কঠোর অবস্থানে বিএনপি’র হাইকমান্ড তবুও চলছে দখল-চাঁদাবাজি by কিরণ শেখ

দখল-চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে বিএনপি’র হাইকমান্ড। দফায় দফায়  দেয়া হচ্ছে সতর্কবার্তা। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কেন্দ্রীয় নেতাদের পাশাপাশি তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় দখল-চাঁদাবাজির বিষয়ে কড়া হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন। হুঁশিয়ারির পরও বিভিন্ন স্থানে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নামে দখল-চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস, হাট-বাজার, ফুটপাথ, বস্তি, পরিবহনসহ বিভিন্ন খাতে নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা হচ্ছে। দেয়া হচ্ছে বিভিন্ন হুমকি-ধামকি। আবার কেউ চাইছেন ঠিকাদারি, কেউ দাবি করছেন চাঁদা, কেউ ব্যস্ত চেয়ার দখল নিয়ে। দখল করছেন ব্যাংক, খাসজমি এবং পুকুরও।

সম্প্রতি চট্টগ্রামে এস আলমের একটি কারখানা থেকে বিলাসবহুল অন্তত ১৪টি গাড়ি বিএনপি নেতাদের তত্ত্বাবধানে সরিয়ে ফেলা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই অভিযোগে গত রোববার রাতে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ইউনিট কমিটির আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান, যুগ্ম আহ্বায়ক এনামুল হক ও সদস্য মামুন মিয়ার প্রাথমিক সদস্য পদ স্থগিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে  চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ইউনিট বিলুপ্তও ঘোষণা করা হয়েছে।

পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবক দল চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক আলী মুর্তজা খানকে দলের প্রাথমিক সদস্য পদসহ সকল পর্যায়ের পদ থেকেও বহিষ্কার করা হয়েছে। এই ঘটনায় কক্সবাজারে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বিতর্কিত ব্যবসায়ী এস আলমের গ্রুপের গাড়ি ব্যবহারের জন্য দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদকে ব্যাখ্যা দিতে বলেছে বিএনপি। একই সঙ্গে যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকনের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে দলটি । খোকনের বিরুদ্ধে বিতর্কিত ডায়মন্ড ব্যবসায়ী দিলিপ কুমার আগারওয়ালার সঙ্গে বৈঠকের অভিযোগ উঠেছে। বিএনপি’র কেন্দ্রীয় দপ্তর সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে। সূত্র জানায়, কক্সবাজারে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বিতর্কিত ব্যবসায়ী এস আলমের গ্রুপের গাড়ি ব্যবহারের জন্য সালাহউদ্দিন আহমেদকে এবং বিতর্কিত ডায়মন্ড ব্যবসায়ী দিলীপ কুমার আগারওয়ালার সঙ্গে বৈঠকের অভিযোগে খোকনকে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে।

নিজ নির্বাচনী এলাকা কক্সবাজারে সংবর্ধনা নিতে যাওয়ার সময় ব্যবহৃত গাড়িটি এস আলম গ্রুপের ছিল তা জানতেন না বলে জানিয়েছেন সালাহউদ্দিন আহমেদ। তারপরও এই ‘অসাবধানতা ও অনিচ্ছাকৃত’ ভুলের জন্য দেশবাসীর কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছেন এই বিএনপি নেতা। তিনি বলেন, যদি দেশবাসীর মনে কোনো কষ্ট দিয়ে থাকি, অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে থাকি সেজন্য আমি দুঃখ প্রকাশ করছি।

খায়রুল কবির খোকন বলেন, ৩১শে আগস্ট আনুমানিক রাত ৮টায় আমি গুলশানের একটি রেস্তরাঁয় (অবশ্যই কোনো পাঁচ তারকা হোটেল নয়) আমাদের ২০০১-২০০৬ শাসনামলে প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন প্রটোকল অফিসার ফরিদুল ইসলামের (যিনি দীর্ঘবছর ধরে পদবঞ্চিত হয়েছিলেন) সঙ্গে দলের গুলশান কার্যালয়ে যাওয়ার পথে সাক্ষাৎ করতে যাই আমার জেলা নরসিংদীর জন্য একজন যোগ্য, সৎ জেলা প্রশাসক নিয়োগের স্বার্থে কথা বলতে। ওখানে স্বাভাবিকভাবেই অবস্থানকালে পূর্ব পরিচয়ের সূত্রে আমরা একত্রে চা পান করি ও  পারস্পরিক কুশলাদি বিনিময় করি। এসময়ে এনামুল হক দোলন নামে আমার এক আত্মীয় আমাকে ফোন করে আমি কোথায় আছি, জানতে আগ্রহ প্রকাশ করে জানালে সে ক্রাউন প্লাজার রেস্টুরেন্টে এসে আমার সঙ্গে দেখা করে।  আমার আদৌ জানা ছিল না দোলন আমার সঙ্গে দেখা করতে আসার নামে তার সঙ্গে অন্য কাউকে নিয়ে আসবে কিনা, কিন্তু ঘটনাস্থলে এসে দোলন তাদের সমিতি সংক্রান্ত সমস্যার কথা তুলতে গিয়ে দিলীপ আগারওয়াল নামক জনৈক ব্যক্তির সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়। আগারওয়ালা নামের ব্যক্তিকে আমি কখনোই চিনতাম না। তার সঙ্গে আমার পূর্ব পরিচয়ও ছিল না। ঘটনাটি একেবারেই  আকস্মিক, যা আমাকে রীতিমতো বিব্রত ও অপ্রস্তুত করেছে।

