হাসপাতালে-হাসপাতালে দিনভর ভোগান্তির পর বহির্বিভাগ চালুর ঘোষণা

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসকদের ওপর হামলার ঘটনায় ডাকা কর্মবিরোতির পর গতকাল সকাল থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের পাহারায় জরুরি বিভাগের চিকিৎসাসেবা চালু করা হয়েছে। তবে ঢামেকসহ রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে দিনভর বন্ধ ছিল আউটডোর বা বাহির্বিভাগ সেবা। বহির্বিভাগের কিছু রোগীকে জরুরি বিভাগে সেবা দেয়া হলেও বেশিরভাগ মানুষই চিকিৎসা না পেয়ে ফিরে গিয়েছেন। বন্ধ ছিল দীর্ঘদিন ঘুরে পাওয়া নির্ধারিত দিনের অস্ত্রোপচারও। এতে দেশের বিভন্ন প্রান্ত থেকে আসা রোগীরা পড়েন চরম বিপাকে। দিনভর রোগীদের ভোগান্তির পর গতকাল বিকালে আন্দোলনরত চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে জানানো হয়- মঙ্গলবার সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত সীমিত পরিসরে বহির্বিভাগ সেবা চালু করা হবে। তবে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত সকাল ৮টা থেকে ১০টা স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানে চলবে অবস্থান কর্মসূচি।

গতকাল সরজমিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, সকাল থেকেই হাসপাতালটির বহির্বিভাগের চিকিৎসাসেবা বন্ধ রয়েছে। তবে নিজেদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে সেখানে ভিড় করছেন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সেবা নিতে আসা মানুষেরা। কেউ আসছেন চিকিৎসকের কাছে রোগের ব্যবস্থাপত্র নিতে, কেউ আবার আসছে ঘুরে ঘুরে পাওয়া নির্ধারিত দিনের অস্ত্রোপচার করাতে। এমনই একজন নীলফামারীর আব্দুল মাজেদ মিয়া।

