বিশ্ব ভিক্ষুক দিবস চালু হোক by হাসান হাফিজ

—স্যার, ভিক্কা দ্যান।
একথা শুনে ভদ্রলোক ফিরে তাকালেন। ভিখিরিটার শরীরের দুর্দশা দেখে তার করুণা হলো। মানিব্যাগ থেকে একটা নোট বের করলেন। আলতো করে সেটা রাখলেন ভিখিরির ভাঙাচোরা থালে। নোট দেখে সেই ব্যাটা ছ্যাঁত্
করে উঠল,

—স্যার এইটা কী করলেন? আমি তো ছিঁড়া-ফাটা দুই ট্যাকার নোট ভিক্কা লই না। কপাল এমতেই খারাব, আবার ছিঁড়া-ফাটা নোট দিয়া মশকারি করলেন?
ভদ্রলোকের আক্কেল গুড়ুম। পরে এক বন্ধুর সঙ্গে আড্ডায় প্রসঙ্গটা তুললেন। বন্ধু যেসব তথ্য দিল, তাতে তার চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। বন্ধু জানায়, দিনবদলানোর সঙ্গে সঙ্গে ভিক্ষুকরাও স্মার্ট হয়ে গেছে। এয়ারপোর্টে (জিয়া না শাহজালাল?) ওরা বাংলাদেশ কারেন্সিতে নজরানা নিতে নারাজ। ডলার-পাউন্ডে, দিরহাম-রিঙ্গিতে ভিক্ষা চায় তারা। ভিক্ষুকদেরও নিজস্ব সিন্ডিকেট আছে। মোবাইল ফোনে তারা তথ্য চালাচালি করে থাকে। করতেই পারে। ভিক্ষুক বলে কি তাদের মান-ইজ্জত নেই? কোনো বিশেষ উত্সবে-পরবে ভিক্ষুক দরকার হলে কোনো ভিক্ষুক নাকি ‘কন্টাক্ট’ নেয়। পাখিপড়া করে আগেভাগেই নাকি সেই মোড়ল ব্যাটা জেনে নেয়, কতজন ভিক্ষুক আনতে হবে, মেন্যুতে কী থাকবে। ক’টার সময় হাজিরা দিতে হবে (পুরনো টাইম না হাসিনার টাইম) ইত্যাদি। এক প্রকার প্যাকেজ আর কী! কর্পোরেট কালচারের যুগে এটাকে অস্বাভাবিক ভেবে চোখ কপালে তোলার কিছু নেই।
ভিখিরি নিয়ে বন্ধুপ্রবর কয়েকটা চুটকি শোনালেন। শুনে ভদ্রলোক নির্মল আনন্দ পান। এসব চুটকি অবশ্যি অনেকেরই জানা। দুটি এখানে উল্লেখ করা হলো। এক ভিখিরি এক বাড়িতে গিয়ে ভিখ মাঙছে। বাড়ির কর্তা এসে বললেন, মাফ করো ভাই। বাড়িতে এখন কোনো মেয়েছেলে নেই। ভিক্ষা দিতে পারছি না।
ভিখিরিও কম যায় না। ঠ্যাটা লোক। নির্লিপ্ত কণ্ঠে মুখের ওপর জবাব দেয়,
—মেয়েছেলে তো চাই নাই সাব। ভিক্কা চাইছি। দিলে দ্যান, না দিলে নাই। আজাইড়া প্যাঁচাল পাইড়েন না।
চুটকি নম্বর দুই। এই চুটকির নায়ক দুই ভিখিরি। তারা নিজেরাও দুই নম্বরি। এক লোক প্রতিদিন দেখেন নির্দিষ্ট জায়গায় নির্দিষ্ট এক লোক বসে ভিক্ষা করে। একদিন তিনি দেখলেন, সেখানে অন্য লোক বসে আছে। তিনি তাকে জিগ্যেস করলেন,
—ওই মিঞা, তোমাকে এখানে নতুন দেখছি। আর তোমার চেহারার সঙ্গে মিল গেটে বসে যে ফকির, তার চেহারার বেশ মিল রয়েছে।
ভিখিরি জবাব দেয়,
— হেইডা আপনে ঠিকই দেখতাছেন। মিল গেটে বসে আমার মায়ের পেটের আপনা ভাই। সে অন্ধ। আইজকা সে সিনেমা দেখতে গেছে।
—আর তুমি, তোমার কী পরিচয়? সাকিন ঠিকানাই বা কী? কৌতূহলী ভদ্রলোক জানতে চান।
ভিখিরি এই প্রশ্ন শুনে একটু লজ্জা পেল মনে হয়। সুশীল সমাজের পরিভাষায় ‘বিব্রত’ বোধ করা যাকে বলে। সে আমতা আমতা করে উত্তর দেয়,
— আমি ছার বোবা। কতা কইতে পারি না। আন্ধা ভাইয়ের বদলি খাটতে আইছি এহানে।

দুই.
