কার হাসি কে হাসে?

২০০১ সালের নির্বাচনের আগে দুটো প্রধান শিবিরই এরশাদের জাতীয় পার্টিকে নিজেদের জোটে নিতে সক্রিয় ছিল। এর আগে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পর তিনি আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় যেতে সমর্থন দেন। বিনিময়ে তাঁর পাঁচ বছরের বন্দিজীবনের আপাতসমাপ্তি ঘটে। তবে সে সরকারের মেয়াদকালেই জনতা টাওয়ার মামলায় দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত হন তিনি। তাই ২০০১ সালে অভিমানে আওয়ামী লীগের দিকে হাত বাড়াননি। আস্থা-অনাস্থার দোলাচলে যাননি সরাসরি অপর পক্ষের দিকেও। ভেবেছিলেন ঝুলন্ত সংসদ হবে। তাঁর দল হবে ক্ষমতার নির্ণায়ক। যেমন কিছুটা হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। সে প্রত্যাশায় ওই বছরে এককভাবেই প্রার্থী দেন। বারবার ঘোষণা করেন, শেষ হাসি তিনি হাসবেন। হাসতে পারেননি তিনি। সেই নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়েই চারদলীয় জোট সরকার গঠন করে। ২০০৭ সালের নির্ধারিত নির্বাচনের আগে মহাজোটের সঙ্গে করেন আঁতাত। সে নির্বাচনটি হয় ২০০৮ সালের শেষে। জানা যায়, মহাজোট নির্বাচিত হলে তাঁকে রাষ্ট্রপতি করাসহ আরও কিছু দাবি ছিল তাঁর। মহাজোটই বিজয়ী হয়েছিল। মহাজোটের ছিল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। তাই তারা এসব দাবি মেটানোর কোনো গরজই অনুভব করেনি।
সেবারেও তিনি তাঁর সে ঈপ্সিত হাসি হাসতে পারেননি। ক্ষুব্ধ ছিলেন বরাবর। সমঝোতা ও মোকাবিলা দুই ধরনের নিয়েই মহাজোটের সঙ্গে চলেছেন। বারবার নেতা-কর্মীদের বলেছেন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাঁর দল এককভাবে অংশ নিয়ে জয়লাভ করবে। গঠন করবে সরকার। ‘শেষ হাসির’ কথা উল্লেখ না করলেও বক্তব্যের সুর অনেকটা সে ধরনের ছিল। কিন্তু দশম সংসদ নির্বাচনের সময়সীমা ঘনিয়ে আসতেই তিনি ডিগবাজিতে নেমে পড়েন। তাঁর ডিগবাজির সঙ্গে দেশবাসীর পরিচয় দীর্ঘদিনের। উল্লেখ্য, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার সময় সেনাপ্রধান ছিলেন এরশাদ। খবর পেয়েই অসুস্থ উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তারকে হাসপাতাল থেকে এনে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিতে মুখ্য ভূমিকা ছিল তাঁর। আরও ভূমিকা রেখেছিলেন, যাতে তিনি (বিচারপতি সাত্তার) দলের মনোনয়ন লাভ করেন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে। তা-ই ঘটেছিল। রাষ্ট্রপতি হন বিচারপতি সাত্তার। দ্রুত ভোল পাল্টে যায় এরশাদের। তিনি গণমাধ্যমে বিবৃতি দিতে থাকেন সামরিক বাহিনীকে ক্ষমতার অংশীদার করার দাবিতে। এক অন্ধকার রাতে বন্দুকের নলের মুখে নিজেই নিয়ে নেন রাষ্ট্রক্ষমতা। তবে সামরিক বাহিনীকে ক্ষমতার অংশীদার করেননি তিনি।