গতকাল তিনি ছোট ছেলেকে নিয়ে ঢামেকের আউটডোরে এসেছিলেন নিজের শরীরের অপারেশন করাতে। মাজেদ মিয়া বলেন, আমি সারারাত জেগে গাড়িতে করে নীলফামারী থেকে ঢাকায় এসেছি শুধু ডাক্তার দেখানোর জন্য। ভোরবেলা এই ঢাকা মেডিকেলে এসেছি। আজ আমার অপারেশনের ডেট ছিল। দুই-তিন মাস ঘুরে অনেক কষ্টে আজকের এই ডেট পেয়েছিলাম। কিন্তু এখানে এসে দেখি ডাক্তারা কেউ নেই। আউটডোরে চিকিৎসা দেয়া বন্ধ রয়েছে। অনেক অপেক্ষার পরে একজন বললো ইমার্জেন্সিতে যেতে। সেখানে গেলে বলা হয়-পরে আসতে। এখন আমি কী করবো, কোথায় যাবো কিছুই বুঝতে পারছি না। আত্মীয়-স্বজনের বাসাও নেই যে সেখানে গিয়ে উঠবো। এভাবে রোগীদের বিপদে ফেলা উচিত হয়নি। রফিক বিশ্বাস নামে আরেক রোগী বলেন, আমি ময়মনসিংহ থেকে ভোর সকালে এখানে এসেছি। এসে দেখি মেডিকেল বন্ধ। আমি সাধারণ একজন রিকশাচালক। আমাকে গত মাসে ডাক্তার একটা এমআরআই করে আসতে বলেছিল। আমি অনেক কষ্ট করে ৬ হাজার টাকা খরচ করে এই এমআরআইটা করিয়ে নিয়ে এসেছি। আজকে আমার অপারেশনের ডেট দেয়ার কথা। এখন দেখছি ডাক্তারই নেই। আমি এখন কী করবো। প্রাইভেটে গিয়ে তো আমার মতো লোকের চিকিৎসা নেয়া সম্ভব নয়। এ বিষয়ে বহির্বিভাগের ওয়ার্ড মাস্টার কাজী আবু সাঈদ বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসকদের ওপর হামলার ঘটনার জেরেই  গতকাল বহির্বিভাগের চিকিৎসাসেবা রাখা হয়। বহির্বিভাগের গাইনি বিভাগের আবাসিক সার্জন ডা. রাজিব বলেন, আমাদের চিকিৎসকের ওপর হামলার ঘটনায় কমপ্লিট শাটডাউনের ঘোষণা দিয়েছিলাম আমরা। পরে নিরাপত্তা এবং দোষীদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তারের আশ্বাসে বহির্বিভাগ বন্ধ থাকলেও জরুরি বিভাগ সেবা চালু করা হয়েছে।
এদিকে হাসপাতালটির জরুরি বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, সকাল থেকেই সেখানে আগত রোগীদেরকে নির্দিষ্ট টিকিটের মাধ্যমে সেবা দেয়া হচ্ছে। এদের মধ্যে নারী, শিশু, হৃদরোগে আক্রান্তদেরকে বেশি প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। অনান্য  রোগীদেরকে পরে আসতে বলা হচ্ছে। আর যাদের অবস্থা একদই মুমূর্ষু শুধু তাদেরকেই ভর্তি নেয়া হচ্ছে হাসপাতালে। আর বহির্বিভাগের চিকিৎসাসেবা পুরোপুরি বন্ধ থাকায় সেখানকার রোগীদেরকে জরুরি বিভাগ থেকে সেবা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। এতে উপচেপড়া রোগীদের ভিড়ে জরুরি বিভাগে সেবা দিতে হিমশিম খায় চিকিৎসকরা। এ সময় জরুরি বিভাগে আসা রোগীদের মধ্যে অনেকেই মানসম্মত চিকিৎসা সেবার পরিবর্তে দায় এড়ানোর অভিযোগ তোলেন। জন্ডিসে আক্রান্ত  মায়সা নামে আড়াই বছরের মেয়েকে নিয়ে গতকাল ঢামেকে আসা বাবা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, গত তিনদিন ধরে আমি আমার মেয়েকে নিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরছি। কিন্তু কোনো চিকিৎসা পাচ্ছি না। তিনি বলেন, আমার মেয়ে অনেক অসুস্থ। গত পরশুদিন আমি ওকে নিয়ে নরসিংদী হাসপতালে যাই। সেখান থেকে মাতুয়াইল হাসপাতালে যায়। সেখান থেকে আবার গতকাল আমাদেরকে ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয়। এখানে এসে দেখি ডাক্তাররা কর্মবিরতীতে । পরে চলে যায়। আজ সকালে হাসপাতালের সেবা চালু হয়েছে বলে আবারো এখানে আসি। কিন্ত আমার মেয়েকে তেমন কোনো চিকিৎসা দেয়া হলো না। শুধু কয়েকটা ওষুধ দিয়ে বাসায় নিয়ে যেতে বলা হয়েছে। ভর্তিও করা হলো না। এখন আমার মেয়ের কিছু হয়ে গেলে কে দায় নিবে।  হাসপাতালে ভর্তি রোগীরাও আগের মতো চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন না বলেও অভিযোগ করেন তাদের স্বজনরা। মিরাজ নামে ১১১ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি হওয়া এক রোগীর স্বজন বলেন, আগে তিনজন ডাক্তার আসলে এখন আসছে একজন। নার্সরাও তেমন দেখে না। আর অপারেশন বরাও বন্ধ রয়েছে। এই দুইদিনের নির্ধারিত অপারেশন কবে হবে তারও ঠিক নেই।