ভিক্ষুক বিষয়ে ভদ্রলোকের আগ্রহ বাড়ে। তিনি এ বিষয়ে রীতিমত গবেষণায় লিপ্ত হন। প্রাইভেট গবেষণা। বাংলাদেশে এখন প্রাইভেট সেক্টরের জয়-জয়কার। সুতরাং যে কোনো প্রচেষ্টা, তা সে শিল্প-কারখানায় বিনিয়োগ হোক, টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজি হোক, ছাত্রী সাপ্লাই হোক, গোপন বখরা প্রাপ্তি হোক, সবই গোপনে হওয়া বাঞ্ছনীয়।
মাথা ঘামিয়ে এন্তার লোকের সঙ্গে (তার মধ্যে বেশকিছু ভিখিরিও অন্তর্ভুক্ত) আলাপ-সালাপ করে সাক্ষাত্কার নিয়ে তিনি কিছু সিদ্ধান্তে উপনীত হন। কয়েক বছর লেগে গেল তাতে। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী গোছের কেউ হলে অনুদান পাওয়া যেত। গবেষণা কর্ম তাহলে ডিজিটালি সেরে ফেলার অবকাশ মিলত। কিন্তু সে গুড়ে বালি। তার কাজ শেষে প্রণীত উপসংহারকে সিদ্ধান্ত না বলে অবজারভেশন বলাই ভালো। আমরা সেই গুপ্ত খাতায় একটু চোখ বুলিয়ে নেয়ার চেষ্টা করি। প্রথম দুটি হাইলাইটস এরকম :
ক. বিশ্ব ভিক্ষুক দিবসের প্রচলন করা দরকার অবিলম্বে। ইউনেস্কোকে এ বিষয়ে প্রস্তাব দিতে পারে বাংলাদেশ। কারণ, দাতা বাপদের পায়ে ধরে ভিক্ষেসিক্ষে করেই চলতে হয় এই দেশটাকে। সেই সুযোগে পাশ্চাত্যের স্বঘোষিত মুরুব্বিরা চোখ রাঙায়। যখন তখন যা তা বলে। কোনো কোনো কূটনীতিক বঙ্গনারীর সঙ্গে ফস্টিনস্টি করার আস্পর্ধা পর্যন্ত দেখায়। শাদা চামড়া হওয়ার সুবাদে তাদের মাটিতে পা পড়ে না। সেই ফুটানির জোরে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অনায়াসে নাক গলিয়ে পার পেয়ে যায়। ভিক্ষা করতে করতে বাংলাদেশের এক ধরনের দক্ষতা, সহ্যক্ষমতা, ঋণদাতাদের পটিয়ে কাজ বাগানোর কলাকৌশল ইত্যাদি সম্পর্কে বিরাট ও মূল্যবান অভিজ্ঞতা হয়েছে। স্কিলড কিছুর কদর করতে পশ্চিমাদের জুড়ি নেই।
খ. প্রেমচর্চার মধ্যেও ভিক্ষার একটা ব্যাপার স্যাপার অপ্রকাশ্য হলেও জড়ানো আছে। এই ভিক্ষাপ্রার্থীরা বিফল হলে আত্মহত্যার মতো মারাত্মক অঘটনও ঘটিয়ে বসে। অল্পবয়সী যারা, তাদের মধ্যে এই রোগের সংক্রমণ বেশি। নিপা ভাইরাসের চেয়েও ভয়াবহ সেই প্রবণতা। সুতরাং ‘বেগার্স ডে’র চল করতে গেলে ভ্যালেন্টাইন ডে’র সঙ্গে এটা সাংঘর্ষিক হয়ে যেতে পারে। প্রেমভিক্ষা ও মুষ্টিভিক্ষা একাকার করে ফেললে মহাবিপদ।
গ. যেসব দেশে স্ট্রিট বেগারদের দৌরাত্ম্য নেই, সেসব দেশে এই মডেল আমরা রফতানি করার একটা উদ্যোগ নিতে পারি। আতুড়-লুলা দু’চারটাকে প্রয়োজনে এক্সপোর্ট করা যেতে পারে। তারা হাতে-কলমে দেখিয়ে দেবে কেমন করে লোক পটাতে হয়। এই ব্যাপারে সাউথ এশিয়ান গেমসে পরীক্ষামূলকভাবে একটা নতুন ইভেন্ট প্রবর্তন করার প্রস্তাব দেয়া যায়। পাইলট প্রকল্প সফল হলে পর্যায়ক্রমে এশিয়ান গেমস, কমনওয়েলথ গেমস, অলিম্পিক—চূড়ান্ত পর্যায়ে বিশ্বকাপের স্বপ্ন আমরা দেখতে পারি। স্বপ্ন দেখতে দোষ নেই—কোনো পয়সা তো লাগে না এতে। অপ্রচলিত পণ্য হিসেবে ভিক্ষুক রফতানির ক্ষেত্রে আমরা অতি অবশ্যই রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর কাছ থেকে বিশেষ ইনসেনটিভ আশা করতে পারি।
