শিক্ষায় নিজস্ব সাম্রাজ্য গড়েছিলেন নওফেল by পিয়াস সরকার
মন্ত্রণালয় সাজান নিজের মতো করে। কয়েকজনকে সরিয়ে দেন দায়িত্ব থেকে। উপমন্ত্রী থাকাকালে বদলি বাণিজ্য শুরু করেন তিনি। একেকটি বদলির সুপারিশের জন্য নিতেন কয়েক লাখ টাকা। বদলি কার্যক্রম পরিচালনা করতেন মো. জুয়েল নামে এক অফিস সহকারীর মাধ্যমে। মহিবুল হাসান চৌধুরী সব সময় কুক্ষিগত করে রাখতে চাইতেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ছাত্রলীগের দু’টি গ্রুপের মধ্যে প্রায়ই সংঘর্ষের খবর পাওয়া যেত। এসব সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে মহিবুল হাসান চৌধুরী ও চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছিরের মদতপুষ্ট ছাত্রলীগের দুই পক্ষের বিরুদ্ধে। ছাত্রলীগের সংঘর্ষ নিয়ে বিভিন্ন সরকারি গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও উঠে আসে মহিবুল হাসান চৌধুরীর নাম। কিন্তু তাতে কোনো পাত্তাই দিতেন না তিনি।
উপমন্ত্রী থাকাকালে কুক্ষিগত করে রেখেছিলেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ড। ২০১৬ সালে কারিগরি শিক্ষার প্রচার ও প্রসারের জন্য সরকার থেকে থোক বরাদ্দ দেয়া শুরু হয়। যার জন্য প্রতি বছরে ১০০ কোটি টাকার থোক বরাদ্দ ছিল। উপমন্ত্রীর দায়িত্ব পাবার শেষ পর্যন্ত এই অর্থের প্রায় ৮০ শতাংশ নিজের পকেটে পুরেছেন তিনি। তার মালিকানাধীন বিজয় টিভিতে কারিগরি শিক্ষার প্রচারণা চালাতেন। এই বিজ্ঞাপনের টিআরপি রেট দেখাতেন প্রথম সারির টেলিভিশনের সমান। এর মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা।
এ ছাড়াও চট্টগ্রাম বোর্ডের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিলেন নিজের হাতে। এই বোর্ডের কেনাকাটার সব কাজ পেতেন তার বলয়ের ঠিকাদাররা। এর একটি নির্ধারিত অংশ কমিশন পেতেন তিনি। শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পাবার পর বিশ্ববিদ্যালয়টিতে নিজের অবস্থান শক্ত করতে বসান বাংলাদেশ মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) সদস্য অধ্যাপক আবু তাহেরকে। এর জন্য আবু তাহের চট্টগ্রামের প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে নওফেলকে মালিকানা পাইয়ে দিতে নানা অপতৎপরতা শুরু করেন। এরপর এটির মালিকানা নওফেলের হাতে চলে আসার পুরস্কারস্বরূপ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির দায়িত্ব পান অধ্যাপক আবু তাহের। তিনি নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন। আর্থিক অনিয়ম প্রমাণিত হওয়ায় চার বছর মেয়াদ পূর্তির আগেই তাকে বহিষ্কার করে ট্রাস্টি বোর্ড। আওয়ামী লীগের নেতাদের আস্থাভাজন আবু তাহের উল্টো পুরস্কারস্বরূপ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার পদে নিয়োগ পান। এখানেও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়লে তাকে কিছুদিনের মাথায় বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়াও ছিল না তার ভিসি হওয়ার যোগ্যতা। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি’তে দ্বিতীয় বিভাগ ও এইচএসসি পরীক্ষায় তৃতীয় বিভাগ ছিল তার।
প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল ডিভাইস প্রদানের একটি বড় প্রকল্প বাগিয়ে নেয়ার পথেই ছিলেন তিনি। মূলত শিক্ষার উন্নতি নয় তিনি এই দায়িত্বে এসেছিলেন দুর্নীতির জাল পাততে। কিন্তু সময়ের অভাবে পূরণ হয়নি এই দুর্নীতির ছক। দেশে ১০০’র উপরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে ঝোঁক ছিল তার। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশে শাখা খোলার জন্য যোগাযোগ করেছিলেন কয়েকটি দেশে। মূলত এসব বিশ্ববিদ্যালয় দেশে চালু রাখার সনদ দিয়ে বাকি অর্থনৈতিক বিষয়গুলো নিজের কব্জায় রাখার পরিকল্পনা ছিল তার। কাজ করছিলেন শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর ও বোর্ডগুলোতে নিজস্ব লোক পদায়নের।
