অনলাইন জুয়ার দুর্গে যৌথ বাহিনীর হানা
সোমবার (২ সেপ্টেম্বর) বিকাল ৫ টার সময় মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার শিবপুর-বিশ্বনাথপুর গ্রামের মধ্যবর্তী সড়কে অবস্থিত বাগানবাড়ীটিতে অভিযান চালায় যৌথবাহিনী। মেহেরপুরের র্যাব-১২ সিপিসি ৩ এর কমান্ডার এএসপি মনিরুজ্জামান কালবেলাকে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
জানা গেছে, লিপু বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ অনলাইন ক্যাসিনো এজেন্ট হিসেবে স্বীকৃত। অভিযানকালে লিপুর অনুপস্থিতিতে সেখানে ৮ জনকে আটক করে যৌথবাহিনী। অবশ্য জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আটকৃতদের ছেড়ে দেওয়া হয়। অভিযান সম্পর্কিত বিষয়ে জানতে সেনাবাহিনীর মেহেরপুর জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও ২৭ রেজিমেন্ট আর্টিলারির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল নাবিল আহমেদের সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। মেহেরপুরের র্যাব-১২ সিপিসি-৩ ক্যাম্পের কমান্ডার অভিযানের তথ্য নিশ্চিত করেন।
সিপিসি-৩ ক্যাম্পের কমান্ডার এএসপি মনিরুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, ‘শিবপুরে লিপুর বাগানবাড়িতে অভিযানটি মূলত ছিল সেনাবাহিনীর। আমরা তাদের লজিস্টিক সাপোর্ট দিয়েছি মাত্র। এর বেশি আমি কিছু বলতে পারব না ‘
সূত্র জানিয়েছে, বিট কয়েন বা ডিজিটাল মুদ্রার (ক্রিপ্টোকারেনসি) মাধ্যমে অনলাইনে জুয়া খেলা হয়। প্রায় ২৩০টি সাইটের মাধ্যমে অবৈধ পন্থায় ডিজিটাল মুদ্রা কেনাবেচার লেনদেনে গত আড়াই বছরে প্রায় ১২ থেকে ১৩ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে বলে অনুমান করা হয়। রাশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশে এই টাকা পাচার হয়েছে বলে বিভিন্ন সময় জানিয়েছে কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা।
রাশিয়া থেকে পরিচালিত এসব অনলাইন জুয়ার সাইট ও অ্যাপস তাদের এজেন্টদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে মেহেরপুর জেলা শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যায়ে পর্যন্ত। এসব জুয়ার সাইট ও অ্যাপস ভার্চুয়ালি জুয়া খেলায় একেকটি এজেন্টের মাধ্যমে মাসে ৩ থেকে ৪ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। মেহেরপুরে জেলা শহরসহ গাংনী এবং মুজিবনগর এলাকার তরুণদের বড় অংশই এখন জুয়ার সাইট পরিচালনায় যুক্ত।
জানা গেছে, একজন জুয়ড়ি মোবাইল নম্বর এবং ইমেইলের মাধ্যমে এই বেটিং সাইট ওপেন করেন। অ্যাকাউন্টের বিপরীতে একটি ই-ওয়ালেট তৈরি হয়, যাকে জুয়াড়িরা ইউএসডিটি বলে। শুরুতে এর ব্যালান্স শূন্য থাকে। ওয়ালেটে ব্যালান্স যোগ করার জন্য নানা মাধ্যম রয়েছে। এর মধ্যে বিকাশ, নগদ, রকেট, উপায় এবং ট্রাস্ট এজিয়াটা অন্যতম। এগুলোর যে কোনো একটি বেছে নিলে সেখানে একটি এজেন্ট নম্বর দেখায় যেখানে ন্যূনতম ৫০০ টাকা দিলে কিছুক্ষণের মধ্যে ই-ওয়ালেট বা ইউএসডিটি ব্যালান্স যুক্ত হয়ে যায়। এ টাকা অথবা ব্যালান্স দিয়ে তিনি পরবর্তীতে জুয়া খেলতে পারেন। প্রতিটি এজেন্ট অনলাইন জুয়ার প্রতি ট্রানজেকশনে ৯ শতাংশ করে কমিশন পান।
