সড়ক–মহাসড়কে জোড়াতালির মেরামত হচ্ছে -বেহাল সড়কের কথা স্বীকার করলেন মন্ত্রী

সারা দেশের বেহাল সড়ক-মহাসড়কের কথা অবশেষে স্বীকার করল সরকার। ঈদে ঘরমুখী মানুষের চলাচল নির্বিঘ্ন করতে এসব সড়ক-মহাসড়ক মেরামতের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। তবে ইট-বালু-সুরকি দিয়ে খানাখন্দ ভরাট করায় এই মেরামত হবে জোড়াতালির।

এই মেরামতের জন্য সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ঈদের ছুটি বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া, ঈদ উপলক্ষে যান চলাচল নির্বিঘ্ন করতে ঈদের আগে তিন দিন এবং পরের দুই দিন পচনশীল ও জরুরি রপ্তানি পণ্যবাহী ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান চলাচল বন্ধ রাখা, মহাসড়কে চলতে না দেওয়া, যান চলাচল বাধাগ্রস্ত হয় এমন উন্নয়নমূলক কাজ সাময়িক বন্ধ রাখারও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
অবশ্য ঈদ উপলক্ষে এর আগেও মহাসড়কে ট্রাক, নছিমন-করিমন চলাচল বন্ধ ছিল, কর্মকর্তাদের ছুটিও বাতিল করা হয়েছিল।
গতকাল শুক্রবার বিকেলে আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকে বেহাল সড়ক-মহাসড়কের বিষয়টি স্বীকার করে নিয়ে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এসব সিদ্ধান্তের কথা জানান। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক নিয়ে সওজের কর্মকর্তাদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘রাস্তার সঠিক চিত্র আমাকে দেওয়া হয় না। মহাসড়কের সবকিছু ঠিক, এটা সত্য না। ইট-সুরকি-খোয়ার মেরামত বৃষ্টি হলে উঠে যাচ্ছে। পথে বাস আটকে যাচ্ছে। ভিতর থেকে ফোন আসে আমার কাছে। শিশুর কান্না, নারীর কান্না আমকে শুনতে হয়।’
বৈঠকে উপস্থিত বিভিন্ন জেলার প্রশাসক ও পুলিশ সুপার এবং পরিবহন মালিক-শ্রমিকেরাও সড়কের দুরবস্থা জানিয়ে ঈদে ঘরমুখী মানুষের যাতায়াত নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন। সভায় ২০ জুলাইয়ের মধ্যে সব সড়ক চলাচলের উপযোগী করার সিদ্ধান্ত হয়।
সারা দেশের বেহাল সড়ক নিয়ে এই বৈঠক হয় রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে। এতে চারজন মন্ত্রী, একাধিক সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শকসহ সরকারের বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তা ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
প্রথম আলোতে গত মঙ্গলবার বেহাল সড়ক-মহাসড়ক নিয়ে একাধিক সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। কিন্তু পরদিন সড়ক বিভাগ থেকে প্রতিবাদপত্র পাঠিয়ে বলা হয়, বৃষ্টির কারণে সড়ক বেহাল হলেও তা ঠিক করে ফেলা হয়েছে। অথচ বৃহস্পতিবার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের খানাখন্দ ঠিক না হলে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেয় পরিবহন মালিক সমিতি।
সওজের মহাসড়ক ব্যবস্থাপনা বিভাগের (এইচডিএম) করা সর্বশেষ সমীক্ষায় এসেছে, সারা দেশের ৪১ শতাংশ সড়ক-মহাসড়কেরই অবস্থা খারাপ। এর মধ্যে ১২ শতাংশ সড়ক-মহাসড়ক খুবই বেহাল, খানাখন্দে ভরা। বাকি ৫৯ শতাংশের মধ্যে ২০ শতাংশ ভালো। ৩৯ শতাংশ মোটামুটি কাজ চালানোর মতো ভালো।
প্রথম আলোর বিভিন্ন জেলার প্রতিনিধিরা জাতীয় মহাসড়কগুলোতে সরেজমিনে খানাখন্দ দেখতে পান। ঢাকার সঙ্গে সংযোগ রক্ষাকারী অন্তত ছয়টি মহাসড়কের প্রায় ২০০ কিলোমিটার পথ একেবারেই বেহাল ও ভগ্নদশা।
