শেখ হাসিনার উদ্দেশ্যে খোলা চিঠি by শহীদুল্লাহ ফরায়জী
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আপনি এক মাসের অধিক দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। অবশ্য বাইরে থাকাটাকে আপনিই স্বেচ্ছায় বরণ করে নিয়েছেন। আপনি যখন বুঝতে পেরেছেন-সর্বগ্রাসী ক্ষমতা আপনার জীবনকে আর সুরক্ষা দিতে পারছে না, তখন দেশ, জনগণ এবং আওয়ামী লীগকে রেখে, বাংলার মাটিকে রক্তরঞ্জিত করে দেশান্তরিত হয়েছেন। আপনি এখনো উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হচ্ছেন, পিতার দেশ রেখে, আওয়ামী লীগকে রেখে মাতৃভূমি পরিত্যাগ করা কতো মর্মান্তিক এবং লজ্জাজনক, এতে আপনার নৈতিক শক্তির সামর্থ্য শেষ হয়ে গিয়েছে। আপনার বিবেচনাহীন অহংবোধ ও দাম্ভিকতা আপনাকে এই পরিণতির দিকে নিয়ে গেছে।
আপনি বুঝতেও পারেননি, বারবার ভোটবিহীন ক্ষমতা ধরে রাখতে গিয়ে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণ ও প্রতিরক্ষা শক্তিকে দুর্বল করতে গিয়ে-রাষ্ট্রকে কী ভয়ঙ্কর সর্বনাশে ফেলে দিয়ে গেছেন। রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে কতোটা ঝুঁকিপূর্ণ করে গেছেন। আপনি ভেবেছিলেন- জনগণ নয়, রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে এবং বাইরের শক্তির সমর্থনে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করা যায় কিন্তু আপনি একবারও ভাবেননি, ১৯০০ সালে যে বৃটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য অস্ত যেতো না, ১১ বিলিয়ন স্কয়ার মাইল ভূমি এবং ৩৯০ মিলিয়ন মানুষ যে সাম্রাজ্যের অধীনস্থ ছিল, সে সাম্রাজ্যও প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়েছে, এমনকি বাস্তিল দুর্গেরও পতন হয়েছে। ক্ষমতার উদ্ভব, উত্থান এবং পতন নিয়ে বিপুল আয়তনের জ্ঞানগর্ভ আলোচনা রয়েছে কিন্তু সে সব বিবেচনা করার ন্যূনতম প্রয়োজনও আপনি বোধ করেননি।
আপনি প্রায়ই বলতেন- ভোট চুরি করলে বাংলার জনগণ ক্ষমতায় থাকতে দেয় না। সত্যি, আপনি ক্ষমতা হারিয়েছেন এবং জনগণ আপনাকে ক্ষমতায় থাকতে দেয়নি। শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরকে আপনি রুদ্ধ করেছিলেন, ফলে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আপনাকে উৎখাত করাই ছিল একমাত্র গণতান্ত্রিক এবং সাংবিধানিক পথ। আপনি ক্ষমতা ধরে রাখতে গিয়ে প্রচণ্ড রক্তপাতের আশ্রয় নিয়েছেন, রাষ্ট্রকে যুদ্ধাবস্থায় নিয়ে গেছেন, জনগণের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন হয়ে গণমানুষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। ফলে ছাত্র-জনতাসহ প্রজাতন্ত্রের সেনাবাহিনীর ঐতিহাসিক ভূমিকা আপনার পতনকে অনিবার্য করে তোলে। ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় এর কোনো বিকল্প ছিল না। কারণ, রাষ্ট্রের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হলেও আপনার ‘ক্ষমতা তৃষ্ণা’ নিবৃত হতো না, তা জনগণ যেমন জানে তেমনি আপনার দলও জানে।
আপনি এখন নিশ্চয়ই অবসর পেয়েছেন অনেক। কিন্তু দেশের রাজনীতি নিয়ে মাঝে মধ্যে মন্তব্য করছেন, বিবৃতি দিচ্ছেন, ইন্টারভিউ দিচ্ছেন। দেশ এবং জনগণ তো দূরের কথা, আওয়ামী লীগের করণীয় নিয়েও আপনার রাজনীতির পরিসমাপ্তি ঘটে গেছে। কারণ, আওয়ামী লীগকেও আপনি নিজ হাতে শেষ করেছেন। পালিয়ে নিজ জীবন বাঁচাতে গিয়ে দলসহ সবকিছু ‘পরিত্যাগ’ এবং ‘পরিত্যক্ত’ করে চলে গেছেন। যেহেতু জানতেন দেশ ত্যাগ করছেন, কিন্তু দলীয় নেতাকর্মীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। বরং আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহ্যবাহী একটি রাজনৈতিক দলকে গণহত্যায় অভিযুক্ত করে পরিচয় সংকটে ফেলেছেন। আপনার ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থা থেকে সরে এসে, রাষ্ট্র কীভাবে নির্মিত হবে, তা এদেশের জনগণ, দলীয় এবং অদলীয় শক্তিসমূহ নির্ধারণ করছে। দেশত্যাগ করে দিল্লিতে অবস্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রের প্রতি বা দলের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করার কোনো নৈতিক অবস্থান আপনার নেই।
জীবনের বাকি দিনগুলো ‘চুপ’ এবং শুধুমাত্র ’চুপ’ থাকাটাই আপনার একমাত্র কর্তব্য। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, নোবেলজয়ী বিশ্ববরেণ্য ড. ইউনূস আপনাকে সেই উপদেশই দিয়েছেন। রাষ্ট্র ক্ষমতায় থেকে কীভাবে ন্যায়পরায়ণতা ধ্বংস করেছেন, কীভাবে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করেছেন, কারাগারে পাঠানোর নামে রাজনীতিবিদদের প্রতি কী নির্মম আচরণ করেছেন, বিচারের নামে কী ভয়ঙ্কর অবিচার করেছেন, মিথ্যাকে কীভাবে গৌরবের অংশীদার করেছেন-এসব নিয়ে অনুশোচনা করাই হবে আপনার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান। অতীতকে অস্বীকার বা তুচ্ছ করার সাধ্য কারও নেই। বাংলাদেশ আছে, আপনার নাগরিকত্বও আছে অথচ প্রতিবেশী দেশে আপনি উদ্বাস্তু এবং গৃহহীন। আপনি এখন তাদের অতিথি নন বরং গলার কাঁটা। এটাই ভাগ্যের লিখন, এটাই মেনে নিতে হবে, কারণ সবকিছুই সুনির্দিষ্ট ও সুনির্ধারিত এবং তা অবশ্যই লঙ্ঘনের অযোগ্য।
আমি বিশ্বাস করি, আপনি গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত হয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নিজের কৃতকর্মের দায় স্বীকার করবেন। রাষ্ট্র এবং রাজকোষ পরিচালনায় আপনার অযোগ্যতা ও স্বজন তোষণনীতি স্বীকার করে, নিজের দায় বহন করার সত্য উন্মোচিত করবেন। অহেতুক কালক্ষেপণ না করে রাষ্ট্র এবং আদালতকে সহযোগিতা করবেন। তাহলে যদি মর্যাদাহীন ও হীনমন্যতাবোধের (অপ্রকাশিত) পীড়া থেকে কিছুটা রেহাই মিলে! অন্যের ছত্রচ্ছায়ায় এবং অন্তরালে বসে, রাষ্ট্রের ক্ষতি হতে পারে এমন যেকোনো প্রচেষ্টা থেকে আপনার বিরত থাকা উচিত। পলায়নপর নিজেকে অন্য কোনো রাজশক্তির হাতের খেলনা করে দেশের ধ্বংস ডেকে আনবেন না। আপনি আর কখনোই রাজনৈতিক মশাল প্রজ্জ্বলিত করতে পারবেন না, আপনি যতই চেষ্টা করবেন ততই নির্বাপিত হবে। আপনার রাজনীতি ও বয়ান দেশের জনগণ খারিজ করে দিয়েছে। আপনার সীমা অতিক্রমের কারণে পরাজয় নিশ্চিত হয়েছে এবং দেশে নতুন রাজনৈতিক শক্তির উদ্ভব ঘটেছে। তারা অগণিত আত্মত্যাগের নির্যাস উপলব্ধি করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। সকলে সমানভাবে স্বাধিকার (LibertY) ভোগ করবে, পরস্পর মানবিক মর্যাদা সুরক্ষা করবে এবং সকলের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে। তারা সংবিধান সংশোধন করে-সম্পূর্ণ ন্যায্যসমাজ নির্মাণের অপরিহার্য দর্শনের অনুসন্ধান করবে।
জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আপনি একবার খেয়াল করে দেখুন, শুধু ক্ষমতাকে ধরে রাখার জন্য কতোজনের জীবন শেষ করে দিয়েছেন, কতো মায়ের আহাজারিকে দীর্ঘস্থায়ী করেছেন, কতো অমিত সম্ভাবনাকে ধূলিসাৎ করেছেন, কতোজনকে চিরতরে অন্ধ করেছেন। স্বজন হারানোর ব্যথা সত্যি সত্যিই আপনাকে মর্মপীড়ায় দংশন করলে আপনি লাশের বিনিময়ে ক্ষমতাকে প্রাধান্য দিতেন না। ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হওয়ার সময়ও আপনি কেঁদেছেন। ক্ষমতা আপনার কাছে কান্নার বিকল্প। রাষ্ট্রকে ব্যক্তিগত মনে করেছিলেন। ভেবেছিলেন আপনি রাষ্ট্রের সমকক্ষ। আরও ভেবেছিলেন রাষ্ট্রের আয়ু আর আপনার আয়ু সমান। এখন আপনি ছাড়াও রাষ্ট্র আছে, বিকল্পও আছে। আমরা না থাকলেও রাষ্ট্র থাকবে। রাষ্ট্রের আয়ুষ্কাল আর ব্যক্তির আয়ুষ্কাল এক হতে পারে না।
