সুইস ব্যাংক তো নস্যি ২ লাখ কোটি টাকার কি হবে by আলী ইদ্‌রিস

বাংলাদেশের অর্থ পাচারকারীরা এবার জাতে উঠেছে অথবা বলা যায় কালো টাকা নিয়ে অভিজাত শ্রেণীর কাতারে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, মালয়েশিয়া, সিংগাপুর, থাইল্যান্ড ভিয়েতনামের পর পৃথিবীর বড় বড় ধনীদের সঙ্গে কালো টাকা সুইস ব্যাংকের ভল্টে জমা পড়েছে। মিডিয়ার রিপোর্ট অনুসারে ২০১২ সাল পর্যন্ত সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের আমানত ১,৯০৮ কোটি টাকা ছিল। ২০১৩ সালে সে অর্থ ৩,১৬২ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। এ অর্থ পাচারকৃত মোট অর্থের ১.৫ শতাংশ। স্বাধীনতার পর গত চার দশকে ২ লাখ কোটিরও অধিক অর্থ পাচার হয়েছে। এসব অর্থ পৃথিবীর বিভিন্ন ব্যাংকে গচ্ছিত এবং বাকিটা বিদেশে বাড়ি, গাড়ি, শিল্প-কারখানা ইত্যাদিতে বিনিয়োগ হয়েছে। সুইজারল্যান্ডে বাংলাদেশী আমানতকারীরা বড় ব্যাংক বেছে নেয়নি, ছোট ছোট ব্যাংকগুলোতে টাকা জমা রেখেছে। বড় দুই ব্যাংক ইউবিএস ও ক্রেডিট সুইসে মাত্র ১ কোটি ৮৯ লাখ ডলার আমানত আছে। ইউএনডিপির এক প্রতিবেদন মতে, বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হওয়া দেশের মধ্যে বাংলাদেশের স্থান দ্বিতীয়। প্রথম স্থানে রয়েছে আইভরি কোস্ট। অর্থ পাচার একটি অবৈধ বা অনৈতিক কাজ হলেও কোন নির্দিষ্ট দেশে পাচারকারী নেই এমন গ্যারান্টি দেয়া অসম্ভব। বিনা কারণে, উৎসুক্য বশত বা হবি হিসাবেও কেউ কেউ সুইস ব্যাংকে টাকা রাখে। কিন্তু বদনাম সুইস ব্যাংকের হলেও অন্যান্য দেশে যেমন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া- এসব দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধিকল্পে বিভিন্ন আকর্ষণীয় স্ক্রিমের আওতায় বৈদেশিক বিনিয়োগ আহ্বান করা হয়। ওই সব দেশে প্রবাসী ও অভিবাসী ছাড়াও অসংখ্য বাংলাদেশীর বাড়ি, গাড়ি, শেয়ার, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়ে গেছে। কেউ বাড়ি কিনেছেন নিজে বা ছেলে মেয়ে থাকার জন্য, কেউ কিনেছেন ভাড়া দিয়ে আয় করার জন্য। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হয়তো কম লোকেরই আছে। বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে তারা এই লাখ লাখ ডলার কিভাবে বিদেশে বিনিয়োগ করলেন বা ব্যাংকে জমা করলেন সেটা অনুসন্ধানের বিষয়। ব্যাংকের মাধ্যমে আইন অনুযায়ী বিদেশে বিনিয়োগ করার সুযোগ সীমিত, তাই হুন্ডি বা অন্য চ্যানেলে এসব অর্থ পাচার হয়েছে যা মানি লন্ডারিং আইনে অপরাধ। বড় বড় দেশে অর্থ পাচার বিগত ৪০ বছর যাবৎ চলছে। পাশের দেশ মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম স্কিমে হাজার হাজার বাংলাদেশী লাখ লাখ ডলার বিনিয়োগ করে সে দেশের নাগরিকত্ব লাভ করছেন অথচ মালয়েশিয়া মাত্র সেদিন এই ‘সেকেন্ড হোম’ সুযোগ সৃষ্টি করেছে এবং প্রকাশ্যে এ দেশের পত্রিকাতে বিজ্ঞাপন প্রচার করে আসছে। এরই মধ্যে লাখ লাখ ডলার পাচার হয়ে গেছে। একইভাবে