করেছিলেন তাঁর আস্থাভাজন কিছু সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তিকে। তখনো বহু নাটক দেখেছে দেশবাসী। তারা জানল, তাদের রাষ্ট্রপতি একজন কবি আর প্রেমিকও বটে। ‘কবি’ এরশাদ কবিতা লিখে পীড়িত করেছেন জাতিকে। ‘প্রেমিক’ হিসেবে ভেঙেছেন বেশ কিছু সুখের সংসার। পাশাপাশি দেশবাসীকে দিয়েছেন গণতন্ত্রের নতুন পাঠ। দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলকে বিপরীতমুখী রেখে ক্ষমতার বলয় টিকিয়ে রাখেন লম্বা সময়। কিন্তু একসময় অঘটন ঘটে যায়। অবশ্য অঘটন তাঁর জন্য। জাতির ঘটে রাহুমুক্তি। এর পরপর তাঁকে দীর্ঘ কারাবাস করতে হয়। মোকাবিলা করতে হয় অনেক মামলার। আবার প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের চরম বিপরীতমুখী অবস্থানের সুযোগ নিতে থাকেন তিনি। একবার এদিক, একবার সেদিক করে নিজের প্রয়োজনীয়তা ধরে রাখতে সফলও হন। আর সরকারপক্ষের দুর্বল প্রচেষ্টায় তিনি উভয় দলের সরকারের সময়ই বেশ কিছু মামলা থেকে মুক্তি পেয়ে যান। দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচনের বেশ আগে থেকেই বরাবরের মতো তিনি বিভিন্ন রকম অবস্থান নিতে থাকেন। কখনো মহাজোট ছাড়ার হুমকি আবার কখনোবা তাদের সঙ্গে চিরদিনের বন্ধনের কথাও বলতে থাকেন তিনি। তবে সর্বশেষ দুই মাসে মানুষ দেখেছে তাঁর নানা নাটক। একবার বললেন, সব দলসহ নির্বাচন না হলে তিনি তাতে যাবেন না। জনগণ থুতু দেবে। আবার কদিন বাদেই বলতে শুরু করেন, নির্বাচনে না গেলে জনগণ সব দলকেই থুতু দেবে। মহাজোট থেকে বেরিয়ে এসে দলীয় প্রার্থীদের মনোনয়ন দেন তিনি।
দাখিল করেন মনোনয়নপত্র। এমনকি নির্বাচনকালীন সরকারে নিজ দলের বেশ কয়েকজন সদস্যকে মন্ত্রী বা উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয় তাঁর সুপারিশে। হঠাৎ আবার নির্বাচন থেকে সরে আসার ঘোষণা দেন। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার আর নির্বাচনকালীন সরকার থেকে সরে আসার লোক দেখানো চেষ্টাও চলে। অবশ্য তাঁর কথায় বিশ্বাস রেখে বেশ কিছু প্রার্থী মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। তবে মানুষ ধাঁধায় ছিল। একপর্যায়ে ১১ ডিসেম্বর রাতের বেলায় র‌্যাব তাঁকে সিএমএইচে ‘নিয়ে যায়’। বলা হয়, তিনি অসুস্থ। চিকিৎসার জন্য তাঁকে তথায় নেওয়া হয়েছে। সেখানেই ছিলেন ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত। সেখান থেকে তাঁর মাঝেমধ্যে গলফ খেলার খবরও আসত। আবার তাঁর একজন মুখপাত্র দাবি করতে থাকেন, এরশাদকে আটকে রাখা হয়েছে। তিনি নির্বাচনে অংশ না নিতে সংকল্পবদ্ধ। তাঁর দলীয় প্রতীক লাঙ্গল কাউকে বরাদ্দ না দিতে তিনি সিইসিকে একটি চিঠিও দেন। কিন্তু তাঁকেসহ তাঁর দলের সবাইকে সে প্রতীক দেওয়া হয় রওশন এরশাদের সুপারিশে। প্রধান বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে নির্বাচনে যা হওয়ার, তা-ই হলো। নির্বাচনপর্ব শেষ হয় ৫ জানুয়ারি। এরশাদসহ তাঁর দল লাভ করল ৩৩টি আসন। এরশাদ তাঁর ভাষায় ‘বর্জন করা’ নির্বাচনে সাংসদ হলেন। দাখিল করা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের ‘আবেদনও করেছিলেন’ তিনি। তা সত্ত্বেও সাংসদ যখন হয়েই গেছেন,
