খুনী হিসেবে গড়ে তুলতে যেভাবে ট্রেনিং দেয় জামায়াত- নিজামীসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের সফরের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই রাজশাহীতে হামলা

মতিউর রহমান নিজামীসহ জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতারা রাজশাহীতে সমাবেশ করে ফিরে আসার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আঘাত হানল ছাত্র শিবির।
শিৰার্থীদের ওপর পৈশাচিক তা-ব চালিয়ে হাত-পায়ের রগ কেটে বীভৎস হত্যাকা-ের মাধ্যমে উগ্র মৌলবাদী শিবির প্রকাশ করল তার আসল রূপ। যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতের এই সংগঠন আবার জানিয়ে দিল, ছাত্র সংগঠনের নামে কার্যক্রম চালালেও শিবির একটি সশস্ত্র ও উগ্রজঙ্গীবাদী সংগঠনের নাম। জনকণ্ঠের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে দেশের শিশু শিৰার সত্মর থেকে শুরম্ন করে উচ্চ শিৰা পর্যনত্ম শিৰার আড়ালে লেবাসধারী এই সংগঠনের উগ্রবাদী চেহারা। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে ফুলকড়ির আসর থেকে ফোকাস, রেটিনাসহ নিজস্ব কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে কিভাবে শিৰার্থীরা হয়ে ওঠে শিবিরের ভয়ঙ্কর ক্যাডার। কেবল তাই নয় জানা গেছে, আনত্মর্জাতিক অঙ্গনে 'আইসিএস' নামে পরিচিত এই সংগঠনের রয়েছে 'ক্রিজ বা কিরিস বাহিনী' নামে বিশেষ জঙ্গী বাহিনী। অস্ত্র চালনায় প্রশিৰণপ্রাপ্ত, হাতবোমা বানানো ও নিৰেপে দৰ কর্মী, সদস্য কিংবা সাথীদের নিয়ে গঠিত হয় বিশেষ এই জঙ্গী বাহিনী।
দেশের কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরম্ন করে স্কুলের শিক ও শিার্থীরাও ব্যাপকভাবে শিবিরের কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ার উদ্বেগজনক তথ্য পাওয়া গেছে। জামায়াত ও শিবির নেতারা এখন প্রকাশ্যেই বলছে, দেশের শিৰাঙ্গনে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী সংগঠনের নাম ছাত্র শিবির। জামায়াত আর শিবির খড় কুটা নয় যে বাতাসেই উড়ে যাবে। সমপ্রতি শিবিরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সভায় জামায়াত ও শিবির নেতারা সরকার ও ছাত্রলীগ নেতাদের হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, শিবিরকে ঘাটাবেন না। তাহলে ১০ হাট মাটির নিচে গিয়েও রৰা পাবেন না। স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির। প্রথম থেকেই ধর্মীয় রাজনীতির ভুল আর বিভ্রানত্মিকর ব্যাখ্যার মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতাবিরোধী কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েছে সংগঠনটি। ১৯৪৭ সালে জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মওলানা মওদুদীর নেতৃত্বে যে জামাত-ই-তালেবার জন্ম হয় পরবর্তীতে ১৯৫৫ সালে তা ইসলামী ছাত্র সংঘে রূপ নেয়। জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্র সংঘ প্রত্যভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে। ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্যদের নিয়ে গঠিত হয় আলবদর বাহিনী। স্বাধীনতার পর ধর্মীয় রাজনীতি বন্ধ ঘোষণা করলে এ ধরনের সংগঠনের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়াও দেশ স্বাধীন হলে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্যরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। এরপর জেনারেল জিয়া মতায় আসলে ইসলামী ছাত্র সংঘ ১৯৭৭ সালের ৪ ফেব্রম্নয়ারি ইসলামী ছাত্রশিবির নামে যাত্রা শুরম্ন করে। ইসলামী ছাত্রশিবিরের ফাউন্ডিং চেয়ারম্যান মীর কাশেম আলী এবং পরবর্তীতে কামরম্নজ্জামান ও আব্দুল জলিল আবু নাসের এরা সবাই সক্রিয় আলবদর ছিল। শিৰা কার্যক্রমের আড়ালে বর্তমানেও বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের জঙ্গী কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। এরা সক্রিয় রয়েছে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়সহ জাহাঙ্গীর নগর, সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের বিদায়ের আগে মহাজোটের আন্দোলন ঠেকাতে ছাত্রশিবিরের সশস্ত্র তৎপরতাই সবচেয়ে বেশি ল্য করা গেছে। বর্তমান সরকার মতায় আসার পরও অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবির তাদের অবস্থান অটুট রেখেছে। এছাড়াও দেশের প্রত্যনত্ম অঞ্চল থেকে শুরম্ন করে শহরের স্কুল-কলেজগুলোতেও শিবির নিজস্ব নামে অথবা বিভিন্ন সংগঠনের নামে চালিয়ে যাচ্ছে কার্যক্রম। সরচেয়ে বেশি সক্রিয়তা হচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মাদ্রাসাগুলোতে।
