যে কাজ শুরু করেছো তা শেষ করতে হবে -শিক্ষার্থীদের প্রধান উপদেষ্টা

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিদের উদ্দেশ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষার যে স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার কাজ শুরু হয়েছে, তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তোমরা এর থেকে বেরিয়ে যেও না।

রোববার তেজগাঁও অবস্থিত প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে ছাত্র সংগঠক এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্র প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় প্রধান উপদেষ্টা এ কথা বলেন। এ সভায় বিভিন্ন পর্যায়ের ১৫০ জন শিক্ষার্থী অংশ নেন। সভার শুরুতে প্রধান উপদেষ্টা ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহীদ ও আহত শিক্ষার্থীদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। এ সময় হতাহতদের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন ড. ইউনূস। কাঁদতেও দেখা যায় তাকে। অধ্যাপক ইউনূস গত ১৫ বছরের অপশাসনের কথা স্মরণ করে শিক্ষার্থীদের বলেন, এতদিন তারা চুপচাপ শুয়ে শুয়ে স্বপ্নের মধ্যে ছিল এবং আনন্দ সহকারে লুটপাট করে যাচ্ছিল। এরা কী এখন চুপচুপ বসে থাকবে। না, তারা খুব চেষ্টা করবে আবার তোমাদেরকে দুঃস্বপ্নের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়ার। চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখবে না। কাজেই যে কাজ শুরু করেছো, তা সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত এর থেকে বেরিয়ে যেও না।

দেশের সফল অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়ায় শিক্ষার্থীদের অভিনন্দন জানিয়ে নোবেল বিজয়ী ইউনূস বলেন, বাংলাদেশের জন্ম থেকে আজ পর্যন্ত এই সুযোগ আসেনি।

তবে সুযোগ যেন হাতছাড়া না হয়। এই সুযোগ হাতছাড়া হলে বাংলাদেশের আর কোনো ভবিষ্যত থাকবে না। রাষ্ট্র আর থাকবে না। কাজেই এটা শুধু রাষ্ট্র নয়, পৃথিবীর সম্মানিত রাষ্ট্র হিসেবে যেন প্রতিষ্ঠিত হয়, সেটা করতে হবে। তরুণরা কোন যাদুমন্ত্রে বাংলাদেশে বিপ্লব সংগঠিত করেছে, তা দেখতে সারা দুনিয়ার মানুষ এদেশে আসবে। তোমাদের কাছ থেকে শিখতে আসবে। তোমাদের কাছে জানতে চাইবে- কোন মন্ত্র দিয়ে এই বিপ্লব করেছো। এই মন্ত্র তারা শিখতে চাইবে।

শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, তোমাদের মন্ত্র কী, সেটা হয়তো তোমরা বুঝতে পারছো না। এটা একটা বড় মন্ত্র। এই মন্ত্র ধরে রাখো। মন্ত্র যদি শিথিল হয়ে যায়, আমাদের কপালে অশেষ দুঃখ আছে। সেই দুঃখ যেন আমাদেরকে দেখতে না হয়। অভ্যুত্থান পরবর্তীতে তরুণরা দেশের হাল ধরেছে। তারা অনন্য এক বাংলাদেশ তৈরি করে যাবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ চিন্তায় অনড় থাকতে হবে। তোমাদের চিন্তা স্বচ্ছ ও সঠিক। কেউ যদি স্বপ্ন পূরণের চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসার পরামর্শ দেয়, সেটা গ্রহণ করো না। দেখছি আর ভাবছি কী একটা স্বপ্ন আমাদের সবার সামনে, জাতির সামনে তোমরা নিয়ে এসেছো। যারা শহীদ হয়েছে, তাদের স্মরণ করি। যারা শহীদ হয়েছে, তারা চলে গেছে। তোমাদের দিকে তাকাচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম তোমরাও শহীদ হয়ে যেতে পারতে। শহীদরা আজ আমাদের সঙ্গে বসতে পারতো, সেই সুযোগ তাদের দেয়া হয়নি।