২০২৩ সালে পুলিশের সার্জেন্ট নিয়োগে ৬ ছাত্রলীগ নেতা এবং একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগের জন্য সুপারিশ করেছিলেন নওফেল। এই দুটি নিয়োগের জন্য সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির কাছে সুপারিশ করেন তিনি। পরে তারা যোদদানও করেন। ডিও লেটারে ৬ জন ছাত্রলীগ নেতা হলেন- সুজয় বড়ুয়া, (সাবেক সদস্য, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা), আশীষ কুমার দাশ (সহ-সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা), মোহাম্মদ দেলোয়ার হোছাইন (গণশিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক, কুতুবদিয়া উপজেলা ছাত্রলীগ, কক্সবাজার), প্রহল্লাদ কুমার ঘোষ (সাবেক উপ-অর্থ বিষয়ক সম্পাদক বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ), ওমর ফারুক, উপ-ত্রাণ ও দুর্যোগ বিষয়ক বিষয়ক সম্পাদক (বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা) ও কাওসার আহমেদ (সহ-সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা)। রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ছাত্রলীগ নেতাকে খণ্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগের জন্য সুপারিশ করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ও পতেঙ্গা থানা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল হাসান সাব্বিরকে। সে বছরই তারা যোগদান করেন।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় খুব বাজে মন্তব্য করেছিলেন যে ক’জন মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তিনি। গত ১৫ই জুলাই নওফেল তার ভেরিফাইড ফেসবুক পোস্টে লিখেছিলেন, “যাদের মুখ থেকে বের হয়, আমি রাজাকার, তারা প্রমাণ করেছে তারা এ-যুগের ‘সাচ্চা’ রাজাকার! যারা প্রকাশ্যে নিজের আত্মপরিচয়, জন্মপরিচয়, ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে, ‘রাজাকার’ স্লোগান দিয়েছে, এরা সবাই এই যুগের রাজাকার। এরা আদালত মানে না, সরকারও মানে না, সুতরাং, এই রাষ্ট্রদ্রোহীদের পক্ষে এই রাষ্ট্রকে মানা সম্ভব না! সঠিক স্লোগানই ধরেছে তারা! বের হয়ে আসুক এ যুগের রাজাকারদের আসল চেহারা!” তিনি লেখেন, রাজাকার আগেও ছিল এবং এর ধারাবাহিকতায় এখনো আছে! ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে প্রায় ২০% শতাংশ ভোট পড়েছিল নেজামে ইসলামী, মুসলিম লীগ ইত্যাদি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী পক্ষ তথা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। এই ২০% এর অর্ধেক ১০% ধরে আজকের ১৬ কোটি মানুষের সঙ্গে মেলালে আসবে ১.৬ কোটি। এর মধ্যে ০.৬ কোটিও যদি সারাদিন নিজের রাজাকারির অরাজকতা প্রকাশ করে, বাকি জনগোষ্ঠীর তুলনায় এরা নগণ্যই থাকবে!
শিক্ষার্থীদের অভিভাবকের দায়িত্ব পাওয়া শিক্ষামন্ত্রী বারবরই ছিলেন শিক্ষার্থীদের আন্দোলনবিরোধী। আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের সহায়তা করায় প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে এ এস এম আব্দুল খালেক নামে এক কর্মকর্তাকে গত ২৯শে জুলাই তাকে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা, ঢাকা অঞ্চল থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর, ঢাকায় বদলি করা হয়। নানা দমনপীড়নের পরও শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থামাতে না পারায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা আসতে থাকে সরকারের পক্ষ থেকে। আন্দোলন দমাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধের জন্য ইউজিসিকে নির্দেশ দিতে বলেন তিনি। যা ছিল ইউজিসির এখতিয়ার বহির্ভূত। গত ১৬ই জুলাই ইউজিসি চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীরকে টেলিফোন করে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী জানান, একটা অর্ডার (নির্দেশ) আছে। এখনই করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ করতে হবে। কালকে আশুরার ছুটি, আজকেই বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ এবং হল খালি করার নির্দেশ দিতে হবে। আমার সঙ্গে সেতুমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং শিক্ষা সচিব রয়েছেন। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বলছি। আমাদের কাছে গোয়েন্দা প্রতিবেদন আছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ না হলে শত শত লাশ পড়বে।