বঙ্গবন্ধু আপনার পিতা অথচ কয়েকশ’ ছাত্র-জনতা হত্যার পর আপনি স্থাপনার জন্য অশ্রু বিসর্জন দিয়েছেন। আপনার অশ্রুপাতের সেই মেট্রোরেল চালু হয়েছে ও বিটিভি চালু হয়েছে- কিন্তু ‘আবু সাঈদ’, ‘মুগ্ধ’সহ আমাদের অগণিত সন্তানতো না ফেরার দেশ থেকে আর ফেরত আসবে না। মা-বাবা’র আর্তনাদ জমিন থেকে কোনোদিন উবে যাবে না। পৃথিবীর এমন কোনো শাসক কী আছে, মাটির উপরে লাশ রেখে নির্জীব স্থাপনাকে শ্রদ্ধা করতে যায়! মানুষের মানবিক মর্যাদাকে এইভাবে বিপন্ন করা যায়! মানুষের জীবন সুরক্ষা রাষ্ট্রের সর্বোত্তম কর্তব্য, অথচ আপনি ক্রমাগত ও বিরামহীনভাবে তা উপেক্ষা করেছেন।
আপনি এবং আপনার পিতা ক্ষমতা বুঝেছেন কিন্তু ক্ষমতার খেসারত বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন। এক দেশ এক নেতা, এক নেতার পেছনে সমগ্র জাতি, সমগ্র ইতিহাস এইসব বয়ান জাতির অভিপ্রায়ের সঙ্গে যায় না। ভিন্ন মত-পথ ও অধিকারকে খর্ব করা বা বিলুপ্ত করার প্রচেষ্টাকে রাজনীতি বলে না। কন্যা হয়ে পিতাকে ক্রমাগত বলি দিয়েছেন, সভানেত্রী হয়ে দলকে গণহত্যায় সম্পৃক্ত করেছেন, সমাজ চৈতন্যকে রক্তাক্ত করেছেন, সরকার আর নাগরিকের মাঝে শিকারি ও শিকারের সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। এখন বিবেকের আয়নায় নিজেকে দেখে-দেখে চিরস্থায়ী প্রত্যাবর্তনের দিকে যাবার প্রস্তুতি নিন। মহান আল্লাহ আপনার গন্তব্য এবং পরিণতি নির্ধারণ করে রেখেছেন। এই রহস্য অনুধাবন করতে সচেষ্ট হন। দেশ ও দেশের রাজনীতি নিয়ে আপনার একটি কথাও মুখে না আনা ভালো। বিশ্বজয়ী সাহিত্যিক বরিস পাসতেরনাক বলেছিলেন-কথা যদি ‘রৌপ্য’ হয়, তাহলে নীরবতা হলো ‘সোনা’-এ চিরকালের সত্য। আপনি যা-ই ভাবুন তা-ই অন্তরালে রাখুন, কথা বললেই রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আপনার রেখে যাওয়া রাষ্ট্র অনেক বদলে গেছে, যাকে মানুষ দ্বিতীয় স্বাধীনতা হিসেবে বিবেচনা করছে। ছাত্র-জনতা দেশকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারছে, এইখানেই তাদের অসাধারণত্ব। সমাজকে পুরোপুরি ঢেলে সাজানো হচ্ছে। সকলের প্রতি ‘ন্যায্যতা’-এটাই হবে রাজনৈতিক বন্দোবস্তের ভিত্তি। জাতি এখন ঘৃণা এবং বিদ্বেষের অনুশাসন থেকে মুক্ত। রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত হবে ‘সাম্য’, ‘মানবিক মর্যাদা’ ও ‘সামাজিক সুবিচার’ দিয়ে। মনুষ্যত্বহীন রাজনীতির আখ্যান ছাত্ররা প্রত্যাখ্যান করেছে। এই প্রজন্মের রাজনীতি শুধু বেঁচে থাকা নয়, মানুষ হয়ে ওঠাও।
ক্ষমতা কারও জন্য চিরস্থায়ী নয়, আপনাকে ‘ক্ষমতা’ এবং ‘রাজনীতি’ পরিত্যাগ করেছে। সময় তার আপন গতিতে ফিরে গেছে-এই ধ্রুবসত্য মেনে নেয়াই হবে ন্যায়সঙ্গত। আমাদের সকলকেই ‘ন্যায্যতা উপলব্ধির সামর্থ্য’ এবং ‘শুভ চিন্তার সামর্থ্য’ অর্জন করতে হবে।
আপনার বিষয়ে বলাও সহজ নয় আবার চুপ থাকাও অসম্ভব। আপনার সঙ্গে যদি কোনোদিন কোনোকালে কোথাও দেখা হয়, আমি জুলাই গণহত্যায় শহীদ মুগ্ধের কণ্ঠে বলবো’- পানি লাগবে, পানি!’
ইতি-
শহীদুল্লাহ ফরায়জী,
৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ঢাকা।
(লেখক: গীতিকবি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক) (faraizees@gmail.com)
No comments