তা টিকিয়ে রাখতে শপথ গ্রহণ করতে হয়। প্রথম দিন দলের সঙ্গে যাননি। দলটির সংসদীয় নেতা নির্বাচিত হলেন রওশন এরশাদ। সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি অনুসারে স্পিকার তাঁকে বিরোধী দলের নেতা বলে বিজ্ঞপ্তিও জারি করেছেন। এগুলো কতটা এরশাদের ইচ্ছায় কিংবা দলের অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহে, তা নিয়ে ভিন্নমত আছে। তবে অন্যদের শপথ দেওয়ার পরদিন জানা গেল, সিএমএইচ থেকে এরশাদ চুপিচুপি এসে সাংসদ হিসেবে শপথ নিয়ে আবার সেখানেই চলে যান। প্রশ্ন আসছে, চুপিচুপি শপথ নিতে হবে কেন? উত্তরটাও সবার জানা। গণমাধ্যমের নজর এড়াতে। তাদের নজরে এলেই হাজার প্রশ্ন হবে—নির্বাচন বর্জন, মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার, দলীয় সদস্যদের নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের নাটক আর বর্জন করা নির্বাচনে বিজয়ের জাদুর কাঠি নিয়ে। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসবে, তাঁঁর কথিত অসুস্থতা ও র‌্যাবের সহায়তায় সিএমএইচে যাওয়া নিয়েও। সুতরাং যতক্ষণ সম্ভব বা প্রয়োজন, ততক্ষণ তাদের নজর এড়িয়ে থাকতে পারলেই মঙ্গল। কিন্তু তারা নাছোড়বান্দা। তাঁর সঙ্গে দেখা হোক আর না-ই হোক, সংবাদ সংগ্রহ করে চলছে প্রতিযোগিতা করে। আর সেসব সংবাদ স্বাভাবিকভাবেই তাঁর ক্রমাগত ডিগবাজি খাওয়া অতীতকে সামনে নিয়ে আসছে। জাতীয় জীবনের স্পর্শকাতর বিষয়গুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে তিনি পছন্দ করেন। এতে জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও লাভবান হয়েছেন তিনি। যেমন সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মের বিধান সংযোজন আর সরকারি ছুটির দিন পরিবর্তন।
পীর-দরবেশদের দরবারে আসা-যাওয়াও তিনি সুযোগ পেলেই করেন। উদ্দেশ্য একটিই—তাঁদের সমর্থন নিজের দিকে টেনে আনা। সম্প্রতি হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচির প্রতি নৈতিক ও বৈষয়িক সমর্থন দিয়েছেন। নিয়েছেন তাঁদের কারোর দোয়া আর কারও বা বদদোয়া। কিন্তু এখন সাংসদ হিসেবে সে কর্মসূচি গ্রহণের জন্য সংসদে কি তিনি একটি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব আনবেন? তাঁর অতীত অন্তত বলে, তিনি তা করবেন না। আর যদি করেনই, তাঁর দলের সমর্থন পাবেন বলে মনে হয় না। বিশেষ করে দলটি সরকারের অংশ হওয়ায় এ ধরনের কর্মসূচির সমর্থন দেওয়ার সুযোগই নেই। পরিশেষে এল ১২ জানুয়ারি। বঙ্গভবনের দরবার হলে নতুন মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ। সে মন্ত্রিসভায় তাঁর দল থেকে একজন কেবিনেট মন্ত্রী ও দুজন প্রতিমন্ত্রী নেওয়া হয়। সেদিনই এক গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তিনি হন মন্ত্রী পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। ‘ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স’-এর বিধান অনুসারে তাঁর মানক্রম হবে মন্ত্রীর এক ধাপ নিচে। অবশ্য সাবেক রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি মানক্রমে মন্ত্রীর অনেক ওপরে। সুতরাং, নতুন নিয়োগ তাঁর মর্যাদা উন্নীত করেছে, এমনটি বলার সুযোগ নেই। বঙ্গভবনের জনাকীর্ণ দরবার হলে তিনি যখন প্রবেশ করেন, তখন তাঁর মুখ ছিল মলিন। প্রবেশের সময়ে কেউ দেয় করতালি, আর কেউবা হাসি। সে হাসি পরিহাস, কৌতুক কিংবা স্বাগতসূচক—যেকোনোটাই হতে পারে। যেটাই হোক, হেসেছেন অন্যরা। এবারেও তিনি হাসতে পারেননি।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.