রনি বলছিলেন আমি কী আর বাঁচবো? by ফাহিমা আক্তার সুমি
রনির বাবা মো. মহিউদ্দিন মানবজমিনকে বলেন, আমার সন্তানকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার পথে তার বন্ধুদের কাছে বাঁচার আকুতি জানিয়েছিল।
তার বন্ধুরা কয়েকটি হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখান থেকে তাকে চিকিৎসা দেয়া হয়নি। গত ৫ই আগস্ট বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে রনির শরীরে গুলি লাগে। তার ঠিক পনেরো মিনিট আগে ভিডিও কলে কথা হয় ওর বোনের সঙ্গে। বোনকে বিজয় মিছিল দেখায়। মিরপুর-২ নম্বর শপিং সেন্টারের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় পড়ে যায়। একটা গুলি গলায় আর দুইটা বুকে লেগেছিল। শরীরের অন্যান্য স্থানেও ছররা গুলিতে ঝাঁঝরা ছিল। একটা বন্ধুক থেকে ৩টা গুলি কি একসঙ্গে বের হয়? একটা মানুষকে মারার জন্য ৩টা গুলি কি প্রয়োজন আছে? আমার সন্তানের শরীর দেখে মনে হয়েছে তারা কতোটা বর্বর ছিল। দুই সন্তানের জন্মই ঢাকাতে। আমাদের গ্রামের বাড়ি ভোলায়। বর্তমানে ঢাকার মিরপুর-১২তে থাকি।
তিনি বলেন, প্রথমে শিয়ালবাড়ির ইবনে সিনা হাসপাতালে নিয়ে যায় রনিকে। সেখানে কোনো ডাক্তার পাইনি চিকিৎসাও হয়নি তার। পরে মিরপুরে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে নেয়া হয়, সেখানেও কোনো চিকিৎসা পায়নি। এরপর নিয়ে যায় কুর্মিটোলা হাসপাতালে সেখানে নেয়ার পরে আর প্রাণ ছিল না রনির। এভাবে একঘণ্টার বেশি কয়েকটি হাসপাতালে ছুটতে থাকে তারা। হাসপাতালে নেয়ার পথে গাড়ির মধ্যেও কথা বলেছিল রনি। আমার সন্তানের অবস্থা খারাপ দেখে সঙ্গে থাকা ওই শিক্ষার্থীরা কানে কানে কলেমা পড়ায়। তারা বুঝেছিল রনি বেঁচে থাকলে তো আল্লাহর কাছে আর কিছু চাওয়ার নেই, আর মারা গেলেও যেন একজন মুসলিম হিসেবে কলেমা পড়া শুনে যেতে পারে। আমাদের না বলে আন্দোলনে চলে যেতো। আন্দোলনে গিয়ে চার তারিখেও বোনের মোবাইলে ভিডিও করে পাঠায়। অনার্সে ভর্তির জন্য কাগজপত্র রেডি করছিল। পরিবারকে সাপোর্ট দেয়ার জন্য গুলশানে একটি শপিংমলে চাকরি করতো। আমি এক সময় অ্যাকশন এইডে চাকরি করতাম। এরপর সেটি ছেড়ে একটি বেকারিতে কাজ নেই। রনির মা অসুস্থ। মাসে দশ-পনেরো হাজার টাকার মতো ওষুধ লাগে।
ঘরে থাকা রনির ব্যবহার করা জিনিসপত্র দেখিয়ে স্মৃতিচারণ করছিলেন তার বাবা। এ সময় তিনি বলেন, ওইদিন সকাল সাড়ে দশটার দিকে ঘুম থেকে ওঠে রনি। তখন আমি চুলার কাছে রুটি গরম করতে যাই। এ সময় ও দেখে বলে বাবা আমিও নাস্তা খাবো। আমি ৭ পিস রুটি গরম করি, রনির আম্মু ওর জন্য একটা ডিম ভাজে। বাসায় এই খাওয়াই ওর শেষ, আমাদের দুইজনের হাতের খাবার একসঙ্গেই খেয়েছে।
তিনি বলেন, আমার একমাত্র ছেলে সন্তান ছিল রনি। মেয়েটা সে তার শ্বশুরবাড়ি থাকে। আামি মারা গেলে আমার সন্তান মাটি দিতো। আমার বাবারে অনেক কষ্ট দিয়ে মারছে। মৃত্যুর সময় আমার সন্তানের কোনো কথা শুনতে পারিনি। ওর আম্মু সারাদিন কান্নাকাটি করে। না খেয়ে থাকলেও আমার সন্তান সব সময় চোখের সামনে ঘুরতো। আমার ছেলে শহীদ হয়েছে সে যেন শহীদি মর্যাদাটা পায়। যারা এমন বর্বরতা করেছে তারাও তো মানুষ, তাদের ঘরেও তো সন্তান রয়েছে। আমার এই শূন্যতা কখনো যাবে না। আমি ঘরে হাঁটলে, বসলে সব সময় দেখি আমার রনি চারিদিকে ঘুরছে। মনে হচ্ছে ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে খাচ্ছে। ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মোবাইল দেখছে। আমি কীভাবে শান্ত্বনা নিয়ে থাকবো আমার বাবাকে হারিয়ে। সবাই একদিন ভুলে যাবে কিন্তু আমরা বাবা-মা কী নিয়ে থাকবো। যারা এভাবে খুন করেছে তাদের যেন জাতিসংঘের মাধ্যমে বিচারের আওতায় আনা হয়। এতটুকু দেখে যেন আমরা শান্তি পাই।
রনির বোন তাহমিনা আক্তার বলেন, ওর স্বপ্ন ছিল বিদেশ গিয়ে পড়াশোনা করবে, চাকরি করবে। অনেক টাকা আয় করে বাবা-মায়ের অভাব পূরণ করবে, গাড়ি করবে, বাড়ি করবে কিন্তু সেই স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল। আমরাও রনির খুশিতে খুশি ছিলাম। গত ৫ই আগস্ট আমাকে ভিডিও কল দেয় সেনাপ্রধানের ভাষণের আগে যখন নেট ছেড়ে দেয়। ৪টার পরে ভিডিও কলে রনি আমাকে বলে, এই দেখো বিজয় মিছিলে এসেছি। তখন তাকে আমার স্বামী বলে দ্রুত বাসায় চলে যেও। আমি তখন গণভবনের দিকে যেতে নিষেধ করেছি। তখন ও বলে যাবো না ওদিকে অনেক ভিড়। তখন এক-দুই মিনিটের মতো কথা হয়। এরপর আর রনির সঙ্গে কথা হয়নি। তিনি বলেন, যখন প্রথমে হাসপাতালে নেয়া হয় তখনো আমার ভাইয়ের প্রাণ ছিল। ঠিকমতো চিকিৎসা পেলে আমার ভাইকে বাঁচানো যেতো।
No comments