অপরদিকে রাজধানীর শেরে বাংলা নগরের শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আউটডোর থেকেও প্রতিদিন ১ হাজার থেকে ১২শ’ রোগী চিকিৎসা নেন। তবে চিকিৎসকদের আন্দোলনে গতকাল সকাল থেকে চালু থাকলেও দুপুর ১২টা থেকে সেখানেই আউটডোর সেবা বন্ধ করে দেয়া হয়। হঠাৎ করে বহির্বিভাগের সেবা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দুর্ভোগে পড়েছেন দূর-দুরান্ত থেকে আসা রোগী ও তাদের স্বজনরা। সাভার থেকে গতকাল সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা সোহানুর রহমান বলেন, সকাল থেকে আমরা লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ১২টার দিকে হঠাৎ আউটডোর বন্ধ করে দিয়ে ডাক্তাররা চলে যায়। সবক’টি কাউন্টার বন্ধ করে দেয়া হয়। এখন এই অসুস্থ শরীর নিয়ে আমি কোথায় যাবো। আমাদের মতো রোগীদের জিম্মি করে এমন আন্দোলন মোটেও উচিত নয় বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। মো. মাসুদ নামে আরেক রোগী বলেন, পায়ে ব্যথা নিয়ে হাঁটতে পারছি না। এরপর চিকিৎসা বন্ধ করে দেয়া হলো। আমার মতো শত শত মানুষ আজ এই আন্দোলনের কারণে ভোগান্তির শিকার। হাসপাতালটির সহকারী প্রধান পরিসংখ্যান কর্মকর্তা এসএএম কামরুজ্জামান সূবর্ণ বলেন, মূলত ডাক্তারদের ধর্মঘটের কারণেই আউটডোর সেবা ১২টার পর বন্ধ করে দেয়া হয়। তবে জরুরি বিভাগে রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এদিকে দিনভর রোগীদের ভোগান্তির পর বিকাল ৪টার দিকে ঢাকা মেডিকেলের প্রশাসনিক ব্লকে এক সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনরত চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে নিউরো সার্জারি বিভাবের চিকিৎসক ডা. মো. আব্দুল আহাদ বলেন, জরুরি বিভাগ চালুর পর সীমিত পরিসরে ইনডোরে সেবাদান করছি। এ ছাড়া, আমাদের বিভিন্ন কার্যক্রম চালু রেখেছি, এগুলো চালু থাকবে। তিনি বলেন, আমাদের সঙ্গে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা দীর্ঘক্ষণ বৈঠক করেছিলেন। সেখানে তিনি আশ্বস্ত করেছিলেন যে, চিকিৎসকদের ওপর যারা হামলা করেছে তাদের দ্রুত গ্রেপ্তার করা হবে। এ ছাড়া, হাসপাতালে চিকিৎসকদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হবে। এরই মধ্যে আমরা দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখেছি। ইতিমধ্যে ঘটনায় জড়িত একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হাসপাতালে হামলার ঘটনায় চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকি যারা আছে তাদেরও দ্রুত গ্রেপ্তার করতে হবে। তিনি আরও বলেন, স্বাস্থ্য উপদেষ্টার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ঢামেক হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল হাসপাতালের ডেন্টাল কলেজে নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। এর আগে, আমাদের নিরাপত্তার আশ্বাস পেয়ে রোববার সন্ধ্যা থেকে সব হাসপাতালে জরুরি বিভাগ চালু হয়েছিল, সেগুলো চালুই থাকবে। ডা. আব্দুল আহাদ বলেন, আমাদের দুই দফা দাবির মধ্যে রয়েছে- ঘটনায় জড়িত একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকিদেরও দ্রুত আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে এমন ঘটনা আর না ঘটে। আরেকটি দাবি হলো- হাসপাতালে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী এবং রোগীর সুরক্ষা নিশ্চিত করে আইন প্রণয়ন এবং স্বাস্থ্য পুলিশ নিয়োগে আইন প্রণয়ন করতে হবে।  তিনি বলেন, আগামীকাল থেকে সীমিত পরিসরে অর্থাৎ সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত বহির্বিভাগে সেবাদান চালু থাকবে। সকাল ৮টা থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানে আমাদের অবস্থান কর্মসূচি চলবে।

No comments

Powered by Blogger.