ক্ষমতাচ্যুত হাসিনা ভারতের কূটনৈতিক মাথাব্যথা হয়ে উঠেছেন -এএফপি’র রিপোর্ট

ক্ষমতা হারিয়ে পালিয়ে ভারতে গিয়ে ভারত সরকারের কূটনৈতিক মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছেন শেখ হাসিনা। ছাত্রদের নেতৃত্বে বাংলাদেশে যে বিপ্লব হয়েছে তাতে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী আকাশপথে পালিয়ে নয়াদিল্লি চলে যান। তা নিয়ে বিস্তর সমালোচনা চারদিকে। বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশে ভারতের অবস্থান নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেয়ার কারণে তিনি এখন ভারতের  জন্য কূটনৈতিক মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছেন। বার্তা সংস্থা এএফপি’র এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, ১৫ বছর ধরে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বিরোধীদের ওপর দমনপীড়নের পর গত মাসে শেখ হাসিনার কঠোর শাসনের অবসান ঘটে। বাংলাদেশে গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্ররা এখন শেখ হাসিনাকে ভারতের কাছে ফেরত চাইছে। শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে পর্যন্ত তাকে ক্ষমতায় রেখে সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী এই ভারত। আন্দোলনের সময় যেসব প্রতিবাদীকে হত্যা করা হয়েছে তার জন্য শেখ হাসিনার বিচার দাবি করছেন ছাত্ররা।

কিন্তু ৭৬ বছর বয়সী এই নেত্রীকে বাংলাদেশের কাছে ফেরত পাঠালে তাতে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের অন্য প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকিতে। এই অঞ্চলে চীনের প্রভাবের বিরুদ্ধে ভারত এমনিতেই তীব্র লড়াই করছে। যুদ্ধ বিষয়ক থিংক ট্যাংক ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের থমাস কিয়ান বলেন, এটা স্পষ্ট যে, শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাবে না ভারত। যদি তাকে ফেরত পাঠানো হয় তাহলে এ অঞ্চলে অন্য দেশগুলোর যেসব নেতার সঙ্গে নয়াদিল্লির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে, তা খুব ইতিবাচক হবে না। তা হলো- ভারত তোমাকে রক্ষা করবে না।  
গত বছর মালদ্বীপে পছন্দের প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে প্রতিদ্বন্দ্বী মোহাম্মদ মুইজুর কাছে পরাজিত হতে দেখছে নয়াদিল্লি। পর্যটনের গন্তব্য মালদ্বীপ বেইজিংয়ের দিকে খুব বেশি ঝুঁকে পড়েছে। শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ায় এই অঞ্চলে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্রকে হারিয়েছে ভারত। শেখ হাসিনার সময়ে তার সরকার যাদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছিল, তারা প্রকাশ্যে ভারতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মেগাফোন কূটনীতি চালু করেছেন এবং পরিচালিত হয়েছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসনের দিকে। শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ৮৪ বছর বয়সী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার সরকারকে সমর্থন দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু মোদি তার ক্ষমতার মেয়াদে হিন্দুত্ববাদের বিশ্বাসকে শক্তিশালীভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি বার বার ড. ইউনূসের প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশে ধর্মীয় হিন্দু সংখ্যালঘুদের সুরক্ষিত রাখতে।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি’র চেয়ে বাংলাদেশের হিন্দু সংখ্যালঘুদের জন্য আওয়ামী লীগকে বেশি সুরক্ষাকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সপ্তদশ শতাব্দীর রেডফোর্টে বার্ষিক স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে মোদি বলেছেন, বাংলাদেশের হিন্দুরা বিপদে আছেন। পরে তিনি এই ইস্যু উত্থাপন করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে। শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে কিছু হিন্দু ও তাদের মন্দির টার্গেট হয়েছে। কিন্তু তাকে অতিরঞ্জিত করে ভারতের সরকারপন্থি নিউজ চ্যানেলগুলো প্রচার করে। তাতে মোদির দলের সঙ্গে যুক্ত এমন হিন্দুত্ববাদী অধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলো প্রতিবাদ বিক্ষোভ করে।
বিএনপি’র শীর্ষস্থানীয় নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, শেখ হাসিনাকে সমর্থন করে ভারত তার সব ফল এক ঝুড়িতে রেখেছে। তারা জানতো কীভাবে এর বিপরীত প্রতিক্রিয়া হয়। তিনি এএফপিকে বলেন, ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক চায় বাংলাদেশের জনগণ। তবে সেটা তাদের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে নয়। দুর্ভাগ্যজনক হলো ভারতের মনোভাব আস্থা সৃষ্টির মতো নয়।
এমনই যখন অবিশ্বাসের পরিবেশ তখন আগস্টে ভয়াবহ বন্যা উভয় দেশের বিপুল অংশকে ডুবিয়ে দেয়। এর জন্য অনেক বাংলাদেশি ভারতকে দায়ী করেন। তারা বলেন, তাদের কারণে অনেক মৃত্যু হয়েছে। শেখ হাসিনার ভারতে আশ্রয় নেয়ার বিষয়টি নয়াদিল্লির কাছে সরকারিভাবে তুলে ধরেনি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। শেখ হাসিনা নয়াদিল্লির কাছে একটি সামরিক বিমানঘাঁটিতে সুরক্ষিত অবস্থায় আছেন। তার বিষয় তুলে না ধরলেও এরই মধ্যে বাংলাদেশ সরকার তার কূটনৈতিক পাসপোর্ট বাতিল করেছেন। এর মধ্যদিয়ে তার সফরের ক্ষেত্রে প্রতিরোধ সৃষ্টি করা হয়েছে। দ্বিপক্ষীয় বন্দি প্রত্যার্পণের চুক্তিতে ২০১৩ সালে প্রথম স্বাক্ষর করে দুই দেশ। ফলে ফৌজদারি অপরাধের বিচারের জন্য শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো অনুমোদন করে। চুক্তির একটি ধারা বলে যে, যদি অপরাধটি ‘রাজনৈতিক চরিত্রের’ হয় তাহলে প্রত্যার্পণ নাও করা হতে পারে। বাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, ঢাকার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তা শেখ হাসিনাকে ফেরত চেয়ে চাপ সৃষ্টি করলে তিক্ত হয়ে উঠতে পারে। তিনি আরও বলেন,  যেকোনো পরিণত সরকার এটা বুঝতে পারবে যে, ভারতে হাসিনার অবস্থানকে ইস্যু করা হলে তা কারও জন্য সুবিধা দেবে না।

No comments

Powered by Blogger.