এর আগে জেলার শীর্ষ ৩২ জন অনলাইন জুয়াড়িকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। তাদের মধ্যে রয়েছেন মুজিবনগর উপজেলার কোমরপুর গ্রামের বাদল হালদারের ছেলে নিমাই হালদার ও গোপালপুর দক্ষিণপাড়া এলাকার খলিলুর রহমানের ছেলে বদরুদ্দোজা ওরফে রয়েল (৩৬), কোমরপুর গ্রামের মধু হালদারের ছেলে প্রসেনজিৎ হালদার (২৫), নজরুল ইসলামের ছেলে সুমন আলী (৪০), মাহফুজুর রহমান ওরফে নবাব (২৮), শিবপুরের মৃত শাহাজুলের ছেলে বিজয় ওরফে বিজয় শেখ, আব্দুর রশিদের ছেলে সাদ্দাম হোসেন (৩০), কোমরপুর গ্রামের মোস্তাফিজুর রহমান সুমন, নিমাই হালদার, নুরুজ্জামান ওরফে জামান মাস্টার, মুকুল ইসলাম, নুরুল ইসলাম ওরফে লালন মাস্টার, মাদার আলী ওরফে মাদার মাস্টার, গোপালপুর গ্রামের পলাশ, কোমরপুর গ্রামের বিলু সর্দারের ছেলে শামীম রেজা, গাংনী উপজেলা শহরের উত্তপাড়া এলাকার মৃত আব্দুল কুদ্দুছের ছেলে মেহেরপুর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি শাহিদুজ্জামান শিপু, বঙ্গবন্ধু সৈনিকলীগের গাংনী উপজেলা শাখার সভাপতি ও গাংনী সরকারি ডিগ্রি কলেজের ক্লার্ক রবিউল ইসলাম, সাবেক ছাত্র নেতা জুবায়ের হোসেন উজ্জ্বল, বিপুল হোসেন চঞ্চল হোসেন ও জিয়াউর রহমান। কিন্তু যথোপযুক্ত আইন না থাকাতে এ সকল আসামিরা আদালত থেকে জামিনে বেরিয়ে আসে। আবারো চালাতে থাকে অনলাইন জুয়ার তৎপরতা।
এরও আগে ২০২১ সালের ১৪ নভেম্বর মোবাইল ফোনে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের এজেন্ট সিম ব্যবহার করে অনলাইনে জুয়ার কারবারের সঙ্গে জড়িত একটি চক্রের ৯ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। গ্রেপ্তার হয়েছিলেন অনলাইন জুয়ার এজেন্ট মাহফুজুর রহমান নবাব (২৬), নবাবের স্ত্রী মনিরা আক্তার মিলি (২৪), মুরশিদ আলম লিপু (২৫), স্বপন মাহমুদ (২৭), নাজমুল হক (২১), আসলাম উদ্দিন (৩৫), শিশির মোল্লা (২১), সাদিক (২২) ও মাসুম রানা (২০)। এরপরই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে ক্যানসারের মতো ছড়িয়ে পড়া অনলাইন জুয়া এবং অনলাইন জুয়ার এজেন্ট সম্পর্কিত তথ্য সামনে আসে।
তৎকালীন সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক কামরুল আহসান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, সিআইডির নজরদারির ভিত্তিতে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। বিভিন্ন খেলাকে কেন্দ্র করে তারা রাশিয়াভিত্তিক বেটিং ওয়েবসাইটে অ্যাকাউন্ট খুলে জুয়ার কারবার করত। আর লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করত বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের এজেন্ট সিম।
প্রথমবার গ্রপ্তারের সময় স্বপনের সিম থেকে প্রতিদিন গড়ে সাত থেকে আট লাখ টাকা, লিপুর সিম থেকে প্রতিদিন গড়ে ১০ লাখ টাকা ও নবাবের সিম থেকে প্রতিদিন পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকা লেনদেন হতো বলে জানিয়েছিল সিআইডি। মেহেরপুরের একাধিক মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন এসআর ও সেখানকার ডিপোর ম্যানেজার এ কাজের সঙ্গে সরাসরি জড়িত বলে জানিয়েছিলেন সিআইডির ঐ কর্মকর্তা।
