শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ডাক

১৮-দলীয় জোটের প্রধান নেতা ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আর কোনো হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি ঘোষণা করেননি। এ জন্য তাঁকে ধন্যবাদ দিতে হয়। কারণ, কয়েক মাস ধরে এই নেতিবাচক কর্মসূচির ফলে বাংলাদেশের জনগণ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে; আন্দোলনের নামে মানুষের প্রাণহানি, ধ্বংসযজ্ঞ, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অচলাবস্থা ও জনজীবনে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টির এই ধারা আর চলতে দেওয়া উচিত নয়। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নয় দিন পর গত বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়া নতুন সরকারকে ‘অবৈধ সরকার’ আখ্যা দিলেও এ সরকারের সঙ্গে সংলাপ ও সমঝোতার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন—এটাকেও আমরা ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করতে চাই। কারণ, সংলাপ-সমঝোতা ছাড়া চলমান রাজনৈতিক সমস্যা থেকে উত্তরণের কোনো বিকল্প নেই। সরকারের ‘বৈধতা’র প্রশ্নটির থেকে এখন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দুই পক্ষের মধ্যে কার্যকর রাজনৈতিক সম্পর্কের সূচনা ঘটানো।
শুধু সংলাপের মাধ্যমেই সেটির সূচনা ঘটানো সম্ভব, যেখানে সমঝোতার মানসিকতা অপরিহার্য। হরতাল-অবরোধের মতো সহিংস কর্মসূচির উল্লেখ না করে খালেদা জিয়া ‘গণতন্ত্রের জন্য শান্তিপূর্ণ আন্দোলন অব্যাহত’ রাখার যে ঘোষণা দিয়েছেন, তাতে আমাদের পরিপূর্ণ স্বস্তি বোধ হয় না। কারণ, তাঁর ভাষায় যে ‘শান্তিপূর্ণ আন্দোলন’ এত দিন চলে এসেছে, তা ‘অব্যাহত’ রাখা হলে জনজীবনে শান্তি ফিরে আসবে না। সবকিছুর আগে এই সহিংস ও ধ্বংসাত্মক আন্দোলনের ধারা বন্ধ করতে হবে। মুখে ‘শান্তিপূর্ণ’ আন্দোলনের কথা বলা আর কার্যত জবরদস্তিমূলক, সহিংস, আতঙ্ক সৃষ্টিকারী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়ে জনজীবনে অচলাবস্থা সৃষ্টি করা স্ববিরোধিতা। বিরোধী জোটের কর্মসূচিগুলোতে যেসব সহিংসতা ঘটেছে, সেগুলোর দায়দায়িত্ব সরকারের ওপর চাপিয়ে বিরোধী জোট দায়মুক্ত থাকতে পারে না। উপর্যুপরি সহিংস কর্মসূচির মধ্য দিয়ে জনসাধারণের সঙ্গে বিরোধী জোটের যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হয়েছে, তা দূর করতে বিরোধী জোটের এযাবৎকালের আন্দোলনের ধারা ‘অব্যাহত’ রাখার ভাবনাটি বাদ দিয়ে ‘শান্তিপূর্ণ আন্দোলন’ কথাটির প্রতি আন্তরিকতার প্রকাশ ঘটাতে হবে বাস্তব ক্ষেত্রে।
সরকারকেও দমন-পীড়নের কৌশল পরিত্যাগ করে বিরোধী দলগুলোর সংবিধানপ্রদত্ত অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার অজুহাতে বিরোধী জোটকে গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত করা এবং তাদেরকে সম্পূর্ণ কোণঠাসা করে রাখার কৌশল বজায় রেখে সরকার সুষ্ঠুভাবে দেশ পরিচালনা করতে পারবে না। অর্ধেকের বেশি আসনে একেবারেই ভোট না হওয়া এবং অবশিষ্ট আসনগুলোতে প্রধান বিরোধী দলের অংশগ্রহণ না থাকায় নতুন সরকারের রাজনৈতিক বৈধতা ও গ্রহণযোগ্যতার ভিত্তি দুর্বল। এই প্রেক্ষাপট স্বীকার করে নিয়ে সরকারকে বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক সদাচরণের নীতি গ্রহণ করে সামগ্রিক সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রয়াস নিতে হবে; সর্বোপরি সমঝোতার মানসিকতা নিয়ে সংলাপ শুরু করতে হবে। বিরোধী জোটকে রাজনৈতিক আন্দোলনে বাধা না দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে তা পালনে সহযোগিতা করা সরকারের দায়িত্ব বৈকি।

No comments

Powered by Blogger.