গতকাল আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকে উপস্থিত একাধিক সূত্র জানায়, বৈঠকে ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সভাপতি আবুল কালাম বলেন, ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যেতে ছয় ঘণ্টার যাত্রা ১৬ ঘণ্টা লাগছে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক যন্ত্রণায় পরিণত হয়েছে। এই সড়ক যে কত ভয়াবহ, কেউ না দেখলে বুঝতে পারবে না। তিন-চার ঘণ্টার যাত্রায় আট-নয় ঘণ্টা লাগছে। তিনি মন্ত্রী-কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমরা কত ঘণ্টায় গন্তব্যে যেতে পারব, আপনারা বলে দেন। আর কত জ্বালানি পুড়ব, গাড়ি নষ্ট করব।’
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক নুরুল ইসলাম বলেন, গাজীপুর দিয়ে ২২টি রুটের যান চলে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের মাওনাতে ব্যাপক সমস্যা। ঈদে তা প্রকট হবে। তখন তা দুর্যোগে পরিণত হতে পারে।
ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক মুস্তাকিম বিল্লাহ ফারুকী বলেন, ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়ক কাঁচা রাস্তার মতো হয়ে গেছে। একদিকে জোড়াতালির মেরামত হচ্ছে, অন্যদিকে বৃষ্টি হলে তা উঠে যাচ্ছে। ইট-বালু-খোয়ার বাইরে অন্য কোনো ব্যবস্থা আছে কি না, তা ভেবে দেখতে হবে।
এসব বিষয়ে যোগাযোগমন্ত্রী বলেন, পত্রপত্রিকার প্রতিবেদন উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কিছু কিছু সড়ক শুধু খারাপ নয়, খুবই বেহাল। তিনি জানান, আজ শনিবার পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের নিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক পরিদর্শনে যাবেন। সড়ক বিভাগের সচিব একই ধরনের দল নিয়ে ঢাকা-ময়মনসিংহ এবং একজন অতিরিক্ত সচিব ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক পরিদর্শনে যাবেন। এতে সরকারের অন্য বিভাগের কর্মকর্তাদেরও সহায়তা চান তিনি।
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক চার লেন করার কাজের একাংশের দায়িত্ব পেয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। গাজীপুরের মাওনার বিষয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসেনের বক্তব্য জানতে চান যোগাযোগমন্ত্রী। জবাবে সাজ্জাদ হোসেন বলেন, রাস্তা মেরামত হচ্ছে। নিয়মিত মেরামত না হলে চলাচল বন্ধ হয়ে যেত।
এ সময় মাওনা উড়ালসড়কের কাজ ঈদে বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, চার লেন প্রকল্পে নতুন রাস্তা ভালোভাবেই হচ্ছে। কিন্তু বিদ্যমান সড়ক কেউ মেরামত করতে চায় না। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কও চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিনোহাইড্রো মেরামত করেনি। বিকল্প ব্যবস্থায় সরকার সেই কাজ করছে।
হাইওয়ে পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) আছাদুজ্জামান মিয়া ঈদ উপলক্ষে মহাসড়কে সব ধরনের চাঁদাবাজি বন্ধ, ওভারটেকিং প্রতিরোধ ও নছিমন-করিমন-ভটভটি বন্ধে নেওয়া নানা পদক্ষেপের কথা জানান। সড়কের দুরবস্থার উল্লেখ করে তিনি বলেন, বালু-ইট-খোয়ার মেরামত বৃষ্টি হলেই ধুয়ে যাচ্ছে। কুমিল্লার পদুয়ার বাজারে রেলক্রসিংয়ে গর্তে গাড়ি আটকে বিকল হয়ে যাচ্ছে। রেল ও সওজ কেউ দায়িত্ব নিচ্ছে না।টাঙ্গাইলে একটি বেইলি সেতু অকেজো হয়ে আছে। মাওনাতেও সড়কে নির্মাণকাজ চলায় যান চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
এ বিষয়ে যোগাযোগমন্ত্রী সওজের প্রধান প্রকৌশলী মফিজুল ইসলামের জবাব চান। মফিজুল ইসলাম বলেন, বেইলি সেতু সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয়েছে। সড়ক মেরামতে কাজ চলছে। তখন তাঁর উদ্দেশে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আপনি জানবেন কীভাবে? আপনি তো অফিস থেকে বের হন না। আমি নিজে দেখেছি, বেইলি ব্রিজের মাঝখানের অংশ নেই। এটা এক সপ্তাহ আগে মেরামতের কথা ছিল। এটা কোথায় গেছে?’