স্বাধীনতার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য দেশে অভিবাসন ও ব্যবসা স্কিমে হাজার হাজার বাংলাদেশী কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে সুবিধাগুলো নিয়েছেন। ওই টাকা আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিয়ে গেল না পাচার হলো, মানি লন্ডারিং আইন এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কি না, সবই খতিয়ে দেখার বিষয়। ইউএনডিপির প্রতিবেদন অনুযায়ী গত চার দশকে ২ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে, অংকটি ক্ষুদ্র বলে মনে হয়। পাচারকৃত অর্থ আরও অনেক বেশি হওয়া উচিত। নৈতিকতার ব্যাপারটা বাদ দিলে অর্থ পাচারের কারণ হলো: দুর্নীতি, আত্মসাৎ, ব্যবসার মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক অর্থ বিদেশে রেখে দেয়ার প্রবণতা, দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক অস্থিরতা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, লাভজনক বিনিয়োগের ক্ষেত্রের অভাব, সুশাসনের অভাব বা আইন শৃঙ্খলার ব্যাপক অবনতি ইত্যাদি। উপরোক্ত যে কোন কারণেই হোক, পাচারকারীদের এ অর্থ এক সময়ে দেশে ফেরত আনা উচিত। কিন্তু এখানেই সমস্যা। পাচারকৃত অর্থ খুব কম ক্ষেত্রেই দেশে ফেরত আসে। কারণ পাচার করতে যেমন ঝুঁকি নিতে হয়, ফেরত আনাও তেমনি ঝুঁকিপূর্ণ। তাই পাচারকারীরা দু’বার ঝুঁকি নিতে চায় না। তাছাড়া দেশপ্রেমের অভাব বা দেশের আয়কর আইন, মানি লন্ডারিং আইনের জরিমানা বা শাস্তির ভয়ে কেউ ওই টাকা ফেরত আনতে চায় না। অন্যদিকে এ টাকা উদ্ধার করাও সহজ নয়। বাংলাদেশ বর্তমানে অর্থ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক জোট ‘এগমন্ট’ গ্রুপের সদস্য হওয়ায় সুইস ব্যাংক এবং অন্যান্য দেশ থেকে তথ্য পেতে সহায়ক হবে। তথাপি পুরোপুরি তথ্য কথনও পাওয়া যাবে না। তবে আইনি যুদ্ধ চালিয়ে কৃতকার্য হওয়া দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। তাই পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারের প্রচেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে ওই টাকা যাতে সহজে দেশে ফেরত আসতে পারে সে উদ্দেশ্যে অন্যান্য দেশের মতো কিছু স্কিম বা বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া উচিত। কালো টাকা সাদা করার মতো পাচারকৃত টাকা জরিমানা দিয়ে নির্দিষ্ট শিল্পে বা অবকাঠামোতে বিনিয়োগ করার সুযোগ দেয়া যেতে পারে। পাচার যাতে না হয় তার প্রতিকার করা যেমন সরকারের দয়িত্ব, তেমনি কালো টাকার মতো পাচারকৃত টাকারও সৎকার করা সরকারের কর্তব্য। আমাদের হৃদয়ে নৈতিক উন্নতি ও দেশপ্রেম জাগ্রত না হওয়া পর্যন্ত অর্থ পাচার হবেই, কিন্তু কৌশলে সে অর্থ ফিরিয়ে আনাই কৃতিত্ব। তাই শুধু সুইস ব্যাংকের ১.৫% পাচারকৃত অর্থের জন্য সাময়িকভাবে হৈ চৈ না করে সামষ্টিকভাবে বিভিন্ন স্কিমের মাধ্যমে পুরো পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা উচিত।

No comments

Powered by Blogger.