি করব? ...আপনারা চাইলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দিই, নিরাপত্তা দিয়ে নিয়ে যাবে।’
আনিসুল হক বলেন, ‘আমাদের তো জীবনের ভয় আছে। ওখানে যাওয়ার মতো কোনো পরিবেশ নেই। সেখানে গেলে একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে। ৩০ দিনের জন্য জামিন দেন। পুলিশ প্রহরায় নিয়ে যাওয়ার পর পরিস্থিতি অন্য রকম হতে পারে।’ তিনি এক মাসের জন্য জামিন দিয়ে আবেদন নিষ্পত্তি করার আরজি জানান।
জামিনের বিরোধিতা করে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সেলিম বলেন, লোকমান মারা যাওয়ার আগে ষড়যন্ত্রকারীদের নাম বলে গেছেন বলে এজাহারে উল্লেখ আছে। এ ধরনের হত্যা মামলায় জামিন দেওয়া যায় না।
এই পর্যায়ে আদালত বলেন, ‘জনপ্রিয় একজন মেয়রকে এভাবে মেরে ফেলা ব্যতিক্রম। এ দেশে কি ভালো মানুষ থাকবে না তাহলে?’
আনিসুল হক আবারও বলেন, ‘পরিস্থিতি খারাপ না হলে এখানে আসতাম না। ৩০ দিনের জন্য জামিন দেন। আদালতের নির্দেশনা মেনে এই সময়ের মধ্যে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করব।’
এরপর ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল রাষ্ট্র বনাম জাকারিয়া পিন্টুর মামলার আপিল বিভাগের রায়ের নজির তুলে ধরেন। তিনি বলেন, হত্যা, ধর্ষণ ও নাশকতার মামলায় আগাম জামিন দেওয়ার সুযোগ নেই।
একপর্যায়ে আদালত বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করেছি। কিন্তু জামিন দিতে পারছি না। আমরা বিবেকের কাছে বন্দী। ভালো হয়, আবেদনটি নিয়ে যান।’
সর্বশেষ আনিসুল হক অন্তত ১৫ দিনের জন্য পুলিশ যেন গ্রেপ্তার বা হয়রানি না করে, সে জন্য আদালতের নির্দেশনা চেয়ে আরজি জানান।
রিমান্ডে সন্দেহভাজন ভাড়াটে খুনি: প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক, ভৈরব ও নরসিংদী প্রতিনিধি জানান, লোকমান হত্যা মামলায় গোপালগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার হওয়া সন্দেহভাজন ভাড়াটে খুনি কাজী মাসুদুর রহমান ওরফে টিপন কাজী ওরফে পংকাকে (৩০) গতকাল দুপুরে নরসিংদীর মুখ্য বিচারিক হাকিমের আদালতে হাজির করে পুলিশ।
পুলিশ টিপন কাজীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করে। বিচারক নিতাই চন্দ্র সাহা আট দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
নরসিংদী পুলিশ জানায়, টিপন কাজীর বিরুদ্ধে সদর থানায় চারটি হত্যা মামলা রয়েছে। তিনি ১৯৯৯ সালে যুবলীগের নেতা লিটু মিয়া হত্যা, ২০০৫ সালে নজরুল হত্যা, ২০০২ সালে মধু স্বপন হত্যা ও ২০০৩ সালে শান্ত হত্যা মামলার আসামি। এ ছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে জেলার বিভিন্ন থানায় চাঁদাবাজি, অস্ত্র, ছিনতাই, ডাকাতির আরও ১৭টি মামলা রয়েছে।
টিপন কাজীর বাড়ি নরসিংদীর সাটিরপাড়ায়। সেখানকার স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, টিপনের কোনো দলীয় পরিচয় নেই। তিনি নিজেকে জমি ও মাটি বেচাকেনার ব্যবসায়ী বলে পরিচয় দিতেন। তবে মাদক ও অস্ত্র ব্যবসায়ী হিসেবে তাঁর পরিচিতি রয়েছে। তাঁর দাদার বাড়ি গোপালগঞ্জের গোপীনাথপুর গ্রামে। তাঁর বাবা নরসিংদীতে স্থায়ী আবাস গড়েন। তিনি নরসিংদীর ইউএমসি জুট মিলের সাবেক উপব্যবস্থাপক।
গতকাল টিপনের বাড়িতে গিয়ে কথা হয় তাঁর মা ও বড় ভাইয়ের সঙ্গে। মা মাবিয়া নূর দাবি করেন, টিপন পলাতক ছিলেন না। তিনি ঈদে কোরবানি দিতে দাদার বাড়ি গোপালগঞ্জের গোপীনাথপুরে গিয়েছিলেন।
মাবিয়া নূর অভিযোগ করেন, ‘লোকমান হত্যা নিয়ে সরকার বিপাকে আছে। তাদের আসামি প্রয়োজন। সে কারণে আমার ছেলেকে ধরে আরেক জজ মিয়া কাহিনি বানাতে চায়।’
একই দাবি করেন টিপনের বড় ভাই কাজী ফারুক আহমেদও।
তাহলে টিপনের বিরুদ্ধে চারটি হত্যা মামলাসহ ২১টি মামলা হলো কীভাবে, এই প্রশ্নের জবাবে কাজী ফারুক আহমেদ বলেন, ‘আগে আমার ভাই কিছুটা বিপথগামী ছিল। তবে এখন তাকে খারাপ বলা যাবে না।’
নরসিংদী পুলিশ সুপার খন্দকার মহিদউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, লোকমান হত্যার পর একটি মোটরসাইকেল উদ্ধার হওয়ার সূত্র ধরে টিপন ও সেলিম নামের দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে নিশ্চিত হওয়া গেছে, তাঁরা দুজন হত্যার সঙ্গে জড়িত।
৮ নভেম্বর রাতে গাজীপুরের টঙ্গী থেকে গ্রেপ্তার করা সেলিমকে (৩৮) রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
১ নভেম্বর নরসিংদী পৌরসভার মেয়র লোকমানকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এরপর তাঁর ছোট ভাই কামরুজ্জামান বাদী হয়ে ১৪ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন।

No comments

Powered by Blogger.