এরপর রেলওয়ের মহাপরিচালক তাফাজ্জল হোসেন পদুয়ার বাজারের রেলক্রসিংয়ের গর্ত মেরামতের আশ্বাস দেন। তিনি জানান, রেলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ঈদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে।
পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেন, আগের দিন সড়ক মেরামতের পর বৃষ্টিতে পরের দিনই ভেসে যায়। তিনি রাস্তা মেরামতের বাড়তি মালামাল সব সময় মজুত রাখার পরামর্শ দেন।
ঢাকার ভেতর ও প্রবেশমুখেও সমস্যা: বৈঠকের শুরুতেই ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে বিভিন্ন সড়কের বেহাল দশা ভিডিওচিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়। বলা হয়, ঢাকার প্রবেশমুখ ও বের হওয়ার পথগুলো মসৃণ না করতে পারলে ভোগান্তির সীমা থাকবে না।
তখন ওবায়দুল কাদের বলেন, অনেক রাস্তার অবস্থা বেহাল।সত্যকে চাপা দেওয়া যাবে না। সত্যকে চাপা দিলে মানুষ কষ্ট পাবে। তিনি বলেন, টুকটাক সমস্যা না। রাজধানীর রাস্তাগুলো ভোগান্তির আখড়া হয়ে গেছে।
সমবায় প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান বলেন, পত্রিকায় দেখা গেছে, এক নারী রিকশা থেকে ছিটকে গর্তে পড়ে গেছেন। এর দায় নেবে কে, বলেন।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও ঢাকা ওয়াসার কর্মকর্তারা ২০ জুলাইয়ের মধ্যে সড়ক ঠিক করার কথা বলেন।
পরে ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদ বলেন, ২০ তারিখের পর বৃষ্টি হলে সড়ক ভাঙবে। তখন কার সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে?
এরপর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোজাম্মেল হকের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়।
বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক। শাজাহান খানের পরিবারের বাস কোম্পানি রয়েছে। তবে তিনি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি। মশিউর রহমান বাস মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির সভাপতি। নাগরিক সমাজের পক্ষে বৈঠকে অংশ নেন কলাম লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সামছুল হক, চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন প্রমুখ।
বৈঠকে পরিবহন খাতের শ্রমিক-মালিক প্রতিনিধিরা বক্তব্য দেওয়ার সময় যোগাযোগমন্ত্রী বলেন, ‘আমার দুই পাশে আপনাদের দুই মন্ত্রী আছেন।’
একপর্যায়ে ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সভাপতি আবুল কালাম বলেন, পত্রপত্রিকায় বাসের বাড়তি ভাড়া নেওয়ার সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। অথচ সড়কের দুরবস্থার জন্য পথে পথে বাড়তি জ্বালানি পুড়তে হয়। এটা কেউ দেখে না।
এরপর নৌমন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা স্বাভাবিক সময়ে সরকার-নির্ধারিত ভাড়াটা নিতে পারেন না, কম নেন। ঈদের সময় পুরো ভাড়াটাই নেন। এটাকেই অনেকে না বুঝে বাড়তি ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ তোলে। লঞ্চেও এই ঘটনা ঘটে।’ মশিউর রহমান বলেন, ‘আমাদের কপাল খারাপ, কী করবেন? একটা বাসে বেশি ভাড়া নিলে সবার নাম হয়।’

No comments

Powered by Blogger.