শিবিরের রয়েছে বিশেষ জঙ্গী বাহিনী। এ বাহিনীকে বলা হয় 'ক্রিস (কিরিস) বাহিনী'। বিশেষভাবে অস্ত্র চালানোয় প্রশিণপ্রাপ্ত এবং হাতবোমা বানানো ও ছোড়ায় পারদর্শী এরা প্রায় সকলেই শিবিরের কর্মী, সদস্য অথরা সাথী। মহাজোট সরকার মতায় আসার পর শিবির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাস ও হলদখলের কাজে ক্রিস বাহিনীকে কাজে লাগাচ্ছে বলে জানা গেছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এ বাহিনীর সদস্যরা অপারেশনের কয়েকদিন পূর্বেই ক্যাম্পাসের আশপাশে অবস্থান নেয়। গত মে মাসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সঙ্গে সংঘর্ষের পর সোমবার মধ্যরাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও ক্রিস বাহিনীর অংশগ্রহণ ছিল বলে জানা গেছে। শিবিরের অনেক কর্মীর দাবি, একমাত্র এ বাহিনীর কারণেই তারা এখনও অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাব বজায় রেখেছে। পল্টনে জামায়াত-শিবিরের ক্রিস বাহিনীর ছিল ব্যাপক তৎপরতা। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ কর্মীদের ঢুকতে না দেয়াতে ভূমিকা রাখে শিবিরের বোমা বাহিনী।
জানা গেছে, শিার্থীদের শিশুকাল থেকেই টার্গেট করে শিবির। আর এ জন্য গঠন করেছে শিশু সংগঠন 'ফুলকুড়ি আসর'। অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে, ফুলকুড়ি আসরে যে সব শিশু প্রবেশ করে পরবর্তীতে তারা ছাত্রশিবিরে যোগ দেয়। শিবিরের সম্পূর্ণ কার্যক্রম পরিচালিত হয় একটি ক্রমানুযায়ী। প্রথম পর্যায়ে একটি শিশুকে পরিচিত করা হয় ফুলকুড়ি আসরের সঙ্গে। ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে উঠলেই তাকে দিয়ে শিবিরের ফরম পূরণ করানো হয়। যখন একটি শিশু শিবিরে প্রবেশ করে তখন সংগঠনের সমর্থক হিসেবে নিবন্ধিত হয়। খোদ রাজধানীর বেশ কয়েকটি প্রথম সারির স্কুলেও কাজ করছে ফুলকুড়ি আসর।
শিবির সবচেয়ে বেশি কাজ করে স্কুলের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন 'বাংলাদেশ স্কাউট' এর মধ্যে। এছাড়াও রোভার স্কাউট ও বিএনসিসি কার্যক্রমেও ব্যাপকভাবে সক্রিয় শিবির কর্মীরা। বিগত বছরগুলোতে স্কাউটের শিশুরা জাতীয় স্টেডিয়ামে বিজয় দিবসের প্যারেডে অংশগ্রহণের জন্য মনোনীত না হলে ফুলকুড়ি আসরের মাধ্যমে অংশগ্রহণের জন্য দাওয়াত দেয়া হয়। এরপর থেকেই ফুলকুড়ি আসরের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ে শিশুরা। শিশুদের বিভিন্ন ধরনের ইসলামিক বই সরবরাহ করা হয়। সুযোগ বুঝে ষষ্ঠ বা সপ্তম শ্রেণীতে উঠলে শিবিরের ফরম পূরণ করিয়ে নেয়া হয়। শিশুদের মধ্যে 'নতুন কিশোর কণ্ঠ' এবং 'ইয়ুথ ওয়েব' নামে দুটি মাসিক সম্পাদনা সরবরাহ করা হয়। যা বাংলাদেশ ছাত্রশিবির থেকে বের হয়। স্কুলপর্যায়ে এ সব দায়িত্ব পালন করে শিবিরের কেন্দ্রীয় স্কুল কার্যক্রম সম্পাদক আতাউর রহমান সরকার, কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক সম্পাদক সোহেল খান এবং কেন্দ্রীয় প্রকাশনা সম্পাদক নজরম্নল ইসলাম।
শিবিরের পরিচালিত বেশ কয়েকটি কোচিং সেন্টার রয়েছে যা শিার্থীদের অনত্মভর্ুক্তিতে সহায়তা করে। এর মধ্যে এইচএসসি পাসকৃত শিার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির জন্য 'ফোকাস', মেডিক্যালে ভর্তির জন্য 'রেটিনা' এবং ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তির জন্য 'কনক্রিট' সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। দেশব্যাপী শতাধিক শাখা রয়েছে এ তিনটি কোচিংয়ের। যেসব জায়গায় এসব কোচিং রয়েছে সেগুলো স্থানীয় শিবির নেতৃবৃন্দ দ্বারাই পরিচালিত হয়। কোচিং-এ শিকতা এবং অন্যান্য চাকরির মাধ্যমে শিবির কর্মীদের থাকা-খাওয়ার নিশ্চয়তা দেয় ছাত্রশিবির। বর্তমানে এ কোচিংগুলোর মূল পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আনিসুর রহমান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি জাকির হোসাইন এবং কেন্দ্রীয় শিা সম্পাদক যোবায়ের আহমেদ ভূঁইয়া। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের সব নেতাকর্মী ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে কোচিং সেন্টারগুলোর সঙ্গে। রেটিনা কোচিংয়ের সঙ্গে জড়িত রয়েছে মেডিক্যাল কলেজের এবং কনক্রিটের সঙ্গে জড়িত রয়েছে ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবির কর্মীরা। প্রতি বছর প্রায় এক কোটি টাকার মতো আয় হয় দেশব্যাপী কোচিং সেন্টারগুলোর বিভিন্ন শাখা থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশকারী এসব শিার্থীকে এভাবেই সংগঠনে ভেড়ায় শিবির।
অন্যদিকে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ২০০১ থেকে ২০০৭ পর্যনত্ম চার জোটের সময় শিকদের যে নিয়োগ হয়েছে তার বেশিরভাগই শিবিরের কর্মী বা নেতা। ছাত্রদল বা বিএনপি ঘরানার ছাত্ররাও নিয়োগে ছিল অনেক পিছিয়ে। শিবির ব্যাকগ্রাউন্ডের এসব শিকরা এখন কাজ করছে শিবিরের নেতাকর্মীদের মতোই।

No comments

Powered by Blogger.