আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনে বাবুলের লুটপাট by জাবেদ রহিম বিজন
নিলামে অংশ নিতে শতাধিক ঠিকাদার দরপত্র ক্রয় করলেও তাদের কেউ দরপত্র জমা দিতে পারেননি। দরপত্র পাওয়ার পর পুঁজিদাতারা লাভের ৪০ ভাগ নেবেন আর বাকি ৬০ ভাগ সব ঠিকাদারদের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হবে বলে তাদের ম্যানেজ করা হয়। কিন্তু নিলাম পাওয়ার পর ওইসব ঠিকাদারদের কাছে ঘেঁষতে দেয়া হয়নি। নানাভাবে ভয়ভীতি দেখানো হয়। ২৫ হাজার টাকা করে দিয়ে বিদায় করা হয় তাদের। দরপত্র ক্রয়কারী ঠিকাদাররা জানান, ৩৭ কোটি টাকায় নিলাম পেয়ে একশ’ কোটি টাকার বেশিতে পুরোনো ইউনিট দুটি বিক্রি করেছেন। নিলামের দরপত্র ক্রেতাদের একজন নূরুল ইসলাম বলেন, তার শিডিউল ছিল। কিন্তু নেগোসিয়েশনের নামে তা জমা করতে দেয়নি। পরে টাকাও দেয়নি। সে সময় এনিয়ে কথা বলার সাহস ছিল না কারও। পরিবেশও ছিল না। দরপত্রের আরেক ক্রেতা তাইফুর রহমান বলেন, আমরা যারা শিডিউল কিনেছিলাম তাদের প্রত্যেককে ৪ লাখ টাকা করে দেয়ার কথা ছিল। সেই টাকা মেরে দিয়েছে। জুয়েল সিকদার জানান, ওরা ১০/১৫ কোটি টাকা করে ভাগ করে নিয়েছে। আমাদের ২৫ হাজার টাকা দিয়েছে। এদিকে এই নিলাম ডাকে ছফিউল্লাহ মিয়ার এক গুপ্ত পার্টনার তার পাওনা ৫ কোটি টাকার জন্যে আদালতে মামলা করেছেন।
নিলামের নামে লুটের আয়োজন: আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেড (এপিএসসিএল)’র ৬৪ মেগাওয়াটের পুরাতন দুটি ইউনিট ১ ও ২ এর পরিত্যক্ত ও আনুষঙ্গিক স্ক্র্যাপ বিক্রয়ে ২০২২ সালের ১লা ডিসেম্বর নিলাম দরপত্র বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। যাতে ২০২৩ সালের ৮ই জানুয়ারি দরপত্র দলিল বিক্রয়ের সর্বশেষ তারিখ এবং ৯ই জানুয়ারি দরপত্র দাখিলের সর্বশেষ তারিখ উল্লেখ করা হয় এবং দরপত্র দাখিলের স্থান হিসেবে আশুগঞ্জে কোম্পানির ব্যবস্থাপকের (প্রকিউরমেন্ট) কার্যালয় এবং ঢাকার কাকরাইলে কোম্পানির কর্পোরেট অফিসে কোম্পানি সচিবের দপ্তরের কথা বলা হয়। কিন্তু আশুগঞ্জে কাউকে নিলাম দরপত্র দাখিল করতে দেয়া হয়নি। মোট ৬টি দরপত্র জমা হলেও আশুগঞ্জে একমাত্র উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হাজী মো. ছফিউল্লাহ’র মালিকানাধীন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স সফিউল্লাহ’র দরপত্র দাখিল হয়। জমা হওয়া ৬টি দরপত্রের মধ্যে আশুগঞ্জের মেসার্স ছফিউল্লাহ ট্রেডার্স ৩৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা, ঢাকার মীরা স্টিল করপোরেশন ৩৮ কোটি ২৪ লাখ ৬২ হাজার ৫’শ টাকা, ভৈরবের মেসার্স নাবিল এন্টারপ্রাইজ ৬১ কোটি ৮৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা, ঢাকার চন্দ্রপুরী এন্টারপ্রাইজ ৩২ কোটি ২০ লাখ টাকা এবং ত্রিরত্ন ট্রেডিং এন্টারপ্রাইজ ৩৬ কোটি ২৭ লাখ টাকা দর দেয়। মেসার্স মায়াবি ইন্টারন্যাশনাল নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান অংশ নিলেও তারা কোনো মূল্য উল্লেখ করেনি এবং পে-অর্ডার দেয়নি। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে দরপত্রের উদ্ধৃত দরের সঙ্গে শর্তানুযায়ী জামানতের টাকা দিতে না পারায় আনফিট ঘোষণা করা হয়। এ নিয়ে ভৈরবের মেসার্স নাবিল এন্টারপ্রাইজ আদালতে একটি মামলাও করেছিলেন। ২০২৩ সালের ৯ই জানুয়ারি দরপত্র উন্মুক্ত করার প্রায় ৬ মাস পর ২২শে জুন ঠিকাদারকে কার্যাদেশ দেয়া হয়। এই সময়ে নিলাম নিয়ে নানা রকম খেলা চলে। পুনরায় নিলাম দরপত্র আহ্বান করা হবে, নাকি মনোনীত ঠিকাদারকে কার্যাদেশ দেয়া