ছাত্র-জনতা গত ৩রা আগস্ট চট্টগ্রামের নওফেলের বাড়িতে হামলা করে। সেই হামলার প্রতিবাদে পরদিন রাস্তায় নামেন বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের কিছু কর্মকর্তা। এর নেতৃত্বে ছিলেন মাউশির সদ্য পদত্যাগ করা মহাপরিচলক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ, মাধ্যমিক শাখার পরিচালক সৈয়দ জাফর আলীসহ চারজন পরিচালক। স্লোগান দেয়ার জন্য কর্মকর্তাদের একত্র করেন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর থেকে বদলি হওয়া ২৪তম বিসিএসের কর্মকর্তা ড. এনামুল হক ও আব্দুল্লাহ আল মামুন। সেখানে ডিআইএ, মাউশি ও বিভিন্ন প্রকল্পের ৩০ জন এই মিছিলে অংশ নেন। যারা সবাই গত সরকারের আমলে শিক্ষা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। জানা যায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে গিয়ে অবৈধ আর্থিক সুবিধা নেয়ায় ডিআইএ থেকে শরীয়তপুরে বদলি হন এনামুল হক। নতুন সরকারে নওফেল শিক্ষামন্ত্রী হওয়ার পর জাফর আলী মাউশির মাধ্যমিক শাখার পরিচালক হয়ে আসেন। এনামুল বদলির জন্য তদবির চলছিল। পূর্বের দায়িত্বে থাকা শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির সঙ্গে নানা কারণে দ্বন্দ্বের জেরে সৈয়দ জাফর আলীকে সরিয়ে দিয়েছিলেন।
দুর্নীতির সাম্রাজ্য গড়ে তোলা ডা. দীপু মনিকে শিক্ষা থেকে সরিয়ে দেবার পর হাল ধরেন নওফেল। নোট-গাইড প্রকাশনীর এক মালিক বলেন, দীপু মনিকে আমরা বছরে চারবার চাঁদা দিতাম। কিন্তু নওফেল দায়িত্ব পাবার পর এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে নতুন করে যোগাযোগ শুরু করেন। কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই সরে যেতে হয় তাকে। জানা যায়, এই অল্প সময়েই প্রায় ১০ কোটি টাকা নিয়েছেন শুধুমাত্র নোট-গাইড বইদের মালিক ও কোচিং সেন্টারের মালিকদের কাছ থেকে। তার বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মালিকানাসহ শেয়ার রয়েছে। এ ছাড়াও প্রভাব খাটিয়ে নিজেদের লোক ঢুকানোর পথে হাঁটছিলেন তিনি। এ ছাড়াও কয়েকটি ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে রয়েছে শেয়ারসহ মালিকানা। দীপু মনির দেখানো পথে হেঁটে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় দখলের পরিকল্পনা ছিল তার। বিশেষ করে ইউরোপিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে শুরু করতে চেয়েছিলেন তিনি। এ ছাড়াও আরও অন্তত চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তার নজর ছিল।
দায়িত্বে থাকা অবস্থায় কথায় কথায় জামায়াত-শিবির ট্যাগ লাগাতেন তিনি। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও তার আচরণে ছিলেন না খুশি। একগুঁয়েমি আচরণে বিরক্তই ছিলেন। জোড় গলায় কথা বলার পরও কয়েকটি সিদ্ধান্ত বাতিল হয় তার। সরকারি চাকরিতে বয়সের সীমা ৩৫ কারী আন্দোলনরতদের পক্ষে কথা বলে সমালোচনায় পড়েন খোদ মন্ত্রিসভাতেই। এ ছাড়াও দাবদাহের সময় জোরপূর্বক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার ঘোষণা দেন। কিন্তু একদিন পরই সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করে মন্ত্রণালয়। আবার শনিবারের ছুটি বাতিল করেও বেশ বিরাগভাজন হয়েছিলেন তিনি। সর্বস্তর থেকে নতুন শিক্ষাক্রম বাতিল ও সংস্কারের দাবি তোলা হলেও তিনি তাতে পরিচয় দেন একগুঁয়েমির।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দীন চৌধুরীর ছেলে নওফেল। বাবার রাজনৈতিক পরিচয় কাজে লাগিয়ে নিজে হয়ে উঠেন রাজনীতিক। দুর্নীতি দমন কমিশন তার অবৈধ উপায়ে বিপুল পরিমাণ সম্পদের খোঁজ করছে। ইতিমধ্যে তার বিরুদ্ধে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা ও হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে।
No comments