এ ছাড়া মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার শিমুলিয়া ফেরিঘাট, মাছঘাট ও ট্রলার ঘাটের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগে বিএনপি’র দুই নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। সংগঠন পরিপন্থি কাজের জন্যই দলটির লৌহজংয়ের কুমারভোগ ইউনিয়ন বিএনপি’র সভাপতি কাউসার তালুকদার ও সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন জনিকে দল থেকে বহিষ্কারের এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ওদিকে ঢাকা মহানগরের কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজদের শেল্টার দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের সদস্য সচিব রবিউল ইসলাম নয়নের বিরুদ্ধে ইসলামী ব্যাংক দখলের চেষ্টায়ও জড়িত হওয়ার অভিযোগ উঠে।

এস আলম গ্রুপের হয়ে মোটা টাকার বিনিময়ে নয়ন ও তার অনুসারীরা ব্যাংক দখলে ভাড়াটে হিসেবে কাজ করেন বলে অভিযোগ উঠে। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপি’র সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আলহাজ মোশাররফ হোসেন খোকনের বিরুদ্ধেও সাবেক এমপি হাজী মোহাম্মদ সেলিম এবং তার ছেলে মোহাম্মদ সোলায়মান সেলিমকে শেল্টার দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই অভিযোগে খোকনকে কারণ দর্শানো নোটিশ দেয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়, যেহেতু আপনার বিরুদ্ধে পতিত স্বৈরাচার, ছাত্র-জনতার খুনি হাসিনার অপকর্মের সহযোগী, অসংখ্য চাঁদাবাজি, হত্যা, বিএনপিদলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী সাবেক এমপি হাজী সেলিম এবং তার পুত্র বিনা ভোটের সংসদ সদস্য সোলায়মান সেলিমকে আশ্রয়, প্রশ্রয় এবং পুনর্বাসন চেষ্টার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। এই অভিযোগসমূহ দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের শামিল। সেহেতু আপনার বিরুদ্ধে কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, এজন্য তিন দিনের মধ্যে সশরীরে লিখিতভাবে দলীয় কার্যালয়ে এসে জবাব দেয়ার জন্য বলা হয়। এই নোটিশের জবাব তিনি দিয়েছেন তা জানা যায়নি।এদিকে ঢাকা মহানগর পূর্ব ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক আব্দুল্লাহ জামাল চৌধুরী আদিত্যের বিরুদ্ধে রাজধানীর শাহজাহানপুরে বিভিন্ন দোকানে চাঁদাবাজি ও দখলের অভিযোগ পাওয়া গেছে। তার বিরুদ্ধে রাজধানীর শাহজাহানপুরে বিভিন্ন দোকানে চাঁদাবাজি ও দখলের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই অভিযোগে গত ৮ই আগস্ট কেন্দ্রীয় ছাত্রদল থেকে তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়েছে। নোটিশে বলা হয়, ঢাকা মহানগর পূর্ব শাখা ছাত্রদলের দায়িত্বশীল পদে আসীন থেকে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে আপনার বিরুদ্ধে কেন স্থায়ী সাংগঠনিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, এই মর্মে দুইদিনের মধ্যে কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের উপস্থিতিতে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে ব্যাখ্যা প্রদানের নির্দেশ দেয়া হয়।

ওদিকে গত ৫ই আগস্টের পর আজিজুর রহমান মুসাব্বির কাওরান বাজারে প্রায় ৫০০ দোকান দখল করেছিলেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তিনি জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দল কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক। এই অভিযোগে গত ১২ই আগস্ট তার পদ স্থগিত করা হয়। এদিন তাকে পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দল কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক আজিজুর রহমান মুসাব্বিরের দলীয় পদ স্থগিত করা হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত তার রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থগিত থাকবে। একই সঙ্গে ঢাকা মহানগর উত্তর যুবদলের আহ্বায়ক শরীফ উদ্দিন জুয়েলের বিরুদ্ধেও চাঁদাবাজি এবং দখলের অভিযোগ উঠেছে। তার নেতৃত্বেই ঢাকা উত্তরে বিভিন্ন দোকানে চাঁদাবাজি ও স্থাপনা দখলের অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া লুটপাট, চাঁদাবাজি এবং দখলের অভিযোগে ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রদলের সভাপতি শাহিনুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক জুলহাস মৃধা, সরকারি বাঙলা কলেজ ছাত্রদলের সিনিয়র সহ-সভাপতি মোকলেছুর রহমান এবং শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক বি এম আলমগীর কবিরসহ বিএনপি’র এবং এর অঙ্গসংগঠনের বেশ কয়েকজনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।

বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী মানবজমিনকে বলেন, গত ১৬ বছর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বিএনপি’র কর্মীদের অনেক জায়গা-জমি দখল করেছে। এজন্য ক্ষোভের তীব্রতা অনেক বেশি। আর এসব কাজ বেশির ভাগই করছে দুষ্কৃতকারীরা। আপনারা দেখেছেন, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা যুবদলের নামে চাঁদাবাজি ও দখল করছেন। আর বিএনপি’র যারা এসব কাজ করছেন তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে। পদ স্থগিত এবং বহিষ্কারও হয়েছে। বিএনপি এসব প্রশ্রয় দেয় না এবং ভবিষ্যতেও দেবে না।

No comments

Powered by Blogger.