আহতদের হাসপাতালে দেখতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে ড. ইউনূস বলেন, যখন হাসপাতালে শিক্ষার্থীদের দেখার জন্য যাই, তাদের দিকে তাকাতে কষ্ট হয়। একটা ছেলে, একটা মেয়ে এই রকমভাবে কীভাবে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এই দিকে পা চলে গেছে, ওই দিকে মাথা। একজন তাজা তরুণ রংপুরে আমাকে বললো, ফুটফুটে একটা ছেলে, স্যার আমি সারাজীবন ক্রিকেট খেলতে চেয়েছিলাম। ক্রিকেটার হতে চেয়েছিলাম। এখন দেখেন আমার পা কেটে ফেলেছে। সে আমাকে জিজ্ঞেস করেছে স্যার ক্রিকেট খলেবো কী করে? ক্রিকেট তার মাথা থেকে যাচ্ছে না।

তিনি বলেন, আহতদের যতবার দেখি ততবার মনে প্রশ্ন জাগে, কী বাংলাদেশ আমরা বানিয়েছি যে এতগুলো তাজাপ্রাণ, তাদেরকে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হলো। আমরা যারা আজকে এখানে বসে কথা বলছি, তাদের একমাত্র দায়িত্ব তাদের এই ত্যাগ, এই জীবনের মূল্যের স্বপ্ন পূরণ করা। নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে আহতদের দেখতে যাওয়ার কথা স্মরণ করে ড. ইউনূস বলেন, একটা হাসপাতালে গেলাম আবার সেই দৃশ্য কচি কচি প্রাণ, মাথার খুলি উড়ে গেছে। মাথার অর্ধেক নাই, গুলি মাথার ভেতর রয়ে গেছে। রংপুরের হাসপাতালের দৃশ্য, এক্স-রে’তে দেখা যাচ্ছে ওখানে দাগ ছোট ছোট ফুটো করা, আমি বুঝতে পারলাম না আমাকে কী দেখাচ্ছে, আমি জিজ্ঞেস করলাম। এগুলো কী? এতগুলো গুলি তার শরীরে রয়ে গেছে, সে বেঁচে আছে রাবার বুলেট, যতবার দেখি যতবার শুনি আবার নতুন করে প্রতিজ্ঞা করতে হয় যে স্বপ্নের জন্য তারা প্রাণ দিয়েছে সেই স্বপ্নকে আমরা বাস্তবায়ন করবো।

তিনি বলেন, আমাদের যোগ্যতা না থাকতে পারে, ক্ষমতা না থাকতে পারে, কিন্তু আমাদের প্রতিজ্ঞা রইলো, আমরা স্বপ্ন পূরণ করবো। হাসপাতালের দৃশ্য এবং আন্দোলনের প্রতিদিনের ঘটনা মানুষকে জানাতে হবে বোঝাতে হবে এর পেছনে কী ছিল।

সভায় উপস্থিত ছিলেন- আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, বন, পরিবেশ ও জলবায়ু উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম এবং যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। এই মতবিনিময় সভার বিষয়ে জানাতে বিকালে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে।

সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম জানান, প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক হবে সম্মান ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে সভায় এমনটা বলেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, সরকারের এক মাস পূরণের অংশ হিসেবে এই আলোচনা। এখানে আবেগ অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন সবাই। এ ছাড়াও আলোচনা হয়েছে কীভাবে কোন কোন সেক্টরে সংস্কার প্রয়োজন তা নিয়ে।

তিনি আরও বলেন, ক্যাম্পাসে কী ধরনের রাজনীতি হবে তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।  কোনো অন্যায়ের বিচারের ভার জনগণের নয়, আইনের তা উল্লেখ করা হয়। ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতি হোক এটা তারা চান না। রাজনৈতিক কোনো ট্যাগ শিক্ষাঙ্গণে চান না।

আহত-নিহতের তালিকা তৈরির বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সেক্রেটারি শফিকুল আলম বলেন, ১৮ হাজার মানুষ আহত হয়েছে। আমরা সবার ঠিকানা নিচ্ছি। একজন সাধারণ মানুষ ভেবেছে আমার স্বামী তো মারা গেছে আমি কেন ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে যাবো। পুলিশি হয়রানির ভয়ে। অনেকে মারা যাওয়ার পর তালিকাভুক্ত হয়নি। কাজটা কঠিন তবে অসম্ভব গতিতে হচ্ছে। সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার উপপ্রেস সচিব আজাদ মজুমদার অপূর্ব জাহাঙ্গীর। 

mzamin

No comments

Powered by Blogger.