মেহেরপুর জেলা পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, একটি মামলার আসামি বদরুদ্দোজা ওরফে রয়েল কে জিজ্ঞাসাবাদে বের হয়ে আসে মেহেরপুরসহ বাংলাদেশে অনলাইন জুয়ার মাস্টার এজেন্ট কোমরপুর গ্রামের সোনা গাইনের ছেলে মাহফুজুর রহমান ওরফে নবাবের কথা। তার নেতৃত্বে অনলাইন জুয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলেন আরও ১৫ জন সাব-এজেন্ট। পরবর্তীতে তারা সকলেই বিভিন্ন সাইটের মাস্টার এজেন্ট হয়েছেন। এদের মধ্যে অন্যতম গোপালপুর গ্রামের আমিরুল ইসলামের ছেলে শিশির বিশ্বাস, বিল্লাল গড়াইয়ের ছেলে দেলোয়ার হোসেন দিপু, কোমরপুর গ্রামের বিলু সর্দারের ছেলে শামীম, একই গ্রামের আনারুল মিয়ার ছেলে রুবেল, টুঙ্গীর শরিফের ছেলে পলাশ, মুজিবনগর শিবপুরের মৃত শাহাজুলের ছেলে বিজয় শেখ, একই গ্রামের জিনারুলের ছেলে লিপু গাজী, মোনাখালী গ্রামের আজহারুলের ছেলে মিলন, সাইদুর রহমান খোকনের ছেলে সাগর, কোমরপুর গ্রামের বাশার বিশ্বাসের ছেলে সজীব, ভাটপাড়া গ্রামের মৃত সিরাজের ছেলে বাবু, মেহেরপুর শহরের স্টেডিয়াম পাড়ার বখতিয়ার মাস্টারের ছেলে রুবেল, গাংনীর গাড়াডোব গ্রামের মৃত কিয়াম উদ্দিনের ছেলে আনেয়ার।
জেলা পুলিশের ঐ কর্মকর্তা আরও জানান, রয়েল নামের ওই অনলাইন জুয়াড়িকে গ্রেফতারের পর মামলা করা হয়। মামলাটি তদন্তের একপর্যায়ে এ চক্রের সদস্যদের অবস্থান সম্পর্কে জানা যায়। জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে ২৩০টি জুয়ার সাইটের মালিক ও এজেন্ট সম্পর্কে নানা তথ্য।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মেহেরপুর জেলা গোয়েন্দা বিভাগের এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ‘মূলত অনলাইন জুয়া নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের সঠিক আইন না থাকাতে আটককৃতরা সব সময় প্রবেশনে মুক্তি পেয়ে যায়। এজন্য জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে এক সময় অনলাইন জুয়ারদের ধরতে যথেষ্ট অভিযান পরিচালিত হলেও পরবর্তীতে অভিযানের গতি মন্থর হয়ে যায়।’
মেহেরপুর জেলা পুলিশ সুপার এস এম নাজমুল হক সম্প্রতি কালবেলাকে বলেন ,‘অনলাইন জুয়াড়িরা প্রযুক্তিতে অনেক এগিয়ে রয়েছে। ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ভিপিএন) ব্যবহার করে চালানো হয় অনলাইন জুয়ার অ্যাপ। অনলাইন ক্যাসিনোর সাইটগুলোর ডোমেইন দেশের বাইরের। নির্ধারিত সময় পরপর এসব সাইটের আইপি পরিবর্তন করে নিয়ন্ত্রণকারীরা। অনলাইন জুয়াড়িরা প্রতিনিয়ত কৌশল বদলে তাদের অবৈধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে থাকে। অনলাইন জুয়া খেলা বন্ধে আমরা জিরো টলারেন্স প্রদর্শন করছি। তবে শুধু পুলিশের পক্ষে এটি বন্ধ করা কষ্টসাধ্য। এ বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।’
No comments