হবে, সেই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সময় ক্ষেপণ করা হয়। শেষ পর্যন্ত কোম্পানির ব্যবস্থাপক (প্রকিউরমেন্ট) মো. রফিকুদ্দৌলার স্বাক্ষরে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স সফিউল্লাহর অনুকূলেই লেটার অব ইনটেন্ট জারি করা হয়। এরপরই ওই বছরের ২৩শে জুলাই যশোরের নওয়াপাড়ার জাফরপুরের মো. নাজিম উদ্দিন রাজার সঙ্গে মেসার্স ছফিউল্লাহর নিলামে প্রাপ্ত পুরাতন ইউনিট দুটির মালামাল ৬৫ কোটি টাকায় বিক্রির চুক্তি হয়। তবে আলোচনা ছড়িয়েছে মোট ১২৫ কোটি টাকায় পুরাতন ইউনিট দুটির মালামাল বিক্রি হয়েছে। আশুগঞ্জ আওয়ামী লীগ সভাপতি হাজী মো. ছফিউল্লাহর নামীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে যৌথভাবে এই নিলাম দরপত্র কব্জা করেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য বাবুল আহমেদ, মনির সিকদার ও সদর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মো. সালাউদ্দিন। তাদের মধ্যে বাবুল আহমেদ আশুগঞ্জে সবকিছু সমন্বয় করেন। আর ঢাকার বাধাবিঘ্ন দূর করে নিলামটি পেতে কেন্দ্রীয় যুবলীগের প্রভাবশালী এক নেতাকে পার্টনার করা হয়। এই ৫ জনের মধ্যে সিক্সটি-ফোরটি ভাগাভাগি হয়। এরমধ্যে সিক্সটি পার্সেন্টের ভাগিদার ৪ জনের অংশের মালামাল ৬৫ কোটি টাকাতে বিক্রি করা হয়। গত বছরের ১৩ই সেপ্টেম্বর দৈনিক মানবজমিনে ‘বিদ্যুৎকেন্দ্রের পুরোনো ইউনিট নিলামে, শতকোটি টাকার বাণিজ্য আওয়ামী লীগ নেতাদের’ শিরোনামে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেড (এপিএসসিএল)’র ৬৪ মেগাওয়াটের পুরাতন দুটি ইউনিট ১ ও ২ এর আয়ুষ্কাল ২০০৫ সালে শেষ হয়। ফলে ২০১৪ সনে ইউনিট-১ এবং ২০১৮ ইউনিট-২ অবসরে যায়। দেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা পূরণে ইউনিট দুটির স্থলে নতুন অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন ইউনিট স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ। সে অনুসারে ইউনিট দুটি নিলামে বিক্রয় ও অপসারণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এরপরই অ্যাসেট ভ্যালু নির্ধারণে কনসালটেন্ট ফার্ম নিয়োগ করা হয়। মেসার্স খান ওয়াহাব শফিক রহমান অ্যান্ড কোম্পানি (চার্টাড অ্যাকাউন্ট) নামীয় একটি প্রতিষ্ঠান এই সম্পত্তির মূল্য ১৭ কোটি ৫০ লাখ ৪৪ হাজার ৪৬৬ টাকা মূল্যায়ন করে।
আগের রিপোর্টে মানবজমিনের কাছে দেয়া বক্তব্যে বাবুল আহমেদ ১০৫ কোটি টাকায় মালামাল বিক্রির বিষয়টি মিথ্যা দাবি করেন। মালের পরিমাণ ১ হাজার টন বলে জানান। ৮১ পার্সেন্ট ঊর্ধ্বমূল্যে নিলাম নেয়ার কথা জানিয়ে আরও বলেন- ৬১ কোটি টাকা দর যে দিয়েছে সে প্রোপার কোনো কিছুই দেয়নি। ছফিউল্লাহর নামে আমরা নিয়েছি ঐক্যবদ্ধ থাকার জন্যে। ঢাকায় ড্রপ না করলে আমরা ২২ কোটি টাকায় নিতে পারতাম। উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি হাজী ছফিউল্লাহ মিয়া তার প্রভাবে কোনো অনিয়ম হয়নি বলে দাবি করেন। বলেন সবকিছু নিয়মের মধ্যেই হয়েছে। কোম্পানির ব্যবস্থাপক (প্রকিউরমেন্ট) মো. রফিকুদ্দৌলা এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। কোম্পানির তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এএমএম সাজ্জাদুর রহমানের বক্তব্য ছিল, ‘৫টা পার্টি নিলামে অংশ নিয়েছে, এটা অনেক। প্রশ্ন উঠতে পারে বলে আমরা ঢাকাতেও দরপত্র জমা নিয়েছি। স্বচ্ছভাবেই সবকিছু হয়েছে। আমরা যে ভ্যালুয়েশন করেছি এর চেয়ে বেশি করা সম্ভব না। আপনি পিডিবিতে খবর নেন। একই জিনিস আরও কম টাকায় হয়েছে। আমরা অ্যাকাউন্টিব্যালির সঙ্গেই করেছি।’
No comments