দু'কুলই হারাচ্ছে জামায়াত by রাজীব আহাম্মদ

দু'কুলই হারাতে বসেছে জামায়াতে ইসলামী। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গত এক বছর যুদ্ধাপরাধের বিচার কেন্দ্র করে জামায়াত সারাদেশে ভয়াবহ সহিংসতা-নাশকতা চালিয়েছে। ফলে বিদেশিরাও মনে করছে, জামায়াত স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের মর্যাদা আর পেতে পারে না। সন্ত্রাসী দল হিসেবে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানাচ্ছেন তারা। এদিকে দেশের মধ্যে প্রধান মিত্র বিএনপিও জামায়াতের সঙ্গ ছাড়তে পারে বলে শোনা যাচ্ছে। ফলে নাশকতা-সহিংসতার দায়ে জামায়াত দু'কুলই হারাচ্ছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। দেশে-বিদেশে মিত্রহীন হয়ে পড়ছে দলটি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ গতকাল সমকালকে বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সহিংসতার দায়ে জামায়াতকে অভিযুক্ত করায় দলটি একা হয়ে পড়ছে। ইউরোপ যে প্রস্তাব পাস করেছে তাতে পরিষ্কার হয়ে গেছে জামায়াতের সঙ্গে তারা নেই। সহিংসতাকে কেউ সমর্থন করছে না। এদিকে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর বীরউত্তম শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে বলেন, জামায়াত নিষিদ্ধ হলে আমরা বাঁচি। বিএনপিকে জামায়াত ছাড়ার শর্ত না দিয়ে দলটিকে নিষিদ্ধ করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধ করা এবং নির্দলীয় সরকারের দাবিতে চালানো সহিংসতায় অন্তত ৬০০ মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। এর জন্য অনেকটাই দায়ী জামায়াত। যানবাহনে অগি্নসংযোগ, ভাংচুর, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে দলটির বিরুদ্ধে। দলটির অনেকেই মনে করেন, সহিংস আন্দোলনে জামায়াতের অর্জনের চেয়ে ক্ষতিই হয়েছে বেশি। জঙ্গি আদলে হামলা-নাশকতা চালাতে গিয়ে জামায়াতেরও ক্ষতি কম হয়নি। জামায়াতের দাবি, তাদের প্রায় সাড়ে চারশ' নেতাকর্মীর মৃত্যু হয়েছে। মামলা হয়েছে প্রায় পাঁচ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। কেন্দ্রীয় অধিকাংশ নেতা এখন জেলে আছেন।
গত বৃহস্পতিবার ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টে বাংলাদেশ বিষয়ক প্রস্তাব পাস হয়। এতে কারও নাম বলা না হলেও চলমান সহিংসতার জন্য জামায়াতকেই দায়ী করা হয়। এ কারণে দলটিকে নিষিদ্ধ করারও আহ্বান জানানো হয়। সরকারের সঙ্গে সফল সংলাপের জন্য জামায়াতের সঙ্গ ছাড়তে বিএনপির প্রতি আহ্বান জানায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এ আহ্বানের পর বিএনপিও নতুন করে হিসাব করছে। জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করা ছাড়া সরকার তাদের সাথে সংলাপেও বসবে না। এটা সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে বিএনপি জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ছে_ এ রকম গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া একটি বিদেশি গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, জামায়াতের সঙ্গে জোট স্থায়ী নয়। গত বুধবার সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়া পরিষ্কার করে না বললেও জামায়াতের সঙ্গত্যাগের ইঙ্গিত দেন। সরকারের সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে মধ্যবর্তী নির্বাচনের জন্য ১৮ দল থেকে জামায়াতকে বাদ দিতে বিএনপির অভ্যন্তরেও জোরালো মত রয়েছে। জামায়াতের সঙ্গে জোট থাকলেও যুদ্ধাপরাধের ইস্যুতে বিএনপিসহ বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো জামায়াতের পাশে দাঁড়ায়নি। ধর্মভিত্তিক দলগুলো এ ইস্যুতে জামায়াতকে সমর্থন দেয়নি। সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপে বিএনপি এখন জোটও ভাঙতে পারে। জামায়াত নেতারা মনে করছেন, ঘরে-বাইরে মিত্রহীন কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়েছেন তারা।
বাংলাদেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বুদ্ধিজীবী মনে করছেন, জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার সময় এসেছে। এ বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার বিষয়েও বিএনপির প্রতি চাপ বাড়ছে। টিভি টকশোতে এ বিষয়টি ব্যাপক আলোচিত হচ্ছে। সাবেক কূটনীতিক আশফাকুর রহমান গতকাল গণমাধ্যমকে বলেন, জামায়াত নিষিদ্ধ করতে সুপ্রিম কোর্টে সরকারের আবেদন থাকলেও নির্বাচনের আগে-পরে সহিংসতার কারণেই নির্বাহী আদেশে তাদের নিষিদ্ধ করা সম্ভব। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সহিংসতায় জড়িতদের নিষিদ্ধের যে আহ্বান জানায় তাকে বাস্তবসম্মত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এদিকে বিএনপি জোট ভাঙতে পারে এ আশঙ্কায় হতাশ জামায়াত। দলটির মজলিসে শূরার সদস্য রেজাউল করিম বলেন, 'সরকার সংলাপের ব্যাপারে নূ্যনতম আন্তরিক নয়। যদি আন্তরিক হতো তাহলে এমন অবাস্তব শর্ত দিত না। বিএনপি কার সঙ্গে জোট করবে বা করবে না, এটা বিএনপির বিষয়।' শিবিরের এ সাবেক সভাপতি বলেন, আওয়ামী লীগ ইংরেজদের মতো 'ভাগ করো ও শাসন করো' নীতি নিয়েছে। বিএনপি-জামায়াতকে আলাদা করে শাসন করার নীতি নিয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রেরও জামায়াতনীতি বদলে গেছে। গত দেড় দশকে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা বাংলাদেশ সফরে এলে জামায়াতের সঙ্গে বৈঠক ছিল অবধারিত। এখন বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জামায়াতের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করছেন না। ২০১২ সালে ড্যান ডবি্লও মজীনার সঙ্গে জামায়াতের তিন দফা পূর্বনির্ধারিত বৈঠক বাতিল হয়। সর্বশেষ গত মে মাসে জামায়াত নেতাদের আইনজীবীদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেন মজীনা।
শুধু দূরত্ব বৃদ্ধি নয়, জামায়াতের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গিও বদলে গেছে। ২০০৩ সালের ৩০ এপ্রিল বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত হ্যারি কে টমাস জুনিয়র জামায়াতকে 'উদারপন্থি গণতান্ত্রিক ইসলামিক রাজনৈতিক দল' হিসেবে বর্ণনা করে। কিন্তু সেই যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে জামায়াত এখন 'ইসলামিক মৌলবাদী' দল। ২০১২ সালের ৬ মার্চ দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ বিষয়ক 'ব্যাকগ্রাউন্ড নোট'-এর সংস্করণে জামায়াতকে এভাবে বর্ণনা করা হয়। তুরস্ক, মিসর, তিউনিসিয়াসহ কয়েকটি দেশে জামায়াতের বন্ধুভাবাপন্ন রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় ছিল। জামায়াতের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে এ সরকারগুলোর কার্যকর ভূমিকা ছিল। সূত্র জানায়, জামায়াতের এ শক্তিও হাতছাড়া হয়ে গেছে। এ সরকারগুলোর পতনে জামায়াত আন্তর্জাতিক মানচিত্রে পুরোপুরি একা হয়ে গেছে।
গত বছরের জুলাইয়ে মিসরের ইখওয়ানুল মুসলিমিন সমর্থিত প্রেসিডেন্ট মুহম্মদ মুরসিকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয় সেদেশের সেনাবাহিনী। ইখওয়ান জামায়াতেরই আন্তর্জাতিক সংস্করণ। সর্বশেষ তিউনিসিয়া থেকে এন্নাহাদা সরকারের পতন হয়েছে। জামায়াত নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মিসরে মুরসির পতন জামায়াতকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তুরস্কে জামায়াতের বন্ধুভাবাপন্ন প্রধানমন্ত্রী তাইয়েপ রিসেপ এরদোগানের ক্ষমতা টালমাটাল। দুর্নীতির দায়ে তার তিন মন্ত্রী বিদায় নিয়েছেন। সেনাবাহিনীর সঙ্গে দূরত্ব_ সব মিলিয়ে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত আছেন এরদোগান। বিদেশি সরকারপ্রধানদের একমাত্র তিনিই বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেন। জামায়াত নেতাদের সাজা না দিতে বাংলাদেশকে চিঠি দেন। বাংলাদেশ সফরে এসেও শেখ হাসিনার কাছে একই দাবি তোলেন। তুরস্কের মতো শক্তিশালী দেশের প্রধানমন্ত্রী এরদোগান নিজেই বিপাকে থাকায় আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে জামায়াতের মিত্র আরও কমছে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।

No comments

Powered by Blogger.