ঘ. ভিক্ষুক পুনর্বাসনের নামে প্রায়ই প্রশাসনের পক্ষ থেকে বেহুদা পঙ্গু প্রতিবন্ধী অচল ভিক্ষুকদের জোর-জুলুম করা হয়। তাদের রাজধানী থেকে উচ্ছেদের মতো অমানবিক প্রয়াস গ্রহণ করা হয়। এই জবরদস্তি চলতে দেয়া যায় না। এই অনাচার-অবিচার ও নির্যাতন থেকে অসহায় ভিক্ষুকদের বাঁচানোর জন্যই বিশ্ব ভিক্ষুক দিবস চালু করা উচিত। কারণ, সব শালাই কাঙাল। কেউ নামের কাঙাল, কেউ টাকার কাঙাল, কেউবা প্রেমের কাঙাল।
ঙ. বিশ্ব ভিক্ষুক দিবস চালুর পক্ষে আরও একটি জোরালো যুক্তি হলো যে, ভিখিরিরা চোর ডাকাত সন্ত্রাসী প্রজাতির কেউ নয়। তারা তাদের মৌলিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই নিরন্তর সংগ্রাম করে চলেছে। রোদে পুড়ে, বিত্তবান মানুষের অবহেলা, উপেক্ষা, ঘৃণা সহ্য করে দাঁতে দাঁত চেপে এই পেশা টিকিয়ে রেখেছে। পৃথিবীর আদিতম পেশা টিকিয়ে রাখার যে ঐতিহ্য, সেইজন্য প্রাপ্য সম্মান তাদের দিতে কোনো কার্পণ্য থাকা উচিত নয়। সেজন্যই এই দিবসের মর্মবাণী অজ্ঞ ও বিবেকহীন বিশ্ব মানব সম্প্রদায়ের চেতনায় সঞ্চারিত করার লক্ষ্যে অবিলম্বে বিশ্ব ভিক্ষুক দিবস চালু করা উচিত। দুনিয়ার ভিখিরি এক হও।দৈনিক আমার দেশ’র ১ সেপ্টেম্বর ২০০৯ সংখ্যায় একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল। সেই রিপোর্টের শিরোনাম হচ্ছে—‘রাজধানীতে ভিক্ষুক-হকারদের ঈদ মৌসুম প্রতিদিনই যোগ হচ্ছে নতুন নতুন মুখ’। সৈয়দ মিজানুর রহমানের লেখা ওই রিপোর্টে বলা হয় : রাজধানী ঢাকা শহরে এখন ভিক্ষুকের সংখ্যা প্রায় ৭০ হাজার। আর সারা দেশে এদের সংখ্যা কমপক্ষে ৭০ লাখ। ১৮ ধরনের ভিক্ষুক রয়েছে দেশে। ঢাকার ভিক্ষুকদের মাসিক গড় আয় সাতশ’ টাকা। ৯৭ ভাগ ভিক্ষুকের দৃষ্টিতে ভিক্ষাবৃত্তি একটি ঘৃণিত পেশা। তারপরও তারা বাধ্য হয়ে রয়েছে এ পেশায়, অনেকে ৭-৮ বছর ধরে করছে ভিক্ষা।
ভিক্ষুকদের সম্পর্কে এসব তথ্য প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশ পিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট মিশন (বিপিডিএম), রোভার্স গ্রুপ এবং সরকারি তিতুমীর কলেজের উদ্যোগে পরিচালিত এক যৌথ সমীক্ষায়। ঢাকা শহরের এক হাজার ভিক্ষুকের ওপর তারা এই সমীক্ষাটি চালায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা শহরে ময়মনসিংহ জেলার ভিক্ষুকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। জরিপে দেখা গেছে, ৫৪ দশমিক ২০ ভাগ ভিখিরি ধূমপায়ী এবং শতকরা দুই জন মাদকাসক্ত।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক
hasanhafiz51@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.